চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

‘আমি বাংলাদেশের আজম খান’

‘মানুষকে উৎসাহ দেয়ার জন্য, চেতনার জন্য, জাগানোর জন্যই কিন্তু আমার গান গাওয়া। পপ সম্রাট, গুরু মুরু, টাকা পয়সা, ধান্দা ফিকির এইগুলার জন্য কিন্তু আমার হেডেক নাই, বা চিন্তাও নাই’

‘আপনারা পপ সংগীত বলেন আর ব্যান্ড সংগীত বলেন, এটা কিন্তু মেইনলি আমার যুদ্ধ, গণসংগীত। মানুষকে উৎসাহ দেয়ার জন্য, চেতনার জন্য, জাগানোর জন্যই কিন্তু আমার গান গাওয়া।’-নিজের সম্পর্কে এমন নির্মোহ মূল্যায়ন যিনি করতে পারেন, তাঁকে নিয়ে মূল্যায়ন করার দুঃসাহস দেখাবেন কে!

বলছি ‘রক গুরু’ হিসেবে সংগীত জগতের মানুষের কাছে তার পরিচিতি আজম খানের কথা! সাধারণের কাছে তিনি গুরু আজম খান। ২০১১ সালে ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। মৃত্যুর আগে বহু লড়াই করে গেছেন সংগীতের এই যোদ্ধা।

বাংলা পপ ও রক সংগীতের শুরু ‘গুরু’ আজম খানের হাত ধরে। সত্যি সত্যি ‘গুরু’ হওয়ার যে গুণ ও প্রজ্ঞার দরকার তার সবটুকুই এই সংগীত অন্তপ্রাণ মানুষটি ধারণ করতেন। গুরু মানে যিনি অন্ধকার থেকে আলোর পথে চালিত করেন, যিনি আলোর পথ দেখান। বাংলা ব্যান্ডের জগতে শুধু নয়, আজম খানকে বাংলা সংগীত জগতেরই একজন ‘গুরু’ বললে অত্যুক্তি হয় না।

১৯৫০ সালর ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার আজিমপুরে জন্ম হয় বাংলা ভাষাভাষি সংগীতাঙ্গনের উজ্জ্বল নক্ষত্র আজম খানের। ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি ছিলো যার বিশেষ অনুরাগ। কিন্তু সেই সমাজ গানের জন্য অনুকূল ছিলো না। প্রতিকূল এক সমাজে বেড়ে উঠছিলো সেই সময়ের বাংলার হাজারো তরুণ। যাদের জীবন ছিলো পাকিস্তানি বিধি নিষেধের গ্যাঁড়াকলে আবদ্ধ। তাই গানের প্রতি বিশেষ দরদ থাকলেও কেমন যেনো অবিকশিত থেকে যাচ্ছিলো তরুণ আজম খানের সংগীত প্রতিভা। চিন্তা-চেতনায় এমনিতেই ছিলেন একটু সাম্যবাদী ধারার, বিপ্লবী চিন্তা-চেতনা সব সময় মাথার ভিতর ঘুরপাক খায়। শোষক পাকিস্তানিদের বর্বরতা চোখের সামনে দেখতে পেয়ে কেঁদে উঠে তাঁর সরল মন। স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদগ্র মানসিতা নিয়ে সামিল হলেন গণঅভ্যুত্থানে।

ফলে বাঙালির উপর চাপিয়ে দেয়া পাকিস্তানিদের নানান শোষণ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় লাখো বাঙালি। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানে আজম খানের বয়স ১৯, রক্ত টগবগে এক তরুণ প্রাণ। গর্জে উঠেন আজম খানও। এমনিতেই তার রক্তে বইছিলো দ্রোহের আগুন। তারপর ৭০-এর নির্বাচন হলো, ব্যালট বাক্সে বাঙালির জয় নিশ্চিত হলো। কিন্তু পাকিস্তানিরা ক্ষমতা ছাড়লো না, বাঙালির বিরুদ্ধে তারা আরো আক্রমনাত্মক হয়ে উঠলো। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ পাকিস্তানিদের সাথে বাঙালির আচরণ কেমন হবে, বা হওয়া উচিত তার একটা সুরাহা করে দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। তিনি রেসকোর্স ময়দানে শোষিত বাঙালির পক্ষে পাকিস্তানি নিপিড়কদের কথা উচ্চারণ করে তাদের সাথে সকল ধরণের সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেন এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান করেন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমাপর বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। আর দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করতে বাংলার কৃষক, মজুর, ছাত্র, জনতার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তির সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করেন গান-পাগল মানুষ আজম খান।

দেশ মাতৃকার বিপদসংকুল অবস্থায় শিল্পী আজম খানের বয়স একুশ! যুদ্ধে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করতে অংশ নিবেন, আর এর জন্যে এই পাগলাটে মানুষটি গেলেন মায়ের কাছে অনুমতি চাইতে। দেশ যতোই শত্রুযুক্ত থাকুক, কোনো মা কি নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে নিজের সন্তানকে ঠেলে দিবে! কিন্তু আজম খানের মা অনুমতি দিলেন, এবং ছেলেকে হাসিমুখে বললেন, ‘অবশ্যই যুদ্ধে যাবি তবে বাবার কাছে বলে যা’। ধুরু ধুরু বুক নিয়ে আজম খান গেলেন বাবার কাছে, অনুমতি চাইলেন যুদ্ধে যাওয়ার। বাবা এমনিতেই একটু গম্ভীর টাইপের মানুষ। তার উপর তিনি সরকারি অফিসার। কিন্তু আজমকে বিস্মিত করে বাবা বললেন, ‘যা, যুদ্ধে যা। দেশ স্বাধীন করে ফিরে আসবি, অন্যথায় আমার ঘরে ঢুকতে পারবি না’।

