বাংলা সংগীতের ভুবনে অমর সুরস্রষ্টা আলতাফ মাহমুদের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেওয়া হলেও; তার কাজ দিনে দিনে আরও মহিমান্বিত হয়ে উঠছে বলে মন্তব্য করেছেন ‘শহীদ আলতাফ মাহমুদ পদক ২০১৬’ এর পদক প্রদান অনুষ্ঠানে আসা আলোচকেরা। তারা বলছেন: আলতাফ মাহমুদের ক্ষেত্রেও যা হয়েছিলো, তা আজ আমাদের মনে রাখতে হবে। ওইরকম কঠিন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে মানুষ কতোটা শক্তি ধারণ করতে পারে, তা আমাদের মনের মধ্যে ধারণ করতে হবে।
আলতাফ মাহমুদের অন্তর্ধান দিবস উপলক্ষে অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারও প্রদান করা হয় শহীদ আলতাফ মাহমুদ পদক। এ বছর এ সম্মানে সম্মানিত হলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
পদক প্রদান অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রাবন্ধিক ও মুক্তিযুদ্ধো গবেষক মফিদুল হক এবং শহীদ জায়া আলতাফ মাহমুদের স্ত্রী সারা আরা মাহমুদ।
মফিদুল হক তার আলোচনায় বলেন: আজ আমরা এমন একটা দিনে এখানে দাঁড়িয়ে আছি, যেদিন একজন যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত করার রায় জাতি পেয়েছে। মীর কাসিম আলীর যে বিচার; কী কারণে তাকে ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে? ১৯-২০ বছরে যুবক জসীম, তাকে আটক করে নৃশংস ভাবে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছিলো। জসীমের আত্মচিৎকারের বর্ণনা কিছু সাক্ষী আদালতে দিয়েছেন। দীর্ঘ নির্যাতনের পর জসীমের লাশ কর্ণফুলী নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। তার লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আলতাফ মাহামুদের ক্ষেত্রেও সেরকমই হয়েছিলো।
তিনি আরও বলেন, ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে ৭১’র মুক্তিযুদ্ধে এই যে দীর্ঘ অভিযাত্রা, এখনকার সময়ে অনেক বেশি মনে হলেও; আমাদের মনে রাখতে হবে স্বাধীনতার পর আমরা আরও বেশি সময় পার করে ফেলেছি। আলতাফ মাহমুদের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেওয়া হলেও, তার কাজ এখনও আমাদের মধ্যে বেঁচে আছে। তার কর্ম তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব এখন আমাদের।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার বক্তব্যে বলেন: আলতাফ মাহামুদ গানের মধ্যদিয়ে সংগ্রাম করেছেন। একাত্তরের শুরুতে তিনি মিছিলে ছিলেন। সমাবেশে সমাবেশে ঘুরে গান করেছেন। যুদ্ধে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন; অর্থ জুগিয়েছেন। তারপর যখন তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো, তার যে অন্তর্ধান ঘটলো সেখানে তাকে নির্মম ভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। আলতাফ মাহমুদ গানের মানুষ ছিলেন। তিনি গানের মধ্যদিয়ে মানুষের মধ্যে জাগরণের বার্তা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আলতাফ মাহমুদ থাকলে যে গান আমরা পেতাম, সেটা এখন আমরা পাচ্ছি না। গানে যেনো এখন আর সেই প্রাণ নেই। গানের সঙ্গে যে প্রাণের সম্পর্ক রয়েছে তা কমে গেছে। আমরা নতুন কথা পাচ্ছি না; সুর পাচ্ছি না।
তিনি আরও বলেন, তিনি গণ-শিল্পী ছিলেন, লোক সঙ্গীতের শিল্পী ছিলেন। তার যে স্বপ্ন ছিলো, তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। তার নিদর্শন এখন চতুর্দিকে। দেশে এখন গুম-খুন; ধর্ষণ-গণধর্ষণ শুরু হয়েছে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নেই। আবার কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে। কথা বলার যে স্বাধীনতা এগুলো নেই। এখন আবার যে নতুন আইন হচ্ছে তাতে করে মুক্তিযুদ্ধের যে ইতিহাস আলতাফ মাহমুদের যে স্বপ্ন, তা এখন বিঘ্নিত হবে। আমরা দেখতে পাচ্ছি স্বাধীনতার পর থেকে ইতিহাসের মূল্য কমছে। আমরা খুব বিপদের মধ্যে আছি; এই বিপদ থেকে উত্তরণের পথ হচ্ছে ওই শহীদদের পথ-মুক্তির পথ যে পথ তারা একাত্তরে আমাদের দেখিয়ে গেছেন। যে বৈপ্লবিক পথের যে আকাঙ্খা সেই পথে এগোনো।
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার সমালোচনা করে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন: আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে সংস্কৃতি চর্চা এক সময় ছিলো তা এখন আর নেই। আমার ভাবতে অবাক লাগছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গত ২৫ বছর ধরে কোন ছাত্র সংসদ নেই। ছাত্র সংসদ না থাকা মানে কোন প্রতিযোগিতা নেই। ছেলে মেয়েদের মধ্যে সুস্থ বিনোদন নেই। খেলাধুলা নেই। এবং ভবিষ্যতের জন্য যে নেতৃত্ব তৈরি করা, সে নেতৃত্ব তৈরি করার সুযোগ নেই। আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে তো ওগুলো নেই-ই। সেখানে বিদ্যা শেখানো হচ্ছে-কৌশল শেখানো হচ্ছে কিন্তু মানবিক বিষয়গুলো শেখানো হচ্ছে না।
শ্রেণী বিভাজনের বিষয়ে সিরাজুল ইসলাম বলেন: শ্রেণী বিভাজন আমাদের খারাপের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যতো উন্নতি ততো বৈষম্য, ইতিহাস তা বলে। তার সঙ্গে তিন ধারার শিক্ষা বিভাজনকে আরও গভীর করছে উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের মাঝে।
অমর সুরস্রষ্টা আলতাফ মাহমুদের স্ত্রী সারা আরা মাহমুদ উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানেন।