গত ১৬ মার্চ জনপ্রিয় সুরকার- সঙ্গীতশিল্পী শফিক তুহিন বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচ দেখতে ইডেন গার্ডেনে বাংলাদেশ থেকে ছুটে যান। কলকাতার প্রভাবশালী পত্রিকা আনন্দবাজার শফিক তুহিনের একটি ছবি প্রকাশ করেন। ছবিটি প্রকাশ করার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয় এবং রীতিমতো অপরাধের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।
আনন্দবাজারের ওই ছবিতে দেখা যায়, জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এ শিল্পী পাকিস্তানের সমর্থক ও পতাকা নিয়ে বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন। বাংলাদেশের মানুষ হয়ে তিনি কিভাবে পাকিস্তানের সার্পোট করছেন সেটি নিয়ে চলছে জোর আলোচনা।
তবে শফিক তুহিন যেই ছবিটি আজকে তার ফেসবুকে শেয়ার করেছেন ছবিটির সঙ্গে ওই ছবিটির কোনো মিল পাওয়া যাচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে অবশ্য শফিক তুহিন তার অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে একটি স্ট্যাটাস পোস্ট করেছেন।
সবাই কম বেশী জানে আমি একজন ক্রিকেট পাগল। ঢাকায় খেলা হয়েছে, বাংলাদেশ খেলছে আর শফিক তুহিন নেই, এই দৃশ্য বিরল। কিন্তু কলকাতা, এইতো পা বাড়ালেই পা পড়ে রয় দুরুত্বের কলকাতা, আরাধ্যতম মাঠ ইডেন। বাংলাদেশ যেখানে একটাই মাত্র ম্যাচ খেলেছিলো, তাও আজ থেকে ২৫ বছর আগে! সেখানে আবার লাল সবুজ নাচবে, গ্যালারি প্রকম্পিত হবে বাংলাদেশ বাংলাদেশ স্লোগানে, আর বিরোধী শিবিরে থাকবে পাকিস্তান! রচিত হবে আরেকটি গল্প? ইডেনেই? অথচ আমি থাকবো না? আমার গায়ে লাল সবুজের জার্সি। সেই জার্সির বুকে বড় বড় হরফে লেখা বাংলাদেশ! এই বাংলাদেশ বুকে নিয়ে সেদিন।
আমার সাথে গায়ক মাহমুদ জুয়েলে, টাইগার মিলন, সব সমর্থক, শূন্য ব্যান্ডের এমিল সহ চেনা অচেনা অনেক মানুষ ছিলো সেদিনের ইডেন গার্ডেনে।
ইডেনের গ্যালারীতে। ম্যাচ শুরুর আগে মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিকরা যখন বুকের ওপর হাত চেপে দাঁড়াল। আমরা গুটিকয় বাংলাদেশি সমর্থক দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে কেমন এক ঘোরের ভেতর ডুবে গেলাম, জাতীয় সঙ্গীত বাজছে, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি…’
বুকের ভেতর কী এক থইথই কান্নার অনুভূতি, উথালপাতাল ঢেউ, কে জানে, তার খানিকটা চোখের কোল গড়িয়ে পড়েছে কি না! তারপর খেলা শুরু, পাকিস্তানের মুহুর্মুহু ব্যাটিং, আমরা চুপসে যাই নি, তারপরও একটা ডট বলে, একটা ফিল্ডিং এ, একটা আউটে আমরা চেঁচিয়েছে। আবার সাব্বিরের আউটের পর বাংলাদেশ থেকে এক গীতিকার সমেশ্ব ওলি ভাইবারে কল দিয়ে বলেছে, ‘ভাই আপনার বিষন্ন মুখের চেহারা মাত্র টিভিতে দেখলাম।
সেই আমি, পরদিন ফেসবুকে তাকিয়ে দেখি, নিচের ছবিটি যা ভারতের একটি প্রভাবশালী পত্রিকা ছাপিয়েছে যেখানে আমি পাকিস্তানী পতাকার পেছনে, পাকিস্তানী সমর্থকদের সাথে বাংলাদেশের জার্সি গায়ে দাঁড়িয়ে আছি, উল্লাস করছি!
