চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

আশরাফুলের মুক্তি ও বাস্তবতা

বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) ম্যাচ পাতানোর জেরে পাঁচ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে দূরে ছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল। সোমবার এই ক্রিকেটারের উপর থেকে উঠে যাচ্ছে নিষেধাজ্ঞা।  ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলতে পারবেন। বিবেচিত হতে পারবেন জাতীয় দলের জন্যেও।

এই মুক্তির পর চারদিকে এখন একটি প্রশ্নই উচ্চারিত হচ্ছে, আশরাফুলকে কি আবার দেখা যাবে বাংলাদেশের জার্সি গায়ে মাঠে নামতে? দেশের প্রথম ক্রিকেট সুপারস্টারের জাতীয় দলে ফেরার প্রশ্নে বাস্তবতা তুলে ধরছে চ্যানেল আই অনলাইন।

২০১৩ বিপিএলে ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকায় ২০১৪ সালে তিন বছরের স্থগিত নিষেধাজ্ঞাসহ মোট ৮ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল আশরাফুলকে।  আপিলের পর সেই শাস্তি কমে হয় ২ বছরের স্থগিতসহ ৫ বছরের নিষেধাজ্ঞা। তিন বছরের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ২০১৬ সালের আগস্টে ঘরোয়া ক্রিকেটে ফেরার সুযোগ পান টেস্ট ক্রিকেটে এক সময়ের সর্বকনিষ্ঠ সেঞ্চুরিয়ান। তবে স্থগিত নিষেধাজ্ঞার সময়টুকুতেও নিষিদ্ধ ছিলেন ফ্র্যাঞ্চাইজি ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে।  সোমবার থেকে খেলতে পারবেন সব ধরনের ক্রিকেটই।

নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি মিললেও জাতীয় দলে ফেরার রাস্তা তৈরি করতে বেশ কিছু শর্তপূরণ করতে হবে ‘নন্দিত ও নিন্দিত’ আশরাফুলকে। করতে হবে অসাধারণ পারফরম্যান্স। ৫ বছর আগের বাংলাদেশ দল আর বর্তমান বাংলাদেশ দলের মাঝে অনেক ব্যবধান। সে সময় সাফল্য আসত কালেভদ্রে। এখন জয়কে অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছে দল। সেই জায়গা থেকে ৩৪ বছর বয়সী আশরাফুলের জন্য পরিস্থিতি কঠিন হওয়াই স্বাভাবিক। বয়স, ফিটনেসের ব্যাপার তো থাকছেই। সঙ্গে ইমেজ ফেরানোর চ্যালেঞ্জও থাকছে আশরাফুলের সামনে।

প্রধান নির্বাচক কী ভাবছেন?
জাতীয় দলের প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নু মনে করেন বয়স বাধা নয়। তবে আশরাফুলের ফেরার প্রশ্নে তার প্রধান শর্ত পারফরম্যান্স। ব্যাট হাতে বিশেষ কিছু করতে পারলেই কেবল বন্ধ দরজা খুলতে পারে এই আশরাফুলের।

‘সে অনেকদিন ধরেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেই। সুতরাং ঘরোয়া ক্রিকেটে সব ফরম্যাটে তাকে খেলতে হবে। তার ফিটনেস আন্তর্জাতিক পর্যায়ের জন্য ঠিক আছে কিনা, সেটা দেখতে হবে। নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর ঘরোয়া ক্রিকেটে সব ফরম্যাটে খেলুক, তারপর এক বছর যাওয়ার পর বুঝতে পারব তার ফিটনেস কোন লেভেলে আছে। দেখতে হবে, তাকে কোন ফরম্যাটের জন্য আমরা চিন্তা করব। আমরা এখন তেমন কোনো চিন্তা করছি না। তারপরও সামনে ঘরোয়া মৌসুমটা আমরা দেখব, তারপর চিন্তা করব। বয়স কোনো বিষয় না। আপনার যদি ফিটনেস আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মানের হয় তাহলে যে কোনো খেলোয়াড়ই আসতে পারে। আমি বলব সে আমাদের দেশের জন্য অনেক ভালো ক্রিকেট খেলেছে। তার তো অবশ্যই সামর্থ্য আছে। তবে আমরা এই মুহূর্তে কিছু বলতে পারছি না। যদি বলতে হয় তাহলে বলব, এই মুহূর্তে দলে কোনো জায়গা নেই।’

তার আরো সংযোজন, ‘আমাদের যে ফিটনেস লেভেল আছে, এইচপি থেকে শুরু করে ‘এ’ দল ও জাতীয় দলের ফিটনেস অনুশীলনের সাথে কিন্তু সে সম্পৃক্ত না। এই জায়গায় আসতে হলে তাকে কিছু সময় দিতে হবে। এই লেভেলটা যদি থাকে তাহলে চিন্তা করা যাবে। সুতরাং এই মুহূর্তে আমরা চিন্তা-ভাবনা করছি না। ফিটনেসটা জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের পর্যায়ে আনতে হবে। আর পারফরম্যান্স অন্যদের তুলনায় অনেক ভালো হতে হবে। কারণ সে যে জায়গায় ব্যাট করে সেই জায়গায় অনেক ক্রিকেটার স্থায়ী হয়ে গেছে। জাতীয় দলের জন্য কোনো খেলোয়াড়কে যদি দেখা হয়, তাকে বিশেষ পারফরম্যান্স করেই আসতে হবে।’

‘বিসিবির পলিসি এখানে ভূমিকা রাখবে’
যার মাধ্যমে আশরাফুলের ক্রিকেটে হাতেখড়ি সেই কোচ ওয়াহিদুল গনি মনে করেন এই ব্যাপারে বোর্ডের পলিসি মুখ্য ভূমিকা রাখবে। চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, ‘এখানে দুইটা জিনিস, তাকে (আশরাফুল) নিয়ে বোর্ডের পলিসি কী আছে। তাকে টিমে ঢুকতে হলে প্রচণ্ড ভালো পারফরম্যান্স করে ঢুকতে হবে। সেক্ষেত্রে ফিটনেসের ব্যাপার আছে, পারফরম্যান্সের ব্যাপার নিঃসন্দেহে আছে। এই বাস্তবতা তাকে উপলব্ধি করতে হবে। আমার মনে হয় আশরাফুল ক্রিকেটটা উপভোগ করুক। খেলতে থাকুক ঘুরোয়া ক্রিকেট। এই প্রক্রিয়ায় সে যদি আসতে পারে আসবে। সবচেয়ে বড় যে ব্যাপার, বোর্ডের কী সিদ্ধান্ত এটার উপর সব নির্ভর করছে। আমি তাকে বলেছি ক্রিকেট উপভোগ করতে। অনেক ক্রিকেট খেলেছে, অনেক কিছু দিয়েছে দেশকে। যা পেয়েছে অনেক কিছু। এরপর যদি তার খেলার সুযোগ হয় সেটা ওর জন্য বাড়তি পাওয়া।’

‘ভাগ্যবান আশরাফুল’
আশরাফুল শুরুতেই শাস্তি পেয়েছিলেন আট বছরের। তখন ক্যারিয়ারের শেষ দেখে ফেলেছিলেন অনেকে। পরে কমে শাস্তি ৫ বছর হওয়ায় টিকে থাকে খেলার স্বপ্ন। ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার সুযোগ হয় তিন বছর পরই। তাকে ভাগ্যবান মনে করছেন ওয়াহিদুল গনি। তিনি বলেন, ‘ও তো ঘরোয়া ক্রিকেট খেলছেই। আমার মনে হয় ও অনেক ভাগ্যবান যে এখনো ক্রিকেট খেলছে। যে ঘটনাটা হয়েছে তারপর ও যে ক্রিকেট খেলছে এটা ওর জন্য ভাগ্যের। ও চেষ্টা করে যদি আরো খেলতে পারে। একজন কোচ হিসেবে শুধু আশরাফুল না, যে-ই ক্রিকেট খেলে আমি খুশি থাকি। সে তো চেষ্টা করছে। অফসিজনে প্র্যাকটিস করছে। আবার যাতে ফিরে আসতে পারে সেটা চাইব। তবে তাকে বাস্তবতা বুঝতে হবে। এখন প্রচুর খেলোয়াড় আছে, বোর্ডের সিদ্ধান্তের ব্যাপার আছে। সব কিছু জেনেবুঝেই তাকে খেলতে হবে।’

একটা সুযোগ দেয়া যেতে পারে: রকিবুল
ঘরোয়া ক্রিকেটে যদি ধারাবাহিকভাবে ভালো করতে পারে তাহলে আশরাফুলকে একটা সুযোগ দেয়া যেতে পারে, বলেছেন বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান। ‘পঞ্চপাণ্ডব’দের সঙ্গে যদি আশরাফুল যোগ হতে পারে তবে সেটি বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য ভালো হবে বলেই মনে করেন তিনি।

