সবারই প্রশ্ন ছিল ‘বৃষ্টির ছবি আঁকা’ মানুষটির কাছে। কত শত প্রশ্ন। বাঙালিয়ানার মধ্যে থেকেও সাহেবিয়ানার অদ্ভূত মিশেলের মানুষটির কাছে তো প্রশ্ন থাকাটা স্বাভাবিক। কত সহজিয়া ভঙ্গিতে ‘লেবু লজেন্সের শিশি হাতে’ ইস্টিশনে বসে থাকা মানুষটি কত চরিত্র কিংবা স্থান কথায় সুরে গিটারে চিনিয়েছেন বাংলা গানকে। বাঙালিকে। নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু করে আজতক। রঞ্জনা, বেলা বেলা বোস, মি. হল, আলীবাবা, জেরেমি অথবা দার্জিলিং, কাঞ্চনজংঘা, ৩৬ চৌরঙ্গী লেন, ঢাকার বেইলি রোড তুলে আনা আদ্যোপান্ত শিল্পীর কাছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মিলনায়তনে প্রশ্ন ছুটেছে পুরোটা সময়।
কোন এক প্রশ্নে তার বয়ানে উঠে আসেন লাকী আখন্দ। তাকে নিয়ে গান, তার সঙ্গে পরিচয়-বন্ধুত্ব এবং তার সঙ্গে গান। অঞ্জন বলেন, লাকীর সঙ্গে পরিচয় এক গানের অনুষ্ঠানে। যেখানে তিনি বলেন আমার কোন গান শোনেননি। কিন্তু আমরা দুজনে গাইলাম। গান হয়ে গেল। সম্পর্কটাও হয়ে গেল বন্ধুত্বের। লাকীকে বাংলা সিনেমা ব্যবহার করতে পারেনি।
যে কারণে সংক্ষিপ্ত সময়ের ঢাকায় আসা অঞ্জন দত্তের তা হলো তাকে নিয়ে লেখা জীবনী ‘অঞ্জনযাত্রা’র মোড়ক উন্মোচন। একটু পাঠ ও যারা বইটি প্রথমবারেই নিয়েছেন তাদের স্বাক্ষর সহকারে বই দেওয়া। ‘অঞ্জনযাত্রা’ প্রসঙ্গে বলে চলেন শিল্পী, কাজের বাইরের একটা আমি থাকে, সেই আমিটা আসল। অবশ্যই আমি আমার গানে, অভিনয়ে, নির্মাণে পুরোটা অঞ্জন। অঞ্জনযাত্রায় বাইরের আমিকে খুঁজে বের করার আন্তরিক অকপট প্রচেষ্টা ছিল লেখকের। আমিও নিজের এমন সব কিছু বলেছি যা কোনদিন কোন কোন সাক্ষাৎকারে বলিনি। সেরকম প্রশ্নই মেলেনি। লেখক একজন শিল্পীর যন্ত্রণা এবং সংগ্রামকে খুঁজেছেন। লেখকের সঙ্গে দার্জিলিংয়ে আমার শৈশবে হাঁটতে হাঁটতে কথা হয়েছে। কুয়াশায় ঢেকে যেতে যেতে, বাগডোবরা এয়ারপোর্ট কিংবা গাড়িতে চলতে চলতে আমি আর লেখক যৌথযাত্রা করেছি। প্রায় ৫ মাস ধরে পরস্পরকে জেনেছি আমরা।
অঞ্জন বলে চলেন: বায়োগ্রাফিতে কোন মিথ্যা থাকা উচিত নয়। আড়াল থাকা উচিত নয়। তাতে কি সেটা বায়োগ্রাফি হয়? হয়না। আমার কাছে বায়োগ্রাফি মানে আলো-অন্ধকারে থাকা পুরোটা মানুষ। আমি খুলে দিয়েছি আমার আলো-অন্ধকার। অকপটভাবে। এর জন্য প্রথম দিকে নিজের সঙ্গে কিছুটা যুদ্ধ করতে হয়েছে। পরে মনে হয়েছে চলুক না। লেখকের উদ্দেশ্য যেহেতু চটক বা রগরগে বা নিছক বাণিজ্যিকতা নয়, নিজেকে উন্মুক্ত করে দিলে ক্ষতি কি?
