আইনজীবী আতাউর রহমান প্রতিদিনকার মত আদালতের কাজে ব্যস্ত। কিন্তু মূহুর্তের মাঝে তার জীবনের সবকিছু শেষ হয়ে যায় আগুনের ভয়াবহতায়। স্ত্রী ফারজানা আর বড় ছেলে শুভকে হারিয়ে তার কান্নার রোল সেদিন কাঁদিয়েছে চট্টগ্রামের মানুষকে। আতাউরের স্ত্রী, সন্তানসহ আরো ৫টি প্রাণ নিভে গেছে মানুষের অসাবধানতা আর বাড়ি ঘর নির্মানে নিয়ম না মানার কারনে।
চট্টগ্রামের পাথরঘাটার গ্যাসের বিস্ফোরণের সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি। তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে সুস্পষ্ট হবে বিষয়টি। কিন্তু প্রশ্ন হলো সারাবছর ধরে কোথাও না কোথাও এমন ঘটনা ঘটছে। প্রতিবারই মানুষের মৃত্যু ঘটে। মৃত ব্যক্তিদের আর্থিক সহায়তা আর তদন্ত থাকে চলমান। আপাত দৃষ্টিতে এটাই হলো অগ্নি দুর্ঘটনার চালচিত্র। পাথরঘাটা মনে করিয়ে দেয় বনানীকে,বনানী মনে করিয়ে দিয়েছিল চুড়িহাট্রা, নিমতলীকে। তবে অবস্থার পরিবর্তন হয়নি।
ফায়ার সার্ভিসের এক তথ্যমতে, গত এক দশকে সারা দেশে ১ লাখ ৬৮ হাজার ১৮টি আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা ঘটে ২০০৯ সালে। ১২ হাজার ১৮২টি। আর সবচেয়ে বেশি ঘটেছে ২০১৮ সালে। ১৯ হাজার ৬৪২টি। তবে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ২০১১ সালে। ওই বছর ১৫ হাজার ৮১৫টি ঘটনায় ৩৬৫ জন মারা গেছেন। দশ বছরে সবচেয়ে বেশি আহত হয়েছেন এই বছর ১ হাজার ৪৭৯ জন। দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যায় দ্বিতীয় স্থানে ২০১০ সাল। ওই বছর ২৭১ জন মারা গেছেন। আগুনে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৪ হাজার ২৮৬ কোটি, ৮৬ লাখ ৬২ হাজার ৭৯৪ টাকা।
ঢাকায় আগুনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ সালে সারা দেশে ১৯ হাজার ৬৪২টি আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৮ হাজার ৪৬১টি ঘটনা আবাসিক ভবনে। এর ২০৮৮টি ঢাকায়, চট্টগ্রামে ২৮৫ ও রাজশাহীতে ১১৬টি। এমন ভয়াবহ অবস্থা অন্তরালের কারণগুলি প্রশাসন ও জনগণের জানা থাকা সত্ত্বেও সচেতনতা নেই কারো।
কোন ঘটনা ঘটলে শোক আহজারির সাথে প্রশ্ন উঠে বিল্ডিং কোড না মানার কথাটি। সাধারণত ঢাকাতে অগ্নিকাণ্ডজনিত দুর্ঘটনা বেশি হয়ে থাকে। তবে সংবাদ মাধ্যমের সূত্রে জানা যায় চট্টগ্রামের ৯৭ ভাগ বহুতল ভবন বিল্ডিং কোড মানে না। ফায়ার সার্ভিসের নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করে এখানেও নির্মান হচ্ছে ঘর বাড়ি।
পাথরঘাটার বাড়িটি ঝুঁকিপূর্ন হিসাবে চিহ্নিত করেছিল ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু সে বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করেনি বলে গ্যাস বিস্ফোরণে দেয়াল ধসে অকালে ঝরে গেলে ৭টি প্রাণ।
বিস্ফোরণের কারণ গ্যাসের লাইনের দুর্বলতা নাকি সেফটি ট্যাংকের জমাট বদ্ধ গ্যাস তা নিয়ে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ দ্বিমত পোষণ করছে। এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের অভিমত হলো , “গ্যাসের রাইজারগুলোকে সব খোলা জায়গায় রাখতে বলা হয়। কারণ রাইজার থেকে সব সময়ই কিছু না কিছু গ্যাস বেরোতে থাকে। তাই খোলা জায়গায় রাখলে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু এক্ষেত্রে রাইজার স্থাপন করা হয়েছে ভবনের একদম ভিতরে। কাজেই সেখানে গ্যাস জমা হয়েছে। দরজা জানালা বন্ধ থাকায় গ্যাস বের হওয়ারও কোনও সুযোগ ছিল না। এর মধ্যেই আবার কেউ চুলা জ্বালাতে গিয়েছিল। সেখান থেকেই এই বিপত্তি।”
এ কথা থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, একটি ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ভবন মালিককে নিজেদের প্রয়োজনে সঠিক পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। পরিতাপের বিষয় এই যে, মানুষ নিজের এক ইঞ্চি জমি ছাড়তে নারাজ। চলাচলের রাস্তাটুকু যেখানে ছাড়তে চায় না, সেখানে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ী যাওয়ার চিন্তা করাটা কল্পনাতীত। তার উপরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের পদক্ষেপকে এড়িয়ে বিপন্ন করে নিজেদের জীবন। একই ভাবে দেখা যায় ব্যক্তিগত বা প্রতিবেশির সাথে বিরোধপূর্ণ মনোভাব নিয়ে দেয়াল ঘেসে নির্মাণ করে বাড়ি। মূলত মানুষের আচরণ ও বৈষয়িক মুনাফার চিন্তাধারা পরিবর্তন করতে না পারলে অগ্নিকাণ্ড, বিল্ডিং ধস বা অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা থেকে মুক্তির পথ পাওয়া দুস্কর হবে।
অন্য দিকে একটি দুর্ঘটনা ঘটলে প্রশাসনের টনক নড়ে। আর সময়ের সাথে সাথে আবার স্তিমিত হয়ে যায় অনিয়েমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ কার্যক্রম। এতে করে অসাধু উপায়ে ইমরাত বন্ধ হয় না। বরং ঝুকিপূর্ণ চিহ্নিত করা ভবন গুলো বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করে না তাদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে। কোন ভবনকে ঝুঁকিপূর্ন চিহ্নিত ভবনের পর তার প্রতিকারের জন্য কঠোর আইন পদক্ষেপ নেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এছাড়া দেশের অগ্নি দুর্ঘটনা কমাতে ফায়ার সার্ভিসের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে প্রতিটি বাড়িতে ও পাড়া-মহল্লায় ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম গড়ে তোলা হলে অগ্নি দুর্ঘটনা কমাতে সাহায্য করবে। কারণ আগুন লাগার সময় কালক্ষেপণ না করে তা যদি নেভানো যায়, সে ক্ষেত্রে আর বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটে না। এ বিষয়টি কার্যকর করতে হলে সামাজিক প্রচেষ্টা থাকাটা জরুরি।
সামাজিক সচেতনতা মানুষের অনেক অনিয়মকে বিনাশ করতে পারে। বাংদেশের সমাজ ব্যবস্থায় নিজেদের সচেতনতাবোধ কম বলেই আতাউর হারায় তার প্রিয়তমা স্ত্রী আর আত্মজ শুভকে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)