অপরাধী না হয়েও ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হিসেবে প্রায় পাঁচ বছর ধরে কারাগারে থাকা বেনারসি কারিগর মো. আরমানকে ২০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হাইকোর্টের দেয়া রায় স্থগিত করা হয়েছে।
হাইকোর্টের রায়ের এই অংশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনে শুনানি নিয়ে মঙ্গলবার চেম্বার বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান ২০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ আদেশ ৮ সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেছেন।
আজকের এই আদেশের ফলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে আরমান আপাতত ২০ লাখ টাকা পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী।
আদালতে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাশ গুপ্ত। আর রিটকারী পক্ষে ছিলেন আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল।
এর আগে গত ৩১ ডিসেম্বর বিচারপতি মো.মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মহি উদ্দিন শামীমের ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ কারাগারে থাকা আরমানকে মুক্তির নির্দেশ দিয়ে তাকে ২০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে রায় দেন।
পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজি) ৩০ দিনের মধ্যে ক্ষতিপূরণের এই টাকা পরিশোধ করে ১৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়। এছাড়া আরমানকে গ্রেপ্তার ও তার জেল জীবনের জন্য চার পুলিশ কর্মকর্তার দায় নিরুপণে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)’র ডিআইজিকে একটি কমিটি করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে তদন্তে পাঁচ পুলিশের দায় প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়।
যে পাচ পুলিশ কর্মকর্তার দায় নিরুপণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তারা হলেন: পল্লবী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দাদন ফকির, একই থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নজরুল ইসলাম, গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সাবেক পরিদর্শক মো. সিরাজুল ইসলাম খান, উপ-পরিদর্শক রউফ ও পল্লবী থানার সাবেক উপ-পরিদর্শক মো. রাসেল।
অন্যদিকে, এই পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তাকে বর্তমান দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনসে ক্লোজ করতে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশ দেওয়া হয় হাইকোর্টের রায়ে। এছাড়াও দায় নিরুপণে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এদের কম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত রাখতে বলা হয়।
হাইকোর্টে আরমানের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো. হুমায়ুন কবির পল্লব। তার সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী মোজাম্মেল হক ও মাজেদুল কাদের। আর রাষ্ট্রপক্ষে হাইকোর্টে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নওরোজ মো: রাসেল চৌধুরী।
‘কারাগারে আরেক জাহালম’ শিরোনামে গত বছরের ১৮ এপ্রিল দৈনিক ‘আমাদের সময়’ পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
সে প্রতিবেদনে বলা হয়, অপরাধী না হয়েও পাটকল শ্রমিক জাহালমকে জালিয়াতির ৩৩ মামলার আসামি হয়ে ৩ বছর কারাভোগ করতে হয়েছিল। অনেক ঘাটের জল পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপে তিনি কারামুক্ত হন। কিন্তু এর রেশ না কাটতেই আরেক জাহালম কাণ্ড বেরিয়ে এসেছে। পল্লবীর বেনারসি কারিগর মো. আরমান নির্দোষ হয়েও ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে ৩ বছর ধরে কারাভোগ করছেন। রাজধানীর পল্লবী থানার একটি মাদক মামলায় ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি মাদক কারবারি শাহাবুদ্দিন বিহারি এই মামলার প্রকৃত আসামি।
কিন্তু তার পরিচয়ে, তার পরিবর্তে সাজা ভোগ করছেন আরমান। শুধু বাবার নামে মিল থাকায় ২০১৬ সালের ২৭ জানুয়ারি আরমানকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে পরে শাহাবুদ্দিন নামে আদালতে সোপর্দ করেছে বলে অভিযোগ করেন তার পরিবার। আর প্রকৃত আসামি শাহাবুদ্দিন তখন কারাগারের বাইরে দিব্যি মাদক কারবার চালিয়ে যাচ্ছিলেন। পুলিশের ভুলে অথবা গোপন কারসাজিতে মৃত ইয়াছিন ওরফে মহিউদ্দিনের ছেলে শাহাবুদ্দিনের পরিবর্তে সেই থেকে কারাগারে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন আরমান।’
পত্রিকায় প্রকাশিত এই প্রতিবেদনটি যুক্ত করে মানবাধিকার সংগঠন ল’ অ্যান্ড লাইফ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে গত বছরের ২১ এপ্রিল হাইকোর্টে রিট করা হয়। সে রিট আবেদনে আরমানের আটকাদেশ চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি তার জন্য ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়।
এরপর এই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট বেনারসি কারিগর মো. আরমানের আটকাদেশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং কেন তাকে মুক্তি ও ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুলে জারি করেন। সে রুল যথাযথ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট।