বইটা হাতে নিয়ে প্রথমেই এর নান্দনিক প্রচ্ছদ নজর কাড়ে। প্রচ্ছদে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে, বইয়ের কেন্দ্রীয় চরিত্র নূর। ঠোঁট তালু কাটা নূরের কালো রঙের দুইটা ডানা দেখা যায়। কারণ নূর বিশ্বাস করে তার হাত দুটোই তার ডানা। তার জীবনধারার কারিগর সে নিজেই। জন্ম থেকেই নূর তার মানসিক বিকারগ্রস্ত মায়ের মমতা বঞ্চিত। অল্প বয়সে নূর বুঝে ফেলে পৃথিবীতে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়। তার জন্মগত ত্রুটির দিকে বাঁকা দৃষ্টি ফেলে সবাই। এক সময় সেই ত্রুটি সারানোর চেষ্টা করা হয়, বাহ্যিক ভাবে অনেকটাই স্বাভাবিক হওয়ার পরেও কটাক্ষ বন্ধ হয় না।
ছোট বেলার সঙ্গীকে কৈশোরে ভালোবেসে ফেলে নূর কিন্তু দুর্ভাগ্য হানা দেয় জীবনে। ভালোবাসার মানুষকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলে। একমাত্র তার চোখেই নূর ছিলো নিখুঁত আকাঙ্ক্ষিত মানুষ। সেই মানুষকে হারিয়ে নূর কাঁদে না, হয়তোবা সেই মানসিক পরিপক্বতা তখনও হয়নি নূরের। কিন্তু জীবনে দ্বিতীয় ভালোবাসার মানুষকে চিনতে ভুল করে না নূর। আবেগের নিয়ন্ত্রণ করে রাকিবকে দূরে সরিয়ে দেয়। কারণ রাকিবের কাছে তাদের সম্পর্কের মূল্য নেই। এমন অমর্যাদার যুগল জীবন চায়নি নূর। কিন্তু এইবার বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় নূর কাঁদে, হয়তো দুর্বলতার হতাশায়, মানুষ চিনতে না পারার ব্যর্থতায়। এখানে নূরকে প্রচণ্ড দৃঢ়চেতা, আত্মমর্যাদাশীল আর মানসিকতায় শক্তিশালী মানুষ হিসেবে দেখে ভালো লাগে। অনেক মেয়েই আবেগের বশবর্তী হয়ে ভুল মানুষকে জীবনসঙ্গী করে তারপর সেই ভুল সম্পর্ক সারাজীবন বয়ে বেড়ায়। কিন্তু নূর অল্প বয়সী হলেও এমন ভুল করে না। গ্রামে বেড়ে ওঠা একটা মেয়ের এমন দৃঢ়তা সত্যি সাহস যোগাবে অনেককে। বুঝতে শেখাবে নিজের সম্মান মহামূল্য সম্পদ।
নূর শত প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে সাফল্যের দিকে এগিয়ে যায়। তার এই পথ চলায় কিছু কাছের মানুষ এগিয়ে আসে আবার কিছু কাছের মানুষ তার পথে কাঁটা বিছাতে দ্বিধা করে না। শিখরে চড়তে গিয়ে একে একে নূরের প্রিয় মানুষগুলো সরে যেতে থাকে। তবু নূর থামে না, কারণ ‘আমি জানি জীবনের কঠিন সময়কে ভুলে যেতে হয়, নতুবা সামনে এগোনোর সব শক্তি ফুরিয়ে যায়।’
লেখক নিজে বিচারক বলে বাংলাদেশের বিচার প্রক্রিয়া, কোর্ট কাচারীর নিয়মনীতি, অপরাধের শাস্তির পর্যায়ক্রমে নির্ভুলভাবে বর্ণনা করেছেন যা গল্পের সাথে সংযুক্ত হয়েছে। এই বিচার প্রক্রিয়া মানুষের জীবনে কেমন প্রভাব ফেলতে পারে সেটাও দেখতে পেলাম।
ভালো লেগেছে গল্পে উত্তরাঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার। এই ভাষা জানি না কিন্তু পড়তে গিয়ে একবারও কোনো আঞ্চলিক সংলাপ দুর্বোধ্য লাগেনি। লেখক সময় নিয়ে স্থানীয় কথন রপ্ত করে লেখায় তুলে ধরেছেন।
তবে মাঝে মাঝে কিছু অভিব্যক্তির পুনরাবৃত্তি লেখার গতি ধীর করেছে। যেমন, দাদীর প্রতি নূরের ভালোবাসা এবং নির্ভরতাকে প্রকাশ পেয়েছে বারবার যেটা কিছু ক্ষেত্রে অযাচিত মনে হয়েছে। নূরের সাথে দাদীর সম্পর্কের কোনো উত্থান পতন ছিলো না সেক্ষেত্রে বারবার পাঠককে একই বক্তব্য জানানোর প্রয়োজন দেখি না।
বারবার মনে হয় নূর শেষ পর্যন্ত চিরসুখ খুঁজে পাবে, রূপকথার গল্পের শেষের মতো। যেমন হয়েছে ‘বিউটি এন্ড দা বিস্ট’ গল্পে, রূপ দেখে নয়, দানবের মমতায় মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়ে রাজকন্যা। কিন্তু বাস্তবে তেমন হয় না। নূরের চেহারার খুঁত তার অন্ত:স্থ সৌন্দর্যকে বারবার ঢেকে দেয়। ভালবাসা ওর জন্য অধরাই থেকে যায়।
এত বিষণ্ণ কেন নূরের জীবন? যেমন ভালোবাসার জন্য নূর অতৃপ্ত থেকে গেলো, তাকে কি সেই ভালোবাসা দেয়া যেত না? গল্পটা শেষ হয়েছে নূরের বয়স চল্লিশে। আমি এখনো আশাবাদী, নূর তার একাকী জীবনে কাউকে সঙ্গী করতে পারবে। অদ্ভুত দ্বিধার দোলাচল থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। নয়তো কি ধরে নেবো দৃঢ়চেতা স্বাধীন আত্মমর্যাদাশীল নারীর জন্য একা থাকাই নিয়তি?
রিভিউ লেখক: সালমা সিদ্দিকা
ঔপন্যাসিক: সাদিয়া সুলতানা
উপন্যাসের নাম: আমি আঁধারে থাকি
প্রকাশনী: চৈতন্য প্রকাশনী
প্রকাশকাল: ২০১৮ বইমেলা