‘আবদুল মানাম হোসেনের ভাঙ্গাচোরা রিকশা’র খোঁজ দেওয়া অঞ্জন বলে চলেন, অনেকে বলেছে বায়োগ্রাফি কলকাতা না হয়ে কেন বাংলাদেশে? আমি বিশ্বাস করেছি লেখককে। কোন চেনা ছিলনা দুজনের। ফোনেই প্রথম কথা। কয়েকবার কথা হওয়ার পর তাকে বিশ্বাস করেছি। লেখা হওয়ার পরও জানতে চাইনি কি লিখেছে। কতটুকু রেখেছে বা রাখেনি। পাশে বসে থাকা স্ত্রীকে দেখিয়ে অঞ্জন বলেন, আমার স্ত্রী বলেছেন কি যে করতে যাচ্ছ! সব কথা বলতে হবেই বা কেন? পরে তিনি মেনে নিয়েছেন। কারণ এটাইতো আমি। আমার আমিকে মেনে তিনি আমাকে চালিয়ে নিচ্ছেন।
আরো একটা প্রশ্ন উঠে এলো, বয়স কি বেড়ে গেছে। চিরন্তন অঞ্জনীয় ভঙ্গিতে অসাধারণ অভিব্যক্তিতে ‘রোমিওকে হোমিওপাতির দোকান খুলে দেওয়া ‘জানলাকে আকাশ’ মানা শিল্পী বলেন, আমি এখনও ১৫।’ তবে আক্ষেপটা লুকিয়ে রাখতে পারেন না দত্ত ভার্সেস দত্তের দ্বান্দিক অঞ্জন। বড় অভিনেতা হব বলে ব্লাউজ পিস গামছা বুনেছি, শরীর কালো করেছি। সে সময় সুযোগ মেলেনি। গান গেয়ে বাবার ঋণ শোধ করেও ছবি বানিয়েছি। নিজেকে চরিত্র দিয়েছি। এখনকার তরুণদের অনেকে বলে আমি নাকি ভালো অভিনেতা। তারা কিছু চরিত্রও দেয়। কিন্তু একটা বয়সের পর চরিত্র হয়ে ওঠা মুশকিল হয়ে যায়। শরীর বিদ্রোহ করে পরীক্ষা নিরীক্ষায়।
বেলা বোস, রঞ্জনা, মেরিঅ্যান এর চরিত্র সম্পর্কে কেউ একজন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এগুলো আমার জীবন। অনেকেই ছিল অনেকই হয়ত নেই। মস্ত অভিনেতা হতে না পারার আক্ষেপকে আমি আমার গানের গল্পের শরীরে বুনে দিয়েছি নানা চরিত্রে।
রাজনীতির বিষয়ও আসে অঞ্জনের কথনে। জানান, নকশালবাড়ির আন্দোলনে অনেকের মত জড়িয়ে পড়েছিলেন। তবে আদর্শিক জায়গা থেকে নয়। বন্ধুত্বের টানে। বন্ধুর জন্য বন্ধুর বিপদে পাশে দাঁড়ানো তার কাছে প্রধান কর্তব্য। সরাসরি রাজনীতিতে সক্রিয় হননি কখনও। হবেনওনা। তবে বিভিন্ন বিষয়ে শিল্পী হিসেবে কথা বলবেন তার মত করেই।
আক্ষেপে মোড়ানো ছিল যেন ‘জেরেমির বেহালার’ খোঁজ দেওয়া আজন্ম নষ্টালজিক অঞ্জন বলেন, আমার অনেকটা আমি ‘অঞ্জনযাত্রা’য় প্রকাশিত। আমার জীবনের রোদ্দুরের প্রায় পুরোটাই উঠে এসেছে প্রকাশনাটিতে।
বাকীটা থাকুক না আক্ষেপের অক্ষরে মোড়ানো অকপট অঞ্জনকে জেনে নেওয়ার জন্য ‘অঞ্জনযাত্রা’ পড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত। আক্ষেপ অথবা অসম্পূর্ণতা ছাড়া কোন জীবন কবে সম্পূর্ণ হয়েছে।
সব শেষে খোলা গলায় গেয়ে ওঠেন অনবদ্য অঞ্জন। ‘একা একা বেঁচে থাকা রাস্তায়/ বাসস্টপে বাজারে/ নিয়মিত একটা হাঁটা সকালে/ একা একা পড়ে আছে রোদ্দুর…গান শেষ হয়। উঠে দাঁড়ান অঞ্জন। সবাই উঠে দাঁড়ান। কালো চশমায় ঢাকা চোখটাতে কি চিকচিক করছে কিছু একটা। তিনি চলে যান। বোঝা যায়না চোখের কোনে কিছু ছিল কিনা!
ছবি: জাকির সবুজ