দেশে এখন একদল ফেসবুক-যোদ্ধার জন্ম হয়েছে। যাদের কাজ এর-ওর-তার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া। কোনো একটা ছুতো পেলেই হলো। অমনি আক্রমণ!
যত অশালীন শব্দ ব্যবহার করা যায়। যত নোংরা উপমা, কুযুক্তি, অবান্তর সব তথ্যপ্রমাণ দেওয়া যায়। কেউ প্রশ্ন করবে না। কেউ খারাপ বলবে না। বরং অনেকেই সহমত জানাবে! লাভ ইমো দেবে। ফেসবুক আমাদের অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু দিয়েছে কাউকে খুঁচিয়ে-কুচিয়ে-কচলিয়ে রক্তাক্ত করবার মহান সুযোগ!
এই সুযোগ পেয়ে আমরা প্রত্যেকেই যেন একেকজন দিগ্বিজয়ী বীর হনুমান! এই ‘যোদ্ধা’দের আক্রমণের লক্ষ্য হতে পারে যে-কেউ। তবে নারী হলে জমে ভালো। আর যদি শোবিজের কেউ হয়, তবে তো আরও ভালো। আদিরস মিশিয়ে নিজেদের যাবতীয় বিকৃতির প্রকাশ ঘটাতে সুবিধে হয়।
কিছু কিছু ইতর প্রাণীর যেমন কামড়ানোর সময় বিষাক্ত লালা ঝরে, ঠিক তেমনি এই নব্য ‘ফেসবুক-যোদ্ধা’দের শব্দ এবং বাক্যে এক ধরনের বঞ্চনাজনিত রোষের বিষাক্ত লালা নিঃসৃত হয়। এই লালার বিষে সেই ব্যক্তি জর্জরিত হয়! এতেই এই ‘ফেসবুক-পোকা’দের আনন্দ!
আগে আমাদের মেনু ছিল ভাত আর গরম মাংসের ঝোল, এখন সেই ঝোলের জায়গা নিয়েছে ট্রল। সেও এক রকম রান্না, ফাঁকা সময়ে আয়েস করে, অল্প আঁচে সেঁকে সেঁকে কাউকে না কাউকে একেবারে ছিবড়ে করে দেওয়ার নিপুণ রেসিপি। এর মজাই আলাদা, এর স্বাদ অনন্য। ইচ্ছে মতো মাংস চাইলে কিনে আনা যাচ্ছে বাজার থেকে, টাটকা মাছের পসরাও তো সাজানো হাতের কাছেই।
বহু যুগ ধরে এ সব খেতে খেতে এখন আমাদের মুখে অরুচি ধরে গেছে। যা সহজলভ্য, তাকে বারবার জয় করে আনায় সেই মজা কোথায়? বরং যা দূর, যা অনতিগম্য, যা স্পর্শাতীত, তা যদি কোনওক্রমে আওতার মধ্যে, নাগালের ভেতরে চলে আসে, তবে হয়ে ওঠে বড়ই আকর্ষণীয়, তার জন্য সারাক্ষণ হাত নিশপিশ লেগেই থাকে। সুতরাং, ঝোলের বদলে ট্রলেই হাতের সুখ বেশি, এ আমরা বিলক্ষণ বুঝে গিয়েছি।
এখন এই ‘নাগাল’ ব্যাপারটাই হয়েছে ভারী গোলমেলে। যে-মানুষটা সিনেমা বানায় বা যে-মানুষটা উপন্যাস লেখে, যে অভিনয় করে বা যে-মানুষটা গান গায়, আজ থেকে বছর দশেক আগেও তার দিকে আমাকে তাকিয়ে থাকতে হতো একটু দূর থেকে। যখন সে পর্দার ওপারে, বা মঞ্চের ওপরে, তখন।
তার কাজ খারাপ লাগলে তাকে জানানোর কোনও উপায় আমাদের কাছে ছিল না। এখন আছে। সে ঠিক কোথাও না কোথাও আমার টেবিলেই পাত পেড়ে খেতে বসেছে। সোশ্যাল মিডিয়ার এই বিরাট নাগরদোলার দূরতম চেয়ারে বসে হলেও, সে ঘূর্ণিপাক খাচ্ছে আমারই সঙ্গে, একই আবর্তে। অতএব, দূর হলেও, কিছুটা নাগাল কিন্তু এসেছে।
অতএব, খারাপ লাগার কথা তাকে জানানোই যায়। এবং, অনেকে আমরা জানাইও। আপনার অমুক নাটকটা ততখানি দাগ কাটল না, কিংবা, এ বারের ঈদসংখ্যার উপন্যাসে আর একটু বেশি আশা করেছিলাম আপনার কাছ থেকে – এ রকমটা আমরা বলে থাকি। কিন্তু সেই ‘আমরা’ সংখ্যায় কত শতাংশ?
