চাঁদপুর কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও বেশ কয়েকজন শিক্ষককে পেয়েছিলাম যাদের চেহারা এখনও মানসপটে ভেসে বেড়ায়, আমাকে প্রভাবিত করে, পথ দেখায়। এখনও যেন বুকের পাশে বাম হাতে বই চেপে করিডর দিয়ে ক্লাসে যাচ্ছেন আর আমরা দৌঁড়ে যার যার ক্লাসে বসছি। তখন ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বিরোধী আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান চলছে।
আমরাও ক্লাসে কোনো রকমে প্রক্সি দিয়ে বটতলায় ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা- তোমার আমার ঠিকানা’ ‘জেলের তালা ভাঙ্গবো শেখ মুজিবকে আনব’ ‘জয় বাংলা’ ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, স্লোগান দিচ্ছি, মিছিল করছি। আমাদের ক্লাস ফাঁকি তাই অপরাধ হিসেবে গণ্য হতো না। চাঁদপুর কলেজে শিক্ষকের মধ্যে মনে পড়ে বাংলার মাহমুদা খাতুন, আবদুস সাত্তার স্যারের কথা। মাহমুদা খাতুনকে অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও পেয়েছিলাম। আমার ইন্টারমিডিয়েটের শেষ পর্যায়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করেছিলেন। মনে পড়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মনিরুজ্জামান, অর্থনীতির মশিউর রহমান স্যারের কথা, মনে পড়ে ইংরেজীর এসএন রায়, হেলালুদ্দিন, ওয়ালিউল্লাহ ও আবদুস সাত্তার স্যারের কথা।
সাত্তার স্যার মনে প্রাণে বাঙালী মানসের ছিলেন, মিলিটারি আয়ুবের বেতারে ‘মুজিব ইজ এ্য ট্রেইটর, দিস টাইম হি উইল নট গো আনপানিসড’ বক্তৃতা শোনার সঙ্গে সঙ্গে হার্টফেল করে ইন্তেকাল করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমেই মনে পড়ে অধ্যাপক আবদুল হাই স্যারের কথা। ট্রেন দুর্ঘটনায় ইন্তেকাল করেন। মনে পড়ে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, জিসি দেব, গিয়াস উদ্দিন, আলীম চৌধুরীর কথা, যাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ভেতর পাকিস্তানী সামরিক জান্তার সহযোগী ঘাতক আল বদর বাহিনী বাসা থেকে চোখ বেঁধে বধ্যভূমিতে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এখনও এইসব মুখ আমাকে তাড়িত করে, স্নেহের পরশ দিয়ে চলেছেন।
আজও আদর্শবান নীতিবাদ শিক্ষক যেমন রয়েছেন তেমনি আদর্শহীন-নীতিহীন শিক্ষকও কম নেই। তারপরও বলব শিক্ষক শিক্ষকই। শিক্ষিকরা যখন মনোকষ্টে ভোগেন তখন আমাদের সন্তানরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সাম্প্রতিককালে সরকারী বেতন স্কেল ঘোষণার পর যতদূর শুনছি শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা আমলাদের নিচে ঠেলে দেয়া হয়েছে। শুনেছি আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতেরও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার বাসনা ছিল। মেধাও তার ছিল তবু তা না হয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চেয়েও বেশি আকর্ষণীয় সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। তারই অর্থমন্ত্রীত্বের আমলে দেশ যেভাবে দ্রুত এগিয়ে চলেছে। সে সময় শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন ভাবা যায় না। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি যথেষ্ট দক্ষ এবং সফল, এটি তার শত্রুও স্বীকার করবে। হয়তবা বয়সের ভার বইতে না পেরে আমলানির্ভর হয়ে পড়েছেন।
শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ সজ্জন ব্যক্তি, বছরের পয়লা দিন বাচ্চাদের হাতে বই তুলে দিচ্ছেন, বছর বছর পাসের হার বাড়াচ্ছেন, কিন্তু তার আমলেই শিক্ষকগণ ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হলেন। অবশ্য তার কাছ থেকে তেমন কিছু আশা করি না। আমার এলাকার বন্ধু সহযোদ্ধা শহীদ জাভেদ মেমোরিয়াল হাই স্কুলটি পাকা করার জন্য তার কাছে গেছিলাম। তিনি করে দেননি। তার শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটিতে এমন লোককে নিয়েছেন যিনি তার গ্রামের স্কুলে মুক্তিযুদ্ধের প্রার্থী প্রথম হওয়া সত্ত্বেও এক রাজাকারকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। আমি মন্ত্রী মহোদয়কে জানানোর পরও ব্যবস্থা নেননি। শিক্ষা প্রশাসন আজ ঘুষের স্বর্গ। কয়েকদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু স্থানীয় একজন সিনিয়র শিক্ষক, যিনি বঙ্গবন্ধু ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল এবং যুদ্ধাপরাধ বিচার আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। বলছিলেন, শিক্ষকদের এইভাবে অবমূল্যায়ন করা ঠিক হয়নি। বললেন, আমরা জানি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতা বঙ্গবন্ধুর মতই শিক্ষকবান্ধব এবং শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবু কেন এমন হলো? সরকারী সিদ্ধান্তে সংশোধন করে সিলেকশন গ্রেড এবং টাইম স্কেল প্রথা বাতিল না করে বহাল রাখলেও শিক্ষকদের ক্ষোভের কিছুটা হলেও প্রশমন হতো।
আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষকদের কতখানি শ্রদ্ধার চোখে দেখেন তা কে না জানে। আজ বলছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠী হিসেবে যেমন তাকে দেখেছি, তেমনি দেখেছি সাংবাদিক হিসেবে। দেখেছি কোনো শিক্ষক তার অনুষ্ঠানে এলে মঞ্চ থেকে উঠে গিয়ে পাশে বসাচ্ছেন। আনিসুজ্জামান কিংবা প্রয়াত প্রফেসর নীলিমা ইব্রাহিম বা প্রয়াত প্রফেসর সালাহউদ্দিন স্যারের বেলায় আমি দেখেছি। দেখেছি উঠে গিয়ে তাদের কিভাবে রিসিভ করছেন। পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বেলায়ও শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের কথা আমরা জানি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)