দেখে দীর্ঘ সময় স্তব্ধ হয়ে ছিলাম। একটি স্থিরচিত্রের একটি বিচ্ছিন্ন ছবির, বিচ্ছিন্ন দৃশ্যের অজস্র অর্থ এবং ব্যাখ্যা দাঁড়াতে পারে! কিন্তু তার একটাও প্রকৃত ঘটনা নাও হতে পারে! কিন্তু এই যুক্তিতে আমি গেলাম না।
কিন্তু ছবি? ছবিটি? আসল সত্যটি হলো ইন্টারন্যাশনাল গ্যালারিতে সাধারণত সব দেশের মানুষ থাকে; সেদিন খেলা শুরুর আগে অসংখ্য ফটো সাংবাদিক দুই দেশের সমর্থকদের ছবি তোলা শুরু করলো। এই স্ট্যাটাস এ সংযুক্ত আগের ছবিটি দেখলেই বুঝবেন যার যার দেশের জন্য এক ধরনের উন্মাদনার বহি:প্রকাশ। কিন্তু ছবিটি এডিট করে প্রকাশের পর শুরু হল দেশ থেকে অজস্র মানুষের ফোন, মেসেজ।
ফেসবুকে ছবিটি রীতিমত ভাইরাল হয়ে গেল! আমি থম মেরে বসে রইলাম, কী জবাব দেব এদের আমি? যদি আমি না হয়ে ঠিক একইভাবে পাকিস্তানের পতাকার সাথে আমার দেশের অন্য কারো ছবি এভাবে দেখতাম, আমি নিজেও প্রবল ঘৃণায় আক্রোশে বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠতাম।
যেই পাকিস্তান নাম শুনলে উচ্চারণ করতে ঘৃণায় জীভ আড়ষ্ট হয়ে আসে, বুকের ভেতর চোখের ভেতর ভেসে ওঠে ৩০ লক্ষ শহীদের মুখ! ৩ লক্ষ ধর্ষিতা মা বোনের কলজে ছেড়া আর্তনাদ। প্রবল প্রতিশোধ স্পৃহায় গনগনে আগুনে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে শরীর। সেই পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে উল্লসিত আমি কী করে হতে পারি! আপনারাই একবার ভেবে দেখুন?!
বাংলাদেশকে ভালোবাসি, এই অনুভূতি একান্ত নিজের, এই অনুভূতি কারো কাছ থেকে অনুমোদিত করে নেয়ার প্রয়োজন বোধ করি না। এই অনুভূতি একান্ত আমার, একান্ত নিজের। এই অনুভূতি কাকে বোঝাব? কিভাবে বোঝাব? কেন বোঝাব? এই অনুভূতি আমার, একান্ত আমার, আচ্ছা, ভাষার সাধ্য কী সকল অনুভূতি বোঝায়?
তারপরও কেবল বুকের ভেতর কষ্ট হয়, কান্না হয়, যখন এই মাটি, এই জল হাওয়ায় বেড়ে ওঠা শরীর, জেগে ওঠা হৃদয়ে, এই মাটির প্রতি কতটুকু ভালোবাসা, কতটুকু মমতা, কতটুকু প্রার্থনা রয়েছে, তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে, তা নিয়ে কেউ সংশয় প্রকাশ করে, তখন কষ্ট হয়। প্রবল ভালোবাসার বিনিময়ে কেউ যখন দ্বিধা আর সংশয় ফিরে পায়, তখন তীব্র কষ্ট হয়, তীব্র কষ্ট।
তবে সেই কষ্টরাও জানে, বাংলাদেশ মানেই বুকের ভেতর ছলকে ওঠা রক্ত, সেই রক্তের কণা জুড়ে স্পন্দন, ভালোবাসি বাংলাদেশ! ভালোবাসি!
কলকাতায় থাকাকালীন আমার মা বাবাও দুজনই ছিলেন মেডিকেল চেক-আপে’এ এমন খবর প্রকাশের পর ছেলের অস্থিরতা দেখে শুধু এটুকুই বলল “বাবা মন খারাপ করো না! সত্যের জয় হবেই; আর দেশ মাটি মানুষকে সবসময় ভালোবাসবে-তাহলেই সৃষ্টিকর্তাকে ভালোবাসা হবে।