বেশির ভাগই কিন্তু, এই ‘নাগাল’কে একখানা ‘লাইসেন্স’ ভেবে নিয়েছি, তাকে যা খুশি তাই বলবার। অর্থাৎ, ট্রল করবার। অনেক ক্ষেত্রেই তা অকারণ। তার কোনও একটা লেখায় বানান ভুল পেয়েছি, বা কোনো বাক্য আমার পছন্দ হয়নি, দিলাম দু’চারটে রগরগে কথা কমেন্ট বক্সে।
অমুকের বাচ্চা, তমুকের পোলা, কিছুই বাকি রইল না! সকলে দেখল, বাঘের বাচ্চা কেমন থাবা শানিয়েছে। সেলিব্রিটির মুখে নখের দাগ কেমন দগদগে। এটা আমি শুক্রবার দুপুরে মুরগীর মাংসের ঝোল ফেলে রেখে করলাম। ট্রলে যে-আনন্দ, ঝোলে তা কোথায়? পুরাতন কালে রাজারা মৃগয়ায় যেত, আমরা ফেসবুকে যাই। তাদের ছিল বন্দুক আর বর্শা, আমাদের আছে টানটান কি-বোর্ড আর নোংরা রুচিহীন ধারালো শব্দ। বিঁধবেই।
কারও একটা আচরণ খারাপ লেগেছে, এলাম তার চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করে দিয়ে। এই অধিকার আমি অর্জন করেছি, সোশ্যাল মিডিয়ার সংবিধান আমাকে এই অধিকার দিয়ে রেখেছে। একা হয়ে গেলাম না কিন্তু এটা করতে গিয়ে। বরং দেখলাম, এ গলি সে গলি থেকে পিলপিল করে আমারই মতো লোকজন বেরিয়ে আসছে কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি নিয়ে, মুখ খারাপ করতে করতে। ব্লক করবি? কর! অন্য প্রোফাইল থেকে লিখব।
কী করবি তুই আমার? কিচ্ছু করতে পারবি না। বরং আমি তোকে খারাপ বলতে বলতে, পিং করতে করতে, ট্রল দিতে দিতে এমন জায়গায় নিয়ে যাব, যেখানে এ জীবন অসহনীয় মনে হবে।
দল বেঁধে এই শিকারে বেরিয়ে পড়ার মধ্যে যে আনন্দ, মানুষ আজও তার পাশে অন্য কোনও বিনোদনকে নম্বর দেয় না। তাই ট্রলিং ব্যাপারটাই এখন সেলিব্রিটি।
এই বিঁধে ফেলে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ারই চরম উদযাপন আজ। ওঁত পেতে থাকো। দু’ঘণ্টা, তিন দিন, চার সপ্তাহ, বারো মাস। কখন, কোথায়, সে কী বলছে বা লিখছে। হতে পারে তা বরফ পড়া নিয়ে, হতে পারে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে, হতে পারে নিজের বাড়ির আড্ডা নিয়ে, বা হতে পারে নেহাতই খুচরো কিছু বিষয় নিয়ে। কিন্তু তুমি ছেড়ে দিও না। এই যে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে ছিলে অন্ধকারে, তার সুদে আসলে আনন্দ উসুল করে নাও।
ঝাঁপিয়ে পড়ো। বিষয় যাই হোক, ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দাও তাকে। মাথাগরম করে একটা খারাপ কাজ করেছিল, চার বছর আগে তোমার অপছন্দের একটা নাটকে অভিনয় করেছিল না? বা মাস সাতেক আগে তোমার ভাবাবেগে আঘাত দিয়ে একটা লেখা লিখেছিল তো? তার শোধ তুলে নিতে হবে না? এখানে সিকিওরিটি নেই, রাষ্ট্র নেই, আদালত নেই, এমনকি তোমার আত্মীয় স্বজনরাও নেই। অতএব, দাঁত নখ চালিয়ে দিতে দেরি কিসের?
দেরি নেই। দেরি নেই আর সেই দিনের, যে দিন সুস্থ আলোচনা, আদান প্রদান, সমালোচনার পরিসরকে ভুলে গিয়ে, আমরা এক অন্ধকার জঙ্গলের বাসিন্দা হয়ে থাকব। আর সেই অন্ধকারের মধ্যে, জ্বলজ্বল করবে দুটো চোখ। আমাদের হিংসার। ট্রলিং-এর। কাজেই আর দেরী কেন?
আসুন, আমরা আমাদের ল্যাবটপ, পিসি, মোবাইল, ট্যাব নিয়ে এখনই ঝাঁপিয়ে পড়ি। কেবলই ট্রল করি। আমার-আপনার পছন্দের নয়—এমন সবাইকে টার্গেট করে!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)