‘এটা আশাব্যাঞ্জক। তার বিরুদ্ধে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল সেটা উঠে গেছে এবং এটা বলার অপেক্ষা রাখে না তার ক্রিকেট ফুরিয়ে যায়নি। তার প্রমাণ করেছে প্রিমিয়ার লিগে, ৫টা সেঞ্চুরি করেছে। বয়সটা পুরোপুরিই আছে, যদিও ত্রিশের বেশি। বড় চ্যালেঞ্জ তার জন্য। কেননা বাংলাদেশ টিম মোটামুটি সেটেলড হয়েই আছে। একটা-দুইটা জায়গায় হয়নি। এখন যখন ক্রিকেট নিয়ে ভাবি, আমরা কিন্তু বলি সেকেন্ড লাইনআপ কোথায়। আমাদের পাঁচজন সিনিয়র খেলোয়াড়ের পরে বাকিরা কোথায়? আশরাফুল যদি আবার ওইভাবে আসতে পারে। ক্রিকেট বোর্ড, সিলেকশন কমিটি যদি তাকে মনে করে একটা সুযোগ দেয়া উচিত…আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি সে যদি ভালো খেলতে থাকে তাকে আরেকটা সুযোগ দিয়ে চেষ্টা করা যেতে পারে।’

আশরাফুলকে ফেরানোর কারণ হিসেবে তার বক্তব্য, ‘কারণটা হল তার সবকিছুই আছে। অভিজ্ঞতা কমতি নেই। তার ট্র্যাক রেকর্ড ভালো। খেলার মধ্যে আছে। এই বছরটা তার জন্য খুব চ্যালেঞ্জিং হবে। বিপিএলের আগ পর্যন্ত যে টুর্নামেন্টগুলো হবে সেখানে যদি সে খুব ভালো করতে পারে আলোচনায় চলে আসবে, দলভুক্ত হবে কী হবে না।’

দলের মাঝে আস্থা ফেরাতে পারবেন?
স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িয়ে জেল, নিষেধাজ্ঞা শেষ করে মোহাম্মদ আমির ফিরেছেন পাকিস্তান দলে। তবে ফেরার প্রক্রিয়া কঠিন হয়ে গিয়েছিল দলের খেলোয়াড়রা আপত্তি জানানোয়। আশরাফুলও একই চ্যালেঞ্জে পড়তে পারেন। আস্থার প্রশ্নে রকিবুল হাসান বলেন, ‘এটা তো কেটে গেছে অনেকটাই। এই খেলোয়াড়দের সঙ্গে সে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেছে এ বছর। জাতীয় লিগ খেলেছে দুই মৌসুম। আমার মনে হয় না এটা খুব সামনে আসবে সে যদি ভালো খেলতে পারে। ভুল সবাই কমবেশি করে। এই ভুলটা তার করা উচিত হয়নি। সিরিয়াস মিসটেক। তারপরও আমি মনে করি পারফরম্যান্স দিয়ে যদি সে প্রমাণ করতে পারে তাকে ওভাবেই গ্রহণ করে নেবেন টিমমেটরা।

আশরাফুল নিজে কী ভাবছেন?
সান ডে ক্রিকেট খেলতে বর্তমানে লন্ডনে আছেন আশরাফুল। সেখানে ৫০ ওভারের ম্যাচে ১৭৬ রানের একটি ইনিংসও খেলেছেন এই ব্যাটসম্যান। মুঠোফোনে চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘ক্রিকেটে ফিরতেই লন্ডনে আছি। এখানে একটা লিগে খেলছি। জিম করছি। আমার এখন অনেক বেশি ম্যাচ খেলা দরকার। সেপ্টেম্বরে জাতীয় লিগ টার্গেট করছি। ওখানে ভালো করার জন্য চেষ্টা করব। লন্ডন আসার আগে তিন মাস আশিকের (আশরাফুলের বন্ধু ও বাংলাদেশ নারী দলের সাবেক সহকারী কোচ) সঙ্গে আমার এলাকার মাঠে অনেক কাজ করেছি। প্রিমিয়ার লিগে পাঁচটা সেঞ্চুরি করেছি। এখন দেখা যাক সামনে কী হয়? আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে ফেরার। সে মানসিকতা নিয়েই স্বপ্ন দেখছি। দেশের হয়ে আবার খেলতে পারা হবে আমার সবচেয়ে বড় অর্জন।’