ভারতীয় সংসদে বিজেপি অধ্যক্ষ অমিত শাহ যে কথাটা বলেছেন সেটা কোনো ন্যায্য কথা নয়। মঙ্গলবার লোকসভায় তিনি বলেছেন, এনআরসি বিরোধীরা বাংলাদেশি ‘অনুপ্রবেশকারী’দের বাঁচাতে চাইছে।
হ্যাঁ, খুবই স্পষ্ট ও স্বাভাবিক যে কংগ্রেস, তৃণমূল এবং সমাজবাদী পার্টি রাষ্ট্রীয় নাগরিকপঞ্জী তথা এনআরসির বিরোধিতা করছে। বিরোধিতা করে তারা যদি অনুপ্রবেশকারীদের বাঁচাতে চায়, তাহলে তো তারা ভালো কাজটাই করতে চাইছে। এমনকি এই বাঁচানোর প্রক্রিয়ায় সামিল হয়েছে সুপ্রিম কোর্টও। সর্বোচ্চ আদালত বলেছে, খসড়া নাগরিকপঞ্জির ভিত্তিতে কারো বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না। আপনি কি তাঁদের মারতে চাইছেন অমিত শাহ?
ভারতীয় রেজিস্ট্রার জেনারেল অ্যান্ড সেনসাস কমিশনার শৈলেশ সোমবার (৩০ জুলাই) সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে আসামের নাগরিকদের জন্য রাষ্ট্রীয় নাগরিকপঞ্জী প্রকাশ করেন। রাষ্ট্রীয় নাগরিকপঞ্জী থেকে নাম বাদ পড়েছে আসামে বসবাসকারী ৪০ লাখ ৭ হাজার বাঙালি ও বিহারির।
তিন বছর ধরে ৫০ হাজার কর্মীর পরিশ্রমে হাজার কোটি টাকা খরচ করে প্রণয়ন করা হয়েছে এই নাগরিকপঞ্জী। ১৯৫১ সালের পর ভারত তাদের নাগরিকের হিসাব-নিকাশ করার এই ধরনের উদ্যোগ নিল। তবে তা শুধু আসামে। ১৯৮০ সাল থেকে তারা এই নাগরিকপঞ্জি করার চেষ্টা চালাচ্ছিল। সেই দিক থেকে ভারতীয় জনগোষ্ঠীর এক বৃহৎ অংশ এটিকে গত ৩৮ বছরের মধ্যে এক বিশাল অর্জন হিসেবে দেখছে এবং উল্লাস করছে।
১৯৮৫ সালে রাজিব গান্ধী সরকারের সঙ্গে আসাম আন্দোলনের ছাত্রদের এ বিষয়ে আসাম-চুক্তি নামে চুক্তিও হয়েছিল। সেই দিক থেকে অসমিয়াদের জন্য এটি বিরাট আনন্দের বিষয়ও। ৪০ লাখ মানুষের কান্নায় ভাসিয়ে, আতঙ্কিত করে তাদের এই আনন্দ। এই আনন্দ-উল্লাস লোকসভা এবং রাজ্যসভায়ও দৃশ্যমান। রাষ্ট্রীয় নাগরিকপঞ্জীর বিরোধীকারী দলগুলোর বিতর্কের মুখে সোমবার ও মঙ্গলবার (৩১ জুলাই) ভারতীয় সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশনের দিনের কর্মসূচি কয়েক দফা মূলতবি রাখতে হয়েছে।
নাগরিকপঞ্জিতে নিবন্ধনের মূল শর্তই ঠিক করা হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার দিনটিকে লক্ষ্য করে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। এর আগের দুদিনের পরিস্থিতি সবারই জানা। ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে যারা ভারতে অবস্থান ও বসবাসের স্বপক্ষে প্রমাণ দেখাতে পেরেছেন তারাই ভারতের আসামের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন।
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমদের ভাই আতাহারউদ্দিন আলি আহমদ ও নাতি রফিকুল ইসলামের নামও নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ পড়েছে। এমনও দেখা গেছে, ভারতীয় সেনাবাহিনীতে তিরিশ বছর চাকরি করার পর অবসরে যাওয়া আজমল হক নাগরিকপঞ্জিতে অন্তর্ভুক্ত হননি। ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে ভারতের বাসিন্দা হওয়া নাগরিকপঞ্জিতে নাম অন্তর্ভুক্তির শর্ত হলেও যারা বাদ পড়েছেন তাদের মধ্যে নাম দেখে বোঝা যায় পঞ্জি প্রণয়ণে নিয়োজিতদের মাইন্ডসেটই ছিল বাঙালি মুসলিমদের বাদ দেওয়া।
