জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যের আহবান জানানো হচ্ছে। প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে দল, মত নির্বিশেষে জাতীয় ঐক্যের। এই আহবান ও প্রস্তাব মোটেই গ্রহণযোগ্য ও প্রশংসনীয় নয়। যেমন ধরা যাক একটি গ্রামের কোনো বাড়িতে আগুন লাগলো। যে বাড়িতে আগুন লাগলো সে বাড়ির সাথে এই গাঁয়ের সব বাড়ির মধুর সম্পর্ক থাকবে তা কিন্তু নয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবেশী বনাম প্রতিবেশী সাপে নেউলে সম্পর্ক থাকে। যে বাড়িতে আগুন লাগলো তার সাথে সুসম্পর্ক বজায় না থাকা বাড়ির কেউ যদি মাইকে প্রচার শুরু করে দেয়, অমুকের বাড়িতে আগুন লেগেছে আসুন দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুলে গিয়ে আগুন নেভাতে একমতের সিদ্ধান্ত নিতে আমরা একসাথে বসি। এরকম আহবানে নিশ্চয়ই আগুন নিভবেনা। ততক্ষণে সেই বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে পাশের বাড়িতেও আগুন ছড়িয়ে যাবে।
অথবা কোনো গ্রামে যদি ডাকাত পড়ে তখন গ্রামবাসী যদি তাৎক্ষণিক ডাকাত প্রতিরোধে সর্বশক্তি নিয়োগের কর্মসূচি না দেয় তাহলে কিন্তু ডাকাতরা লুণ্ঠিত মালামালসহ নিরাপদে চলে যাবে। এক্ষেত্রে গ্রামবাসীর করণীয় হবে বালতি, কলসি, জগ, মগ হাঁড়ি পাতিল যার যা আছে তা দিয়েই আগুন নেভানোর কাজে তৎপর হওয়া। আশেপাশে ফায়ার সার্ভিস থাকলে তাকেও খবর দেয়া। আগুন নিভানোর জন্য তখন গ্রামীয় ঐক্যের আহবান হবে খুবই হাস্যস্পদ, অযৌক্তিক, অবান্তর ও আত্মনাশী। তদ্রুপ ডাকাত পড়লেও তাই।গ্রামবাসীর তখন উচিত হবে লাঠিসোঁটা, দা-কুড়াল, খুন্তি ও বন্দুক যার যা আছে তা দিয়েই ডাকাত প্রতিরোধে তৎপর হওয়া। তা না করে ডাকাতির বিরুদ্ধে গ্রামীয় ঐক্যের আহবান জানালে ডাকাতরা নিরাপদে চলে যাবে ও পরবর্তিতে এই গাঁয়েরই অন্য কোনো বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা সংঘটিত করবে।
বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি হামলাগুলোও এই আগুন লাগা ও ডাকাত পড়ার মতোই। অথচ একে ঘিরে কর্মসূচির ঐক্য গড়ে উঠছেনা। বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে জাতীয় ঐক্যের কথা বলছেন। কিন্তু এই ঐক্যের কথা না বলে যদি প্রত্যেকেই জঙ্গিবাদবিরোধী কর্মসূচি শুরু করে দিত তাহলে পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে যেত। রাজনৈতিক নানা তৎপরতায় হেরে যাওয়া হতাশাগ্রস্থ বেগম খালেদা জিয়া ও তার দল জঙ্গিবাদবিরোধী ইস্যুতে ইচ্ছে করলেই রাজনৈতিক তৎপরতায় ফিরে আসতে পারেন। দেশ ও বিশ্ববাসীর সামনে নজীর স্থাপন করতে পারেন যে তারা দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তায় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও রেষারেষি ভুলে যেতে সক্ষম। এতে করে তাদেরই রাজনৈতিক প্লাস পয়েন্ট হওয়ারই কথা। তাদের উচিত জাতীয় ঐক্যের আহবান না জানিয়ে দেশব্যাপী জঙ্গিবাদ বিরোধী কর্মসূচি ঘোষণা করা।১৪ দলীয় জোট নানা কর্মসূচি পালন করছে বলে বিশদল কর্মসূচি পালন করতে পারবেনা এটা কেমন কথা? দেশটা কি শুধু ১৪ দলের বিশ দলের নয়? আইএস ইস্যুতে আমেরিকা যদি বাংলাদেশে প্রবেশ করে এটা কি বেগম খালেদা জিয়ার জন্য সুখকর হবে। উনার নামের আগে দেশনেত্রী বিশেষণ জুড়ে দেয়া হয়। তবে দেশের এই দুঃসময়ে দেশনেত্রীর কি কিছুই করণীয় নেই।
এক্ষেত্রে শেয়াল আর কাকের দ্বন্দ্বের কথা মনে পড়ে গেল। শেয়াল বলল, হে আল্লাহ তুমি এমন একটা বন্যা দাও যাতে গাছের আগায় পানি ওঠে। দেখি কাকেরা কোথায় থাকে!(মরা গরু, মরা ছাগল, মরা মুরগী প্রভৃতিতে কাকেরা ভাগ বসায় বলেই শেয়ালের এত ক্ষোভ ও তার ধ্বংস কামনা) আল্লাহ শেয়ালের প্রার্থনা মঞ্জুর করল। গাছের আগায় পানি উঠলো। কাকেরা উড়ে কচুরি পানায় আশ্রয় নিলো কেউ উড়ে অনেক দূরে চলে গেল যেখানে বন্যা নেই। রাজনৈতিক লড়াইয়ে হেরে যাওয়া ম্যাডাম খালেদাও কি এই গল্পের বাস্তবতা হয়ে উঠছেন কিনা সেটা সময় বলে দেবে।
দেশের ব্যবসা বাণিজ্য, জননিরাপত্তা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ধ্বংসের আত্মনাশী অপকর্ম পরিচালিত হচ্ছে দেশে। ঢাকায় মেট্রোরেল স্থাপন একটি যুগান্তকারী ঘটনা। অথচ এই মেট্রোরেলের বিদেশী কর্মকর্তাদের হত্যা করা হলো। উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই এই যুগান্তকারী ঘটনা যাতে সফলতার মুখ না দেখে। বিদেশীদের হত্যা করে দেশকে বিদেশের কাছে বিরাগভাজন করে তোলাই উদ্দেশ্য নয় কি? এ সরকার ব্যর্থ, এ সরকার জনজীবনের নিরাপত্তা দিতে পারছেনা এটি দৃশ্যত প্রমাণ করতেই কি নিরীহ মানুষ হত্যা? নইলে কেন মন্দিরের পুরোহিত, দর্জি, শিক্ষক ও লেখকদের হত্যা করা হবে? উনারাতো রাজনীতির ধারেকাছেও নেই। তবে কেন রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় অরাজনৈতিক মানুষের জীবন দান। দেশী, বিদেশী চক্রান্তকারী অপতৎপরতায় আমাদের কোমলমতি কিশোররা বিভ্রান্ত হচ্ছে। ধর্মের নামে অধর্মের অাফিম খাইয়ে এদের মানুষ হত্যায় উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। ইসলামী লেবাস ও ইসলামের মানবিক শান্তিময় বৈশিষ্ট্যকে নষ্ট করতেই ইসলাম বিরোধীদের এসব দূরভিসন্ধি নয় কি? আল্লাহু আকবার বলে আল্লাহর বান্দাকে কুপিয়ে হত্যা করা কি আল্লাহকে ব্যঙ্গ করা নয়? এসব জঙ্গিবাদের পৃষ্টপোষকদের সাথে ইহুদিদের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের বৈঠকের কথাও শুনা যায়।
সোজাকথায় বলা যায় বাংলাদেশ যেন দেশী বিদেশী চক্রান্তকারীদের লীলাভূমিতে পরিণত হয়ে উঠছে। শেখ হাসিনার শাসনকালকে একটা ব্যর্থতার খোলসে ঢেকে বঙ্গবন্ধুর মতো বঙ্গবন্ধু কন্যাকেও হয়তো ফেলে দেয়ার চেষ্টা করছে। যে শেখ মুজিবের ডাকে সাড়া দিয়ে তিরিশ লাখ মানুষ জীবন দিলো, দুই লাখ নারী সম্ভ্রম হারালো। সেই মুজিবের মৃত্যুতে একশত লোকও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তার জানাযায় আসতে পারলো না। নেতার শেষ বিদায়ে কেউ একজন একটি নতুন কাফনের কাপড় নিয়ে আসতে পারলোনা এতেই বুঝা যায় চক্রান্তকারীরা কতো গভীরে কাজ করেছে। তারা সকল মানুষকে ভয় পাইয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা নষ্ট হওয়া বেগম খালেদা জিয়ার জন্যও ভালো হবেনা। তাই বলি কি দেশীয় চেতনায় তিনিও নড়ে উঠে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কর্মসূচি দিতে পারেন। এতে তার রাজপথ হারা হয়ে ওঠাও কাটবে। অপরাপর দলগুলোর বেলাতেও এই কথা প্রযোজ্য হওয়া উচিত যারা জাতীয় ঐক্যের আহবান জানাচ্ছেন। দেশের মানুষ আহবান নয়, কর্মসূচির ঐক্য চায়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)