আরেফিন স্যার আমার কাছে একজন শুদ্ধতম মানুষের নাম। আমাদের সমাজের কাঠামোটাই ক্রমান্বয়ে সজ্জন মানুষের জন্যে প্রতিকূল হয়ে উঠছে।বিগত কিছুদিন ধরেই একটা বিতর্ক উঠেছে। আরেফিন স্যার থাকবে কি থাকবে না, এটা নিয়ে। বিভিন্ন মানুষ ভিন্ন ভিন্নভাবে তাদের মত প্রকাশ করেছেন।কেউ স্যার এর আবার উপাচার্য হওয়ার পক্ষে আবার কেউ বিপক্ষে। যে কোন মতকেই শ্রদ্ধা করি। আমি স্যারকে নিয়ে লিখছি মনের তাগিদে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিগত এক যুগ ধরে আমার রক্তে মিশে আছে। এখান থেকে তিনটি মাস্টার্স আর একটি অনার্স করার সুবাধে অনেকের চেয়ে আমার একাডেমিক সময় বেশি কেটেছে এই ক্যাম্পাসে। এটা একপ্রকার তাগিদা। আরেকটা বিষয় হচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে জীবনে অনেকবার প্রতিনিধিত্ব করার সু্যোগ পেয়েছি বিভিন্নভাবে। কখনো বিতর্কে কখনো বা অন্যকোন সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দশটি বছর বিতর্ক আন্দোলনে শামিল থাকায় আর মু্হসীন হল ডিবেটিং ক্লাবের সভাপতি এবং ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন অবস্থায় স্যারকে দেখেছি খুব কাছ থেকে। এজন্য আরেকটা তাগিদ কাজ করেছে মনের ভেতর থেকে।
স্যার এর ব্যক্তিত্ব নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। তিনি আমার কাছে একজন পারফেক্ট মানুষ ও শিক্ষক। তাঁর কাছে থাকা প্রতিটি মুহুর্ত আমার কাছে ছিল শিক্ষার। শিক্ষার ছাত্র হওয়ায় শিক্ষা বলতে বুঝেছি আচরণের কাঙ্ক্ষিত বা বাঞ্ছিত পরিবর্তনকে।আর সেই আচরণ বই পুস্তক পাঠ করে পরিবর্তন করা ততোটা সম্ভব নয় যতোটা না দেখে শেখা সম্ভব। আর একজন ছাত্র হিসেবে কাকে দেখে শিখবো তার প্রথম উত্তর হিসেবে আসবে যে কোন শিক্ষকের নাম। আর আমার কাছে আদর্শ হচ্ছেন আরেফিন স্যার। তাঁর যোগ্যতা নিয়ে আমাদের মত ছোট্ট মানুষদের মূল্যায়ন করার ক্ষমতা বা ধৃষ্টতা নেই। আমাদের দেশেই খুব কম মানুষ আছে যারা তাঁকে নিয়ে কথা বলতে পারে।
একজন প্রশাসক হিসেবে তিনি কেমন তার মূল্যায়ন হয়তো আমরা করতে পারি। আর সেখানে অবশ্যই তুলনামুলক বিশ্লেষণ শব্দটি প্রণিধানযোগ্য। প্রথমত, আন্তর্জাতিকভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে মূল্যায়ন করে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ বা অবকাঠামো দিয়ে। যেখানে আরেফিন স্যার এর সময়কালে একদিনের জন্যেও ক্লাস বা পরীক্ষা বন্ধ থাকেনি সেখানে তাকে আমি শতভাগ সফল প্রশাসক বলবো। কেউ যুক্তি দিতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকবে কেন? শুধু একটু ভাবুন কী এক অদ্ভুত আর ভূতুড়ে পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই না আসতে হয়েছে আমাদের রাষ্ট্রের! পেট্রোল বোমা নামক এক নৃশংস শব্দের সাথে ছিল আমাদের প্রতিনিয়ত বসবাস।সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় একদিনের জন্যেও বন্ধ হয়নি। শিক্ষার্থীদেরকেও সেজন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা দেয়া উচিত। আজ থেকে ১৫ বা ২০ বছর আগে বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সঠিক সময়ে কেউ ডিগ্রি নিয়ে বের হয়েছে সেটা ভাবাও অসমীচীন ছিল। অথচ এখন চার বছরের কোর্স চার বছরের মধ্যেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। আর এই যাদুর কাঠির নাম আরেফিন সিদ্দিক।
দ্বিতীয়ত, অবকাঠামো ও তথ্য প্রযুক্তিভিত্তিক শ্রেনীকক্ষ ও পাঠদান শিক্ষাকে অনেক ইন্টারেক্টিভ ও আকর্ষণীয় করে। এই দিকটিতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেছে বিগত ১০ বছরে। যা প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে আরেফিন সিদ্দিকের সাফল্য।
তৃতীয়ত, অনেক বছর ধরে র্যাংকিং এ ৫০০০ এর বাইরে থাকা আমাদের জন্যে ছিল চরম অপমানজনক। বিগত তিনচার বছর ধরে আমরা অনেক উন্নতি করছি সব ধরনের র্যাংকিং এ। এটির সফলতাও স্যার এর। যদিও র্যাংকিংকে অনেকেই কোন উন্নতির সিড়ি বলে মনে করেন না। তারপরও বলে রাখা ভালো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই এখানে শীর্ষে থাকে।
চতুর্থত, ছাত্রদের সহ-শিক্ষাক্রমিক ও সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে বিশ্ববিদ্যালয় এর পরিব্যাপ্তি আগের যে কোন সময়ের চেয়ে ঢের বেশি এই সময়ে।
পঞ্চমত, বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে এমওইউ হয়েছে আকাশচুম্বী পর্যায়ে। এর সুবিধা পাচ্ছে ছাত্র- শিক্ষক সবাই। বাইরের যে কোন রাষ্ট্রীয় বড় অতিথির বাংলাদেশ সফর মানেই তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমন, এই বিষয়টি খুব ঠুনকো না। পরিচিতি ও সংস্কৃতির বিনিময়ের মধ্য দিয়েই আমরা কসমোপলিটান হয়ে উঠি আর আমাদের ক্যাম্পাসের সুনাম ছড়ায় সারা পৃথিবী জুড়ে। বিগত ১০ বছর ধরে বছরান্তে সমাবর্তন, সমাবর্তন বক্তা বা আন্তর্জাতিক সেমিনার গুলোর গুনগত মান দেখলেই আমাদের অগ্রগতির গ্রাফ লক্ষণীয় হবে।
ষষ্ঠত, একজন প্রশাসকের অনেক বড় গুণ হলো, ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্ককে তিনি কিভাবে দেখেন? এই ক্ষেত্রে আরেফিন সিদ্দিক এর বিকল্প শুধুই আরেফিন সিদ্দিক। তা স্যার এর সমালোচকরাও একবাক্যে মেনে নিবেন। সকাল,সন্ধ্যা,রাত; সময় যতোই হউক না কেন আরেফিন সিদ্দিক এই ক্যাম্পাসে যে কোন সাধারণ ছাত্রের সবচেয়ে কাছের অভিভাবক।
আরো হাজারো কারণ বা পয়েন্ট হয়তো লেখা যাবে একজন প্রশাসক হিসেবে তার সাফল্য নিয়ে। আর যারা তাঁর সমালোচনা করেন তারা যে কয়টি দিকের অবতারণা করেন তার মধ্যে অন্যতম হলো: তিনি আওয়ামী লীগ প্যানেলের শিক্ষক। আমার উত্তর : আরে ভাই আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আপনারা কী তাঁর স্থলে জামাত বা বিএনপিপন্থী কোন শিক্ষককে আশা করেন? নাকি এই দলেরই অন্য কাউকে আশা করেন? আর কিভাবে আশ্বস্ত হলেন এই জায়গায় অন্যকেউ আসলে রাজনীতির ছিটেফোঁটা থাকবে না।
তিনি নাকি অনেক শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন অবৈধভাবে! কই লিস্টতো অনেকেই করেছেন, কয়জন পেয়েছেন এরকম। আসলে আমরা হুজুগেই মাতি,কথাও বলি হুজুগে। অনেকে বলেন অনেক গুলো নতুন বিভাগ খোলা হয়েছে শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার জন্যে। খুব হাস্যকর যুক্তি। এমন একটা বিভাগের নাম বলুন যেটি বর্তমান সময়ের চাহিদাকে পূরণ করেনা। জানি পারবেন না। কেউ কেউ যুক্তি দেন তিনি চাইলেই ডাকসুর নির্বাচন দিতে পারতেন, তিনি পারতেন সিন্ডিকেটে ছাত্র প্রতিনিধি নিশ্চিত করতে! কই বিগত ত্রিশ বছরেতো সাধারণ শিক্ষার্থীরা এগুলোর অস্তিত্ব দেখে নাই। কেন দেখে নাই বলতে পারেন? অবশ্যই পারেন বলতে। এর উত্তর আমি আপনি সবাই জানি। রাজনৈতিক এই বিষয়গুলো এখন অন্যপ্রান্তের খেলায় পরিণত হয়ে গিয়েছে, এটা সত্য বলেই মানতে হবে। তবে এর উত্তরণ অবশ্যই কাম্য। তাই বলে আরেফিন স্যারকে সরে যেতে হবে এটা যুক্তি নয় বরং ফেলাসি।
আরেকটা কথা আসে অর্থনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে যা খুবই হাস্যকর একজন আরেফিন সিদ্দিকের মত ব্যক্তিত্বের কাছে। যিনি তার ভাতাদি বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে দান করেন, এতোদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদে থেকেও সবচেয়ে কমদামী গাড়ি তিনিই ব্যবহার করতেন। আর আমরা যারা তাঁকে অনেক কাছ থেকে অনেকদিন ধরে চিনি জানি তারা জানি তার সাদামাটা আর নির্মোহ জীবন সম্পর্কে। কেউ কেউ বলেন তিনি যদি সফল নেতা হয়ে থাকেন তাহলে তাঁর উচিত হবে এতোবছর ক্ষমতা আঁকড়ে না ধরে নতুন নেতৃত্বের হাতে দেয়া। হ্যাঁ ভাল কথা। কিন্তু সমস্যা কোথায় হবে জানেন? যে জায়গাটুকুকে শুধু একর বা হেক্টর দিয়ে মাপা সম্ভব না, যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে শুধু একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা উচিত না, যে বিশ্ববিদ্যালয়কে শুধু একটি লেখাপড়ার বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে দেখা সঠিক জাজমেন্ট নয় সেখানে রাস্ট্রের প্রয়োজন অনুযায়ী যে কোন কঠিন সিদ্ধান্তে অটল থাকা উচিত। আর সেখানে তাঁর প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে অনুপস্থিতি অনেক বড় ক্ষতির কারনও হয়ে যেতে পারে।
আমার মনে হয় স্যার এমন একজন মানুষ যিনি ক্ষমতালিপ্সু নন। সারা জীবন তিনি এর বাইরেই ছিলেন। সময় হলে তিনি নিজেই সরে যাবেন। সে সময় এখনো আসেনি। সময় এখন তাঁকে আরো শ্রদ্ধার আসনে রাখার। যিনি হবেন কঠিন পরিস্থিতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্রানকর্তা হিসেবে রক্ষাকারীর ভূমিকা পালনকারী। তার বিকল্প খোঁজার সময় এখনো আসেনি। এটি সম্পূর্ণই আমার মত।
আরেফিন স্যার আপনাকে আমরা ভালোবাসি। আপনার ব্যক্তিত্ব আমাদের মুগ্ধ করে। আপনাকে দেখলে আমাদের সাহস বাড়ে। একজন প্রগতিশীল মানু্ষ হিসেবে আপনি আমাদের অনুকরণীয় ও আইকনিক মানুষ। আপনার অনেক সমালোচক কারণ এই সমাজ এখনো অনেক অপ্রতিশ্রুতিশীল, অজ্ঞানী, অকৃতজ্ঞ, বিশ্লেষণীক্ষমতাহীন, অযৌক্তিক, লোভী ও হুজুগি সমাজ। এই সমাজে সমালোচনা তার নামেই হয় যে কাজ করে। আর সাধু থাকে যারা এর বিপরীত। আপনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে শিক্ষার্থী বান্ধব, জনপ্রিয় শিক্ষক ও উপাচার্য। আপনাকে অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেছে যা আমাদের সবার জন্যেই লজ্জার। প্রতিবাদ বা যুক্তির ভাষা এরকম হতে পারেনা। যুক্তি বিরাজ করুক সর্বত্র।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)