চার কোটি মানুষের আসামে অপেক্ষাকৃত দুরবস্থায় থাকা বাঙালি মুসলিমদের অবাধ জন্মদানের বিষয়টিই বাঙালি বিরোধীদের মূল দুশ্চিন্তা। এই জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যা অসমিয়াদের চেয়ে বেশি হয়ে যাবে- এই আতঙ্ক ও আশঙ্কা বিভিন্ন সময়ে আসামের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও প্রকাশ করেছেন। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় জলে ভাসা উদ্বাস্তু মানুষের বসবাসের প্রমাণ দাখিল করা এমনিতেই কঠিন। তারা বন্যার কারণে ছয় মাস নিজেদের ঘরবাড়িতেই থাকতে পারে না।
নাগরিকপঞ্জির একটা পরিহাস হচ্ছে, যে ব্যক্তি ভারতে পঞ্চাশ বছর জীবনযাপন করে মরে গেছেন তিনি আসলে বেঁচে গেছেন। আর যে ব্যক্তি পঞ্চাশ বছরের চেয়ে বেশি আয়ু পেয়ে বেঁচে আছেন তিনি আসলে মরেছেন। নাগরিকপঞ্জীর চিপা ও চাপে পড়েছেন আসলে তিনিই।
একটি দেশে পঞ্চাশ বছর ধরে বসবাস করা কোনো লোক এবং তার স্ত্রী-সন্তান-নাতি-নাতনিকে রাতারাতি নিজ দেশে শরণার্থী বানিয়ে দেওয়া ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকারের শুধু আগামী নির্বাচনের ভোটের স্বার্থ নয়। ভারতীয় নির্বাচন কমিশন অবশ্য বলে দিয়েছে, গত জানুয়ারিতে প্রণীত ভোটার তালিকায় নাম থাকলেও নাগরিকপঞ্জীতে যাদের নাম নেই তারা আগামী নির্বাচনে ভোট দিতে পারবে না। নরেন্দ্র মোদি অসমিয়া জাতীয়তাবাদী ও হিন্দুত্ববাদীদের খুশি করে আগামী নির্বাচনে সুবিধা আদায় করতে চাচ্ছেন ব্যাপারটাকে এত সামান্য মনে হয় না।
এরজন্য তিনি নাগরিকপঞ্জী প্রণয়নে সুপ্রিম কোর্টের ন্যায্যতা বিধান নিশ্চিত করা এবং রাষ্ট্রের হাজার কোটি টাকা খরচ করেননি। বিপুল এই জনগোষ্ঠীর জন্য বিশাল শরণার্থী শিবির নির্মাণের চিন্তাও ভারতের রয়েছে। সেখানেও আছে আরো হাজার কোটি টাকা খরচের ব্যাপার।
অনুপ্রবেশ ইস্যু শুধু ভারতের আসাম রাজ্য নয়, অন্যান্য রাজ্যের ক্ষেত্রেও বিবেচ্য। সেসব রাজ্যে এই ধরনের পদক্ষেপের কথা ভারত সরকার গত ৩৮ বছরেও ভাবেনি। সেনাবাহিনীতে চাকরি করে অবসরে যাওয়ার পরও যে লোকের নাগরিকত্ব নেই সে লোকের পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপুল দেবকে দাঁড় করালে ভারত সরকার কী বলবেন? বিপ্লব দেব অবশ্য বলেছেন, ত্রিপুরায় এমনটি হবে না। কিন্তু, ইনডিজেনাস ন্যাশনালিস্ট পার্টি অব ত্রিপুরা (আইএনপিটি) দাবি তুলেছে সেখানেও এই ধরনের নাগরিকপঞ্জি প্রণয়নের।
ভারতের সরকারবিরোধী কেন্দ্রীয় ও রাজ্যীয় রাজনৈতিক দলগুলো আগামী নির্বাচনের ভোটের হিসাবকেই দেখবে। পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জি সরকার অবশ্য আরো একটু বেশি দেখছেন। তার রাজ্যে বিপুল এই জনগোষ্ঠীর চাপ পড়তে পারে, সেজন্য তিনি এই ইস্যুতে সোচ্চার। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে দেখা করে তিনি গৃহযুদ্ধের আশংকা প্রকাশ করেছেন। এদিকে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি প্রধান দিলিপ ঘোষ বলেছেন, রাজ্যে এক কোটির মতো অনুপ্রবেশকারী রয়েছে। সেখানেও নাগরিকপঞ্জি করতে হবে। মমতা যে ভীষণ রক্তারক্তির আশংকা দেখছেন তা যে অমূলক নয় তা রাজ্য বিজেপির কর্তাব্যক্তির কথায়ই স্পষ্ট।
সারা বিশ্বে এখন প্রায় এক কোটি লোক দেশহীন। দেশহীন মানুষের এক বিশাল ভার বাংলাদেশ বহন করছে। ভারতকেও এক সময় এই দেশহীন মানুষের চাপ সইতে হয়েছে। ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট ইদি আমিন ৮০ ভারতীয়কে ৯০ দিনের মধ্যে উগান্ডা ছাড়তে নির্দেশ দিয়েছিলেন। শ্রীলঙ্কায় বসবাসকারী ৫ লাখ তামিলের নাগরিকত্বের প্রশ্নে তিন দশক ধরে ভারতের সঙ্গে দর ও মন কষাকষি আছে। দেশভাগের পর এমনকি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে-পরেও অনেকে আসাম থেকে বাংলাদেশে এসেছেন। সেই হিসাব নিলে তা সংখ্যায় একেবারে কমও হবে না।
আসামে নাগরিকপঞ্জি প্রকাশের পর তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, আসামের নাগরিকপঞ্জিতে নাম থাকা লোকজন বাংলাদেশি নয়। ১৯৭১ সালে শরণার্থী হিসেবে যারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল, সেটা ভারতের সাথে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই হয়েছিল। তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে বাংলাদেশের অবস্থান কিছুটা হলেও স্পষ্ট হয়েছে। এর আগে কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীও বলেছিলেন, আসামের নাগরিকপঞ্জির বিষয়টি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
ভারতের রাষ্ট্রীয় নাগরিকপঞ্জি ইস্যুটি আপাত দৃষ্টিতে যত না বাংলাদেশের জন্য বিপদ ও উদ্বেগের তার চেয়ে বেশি বিপদ ও উদ্বেগ তাদের নিজেদের জন্যই। তারপরও, ভারতের অভ্যন্তরে নাগরিকপঞ্জি নিয়ে যে বিপুল চর্চা হচ্ছে তাতে বাংলাদেশকে এই বিষয়টি আরো গভীরে গিয়ে দেখা দরকার। ছিটমহল ইস্যুতে ভারতের যে সরকার দীর্ঘদিনের সমস্যা সমাধানে উদারতার পরিচয় দিয়েছে, তারাই কেন নতুন করে রোহিঙ্গা সমস্যার মতো একটি বিরাট সমস্যাকে সামনে নিয়ে এসেছে, সেটি বাংলাদেশকে গভীরভাবে এবং সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
শেখ হাসিনা সরকারের সবচেয়ে বড় মিত্র প্রতিবেশী ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকার বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে কী বিপদ ও বিস্ফোরক তৈরি করছে তা তলিয়ে দেখার বিষয়। অবশ্যই শেখ হাসিনা সরকারের জন্য এটি বিরাট এক চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। অনুপ্রবেশকারী সনাক্ত হওয়ার পরপরই আসামের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল কুমার মোহন্ত দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে প্রত্যার্পণ চুক্তির।
আমরা ধরেই নিচ্ছি, রাজনাথ সিংসহ অন্য যারা বলছেন যে এসব লোককে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে না, তাদের কথা ঠিক। যদিও আসাম ও কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের অনেকেই দৃঢ়ভাবে বলছেন তাদের ফেরত পাঠানোর কথা। ফেরত না পাঠালেও বাংলাদেশের জন্য এই ইস্যুও চ্যালেঞ্জ ছোট হয়ে যায় না।
কারণ, ইস্যুটির সঙ্গে শুরু থেকেই বাংলাদেশের নাম, সম্ভ্রম ও সার্বভৌমত্বের গরিমা জড়িয়ে আছে। এই ইস্যুতে বারবার বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশেরও কূটনৈতিক প্রক্রিয়া, পর্যবেক্ষণ ও প্রতিক্রিয়া আরো জোরদার থাকা জরুরি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)