এমনিতেই পাগলাটে এক মানুষ আজম খান, জন্মের পর থেকেই যিনি এদেশকে কারারুদ্ধ দেখে এসেছেন, মানুষকে শোষিত হতে দেখেছেন, তিনি যখন বাবা-মায়ের এমন সমর্থন পেলেন, তখন আরো শক্তিশালী হয়ে উঠেন আজম খান। ট্রেনিং নিতে একাধিকবার ভারত গেছেন, সেখান থেকে ফিরে এসে কুমিল্লা জেলায় পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়েছেন মেশিনগান হাতে। দায়িত্ব পালন করেছেন কমান্ডোর। ১৯৭১ সালের শেষ দিকে ঢাকার গেরিলা বাহিনীরও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। আজম খান শুধু মেশিনগান গান হাতে শত্রুর বিরুদ্ধে গুলি চালাননি, বরং তারচেয়ে যেটা প্রয়োজন ছিলো সহযোদ্ধাদের চেতনাকে সদা জাগ্রত রাখা, তিনি তা করেছেন। তার সুর দিয়ে, কণ্ঠ দিয়ে, তার গীত রচনা দিয়ে। আজম খানের এমন পরিবেশনে সহযোদ্ধারা প্রবল উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন শত্রুর বিরুদ্ধে। তাই ভারি মেশিনগানের চেয়ে আজম খানের কণ্ঠের ধারও কোনো অংশে কম ছিলো না যুদ্ধের ময়দানে।

দেশ স্বাধীন হলো, বীরের বেশে ঘরে ফিরলেন আজম খান। গানই তার একমাত্র নেশা হয়ে যায়। নিজে গান তৈরি করেন, নিজেই সুর করেন, নিজেই কণ্ঠ দেন। কিছু বন্ধু বান্ধব নিয়ে একটা গানের দলও করে ফেলেন তিনি। নাম ‘উচ্চারণ’। যদিও এটা আরো আগেই থেকেই চলছিলো। ‘উচ্চারণ’ ব্যান্ড দলটি মানুষের কাছে জনপ্রিয় হতে না পারলেও, ভিন্ন ধাঁচের গান দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যান আজম খান। তার অভিনব সুর আর গানের চমৎকার কথায় মানুষ মোহিত হয়, অন্যরকম এক আমেজ খুঁজে পায় মানুষ তার গানে। সংগীতজ্ঞরা কেউ কেউ আজম খানের গানকে নাম দেন ‘রক’ কেউ বলেন ‘পপ’। কিন্তু এইসবে একটুও মাথা ব্যথা নেই আজম খানের।

রক হোক, কিংবা হোক পপ। তার একটা কথায়-ই মাথায় ছিলো, গান গাইতে হবে সাধারণ মানুষের জন্য। এজন্য পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে আজম খানকে বলতে শোনা যায়, ‘আপনারা পপ সংগীত বলেন আর ব্যান্ড সংগীত বলেন, এটা কিন্তু মেইনলি আমার যুদ্ধ গণসংগীত। মানুষকে উৎসাহ দেয়ার জন্য, চেতনার জন্য, জাগানোর জন্যই কিন্তু আমার গান গাওয়া। পপ সম্রাট, গুরু মুরু, টাকা পয়সা, ধান্দা ফিকির এইগুলার জন্য কিন্তু আমার হেডেক নাই, বা চিন্তাও নাই।’

আজম খানের গাওয়া অসংখ্য গান আজ বাঙালির হৃদয়ে ঢেউ তুলে। দেশের বাইরেও একজন রকস্টার হিসেবে তার নাম উচ্চারিত হয়। তাঁর গাওয়া বেশ কিছু গান সত্তর এবং আশির দশকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ওরে সালেকা- ওরে মালেকা, আলাল ও দুলাল, অনামিকা, অভিমানি, আসি আসি বলে ইত্যাদি গানগুলো এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে!

‘আমি বাংলাদেশের আজম খান, বাংলাতে গাই পপ গান…’ এই গানটির মধ্য দিয়ে আজম খানের জীবনের কিছু অংশ চমৎকারভাবে উঠে এসেছে। যে দেশের মানুষ গুণীর কদর বোঝেনা, সেই দেশে নাকি গুণীই জন্মায় না। কিন্তু বাঙালির সৌভাগ্য যে, গুণীর প্রাপ্য সম্মান দিতে ব্যর্থ হলেও এই বঙ্গে জন্মেছিলেন আজম খানের মতো একজন বড় মাপের শিল্পী। সর্বোপরি একজন মহৎ মানুষ। গেল বছর বাংলাদেশ সরকার সংগীতের এই গুণী মানুষটির নামে একুশে পদক ঘোষণা করে।