তরুণ কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান। তার ঝুড়িতে জমা হয়েছে এইচএসবিসি-কালি ও কলম পুরস্কার, ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল হুমায়ূন আহমেদ তরুণ সাহিত্যিক পুরস্কার, শ্রীপুর সাহিত্য পুরস্কার, এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার।
স্বকৃত নোমানের প্রকাশিত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে- রাজনটী, বেগানা, হীরকডানা, কালকেউটের সুখ, শেষ জাহাজের আদমেরা। গল্প সংকলন তিনটি: নিশিরঙ্গিনী, বালিহাঁসের ডাক এবং এবারের বইমেলায় প্রকাশ হচ্ছে ‘ইবিকাসের বংশধর।’ লিখেছেন ‘উপন্যাসের পথে’ নামে একটি মুক্তগদ্যের বইও।
আগামী বইমেলা ও লেখালেখি নিয়ে চ্যানেল আই অনলাইনের মুখোমুখি প্রতিভাবান তরুণ কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান:
এবারের বইমেলায় আপনার প্রকাশিতব্য বইগুলো সম্বন্ধে যদি বলতেন….
একটি গল্পের বই প্রকাশ হবে। ‘ইবিকাসের বংশধর।’ পাঞ্জেরি পাবলিকেশন্স থেকে। গত দুই বছরে লেখা মোট ১৬টি গল্প থাকছে বইটিতে। প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। এছাড়া ‘উপন্যাসের পথে’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে ‘আলোঘর’ প্রকাশনী থেকে, গত সেপ্টেম্বরে। এবারের বইমেলায় বইটি পাওয়া যাবে আলোঘর প্রকাশনীর স্টলে। এটির প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী শতাব্দী জাহিদ।
অপরদিকে, ২০১২ সালের বইমেলায় প্রকাশ হয়েছিল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিয়ে ‘বেগানা’ উপন্যাসটি। এবারের বইমেলায় এটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ হচ্ছে বিদ্যপ্রকাশ থেকে। বলতে গেলে প্রায় পুনর্লিখন করেছি উপন্যাসটির। আশা করছি পাঠকদের ভালো লাগবে। এছাড়া আমার যে উপন্যাসটি ‘কালি ও কলম পুরস্কার’ পেয়েছিল, ‘রাজনটী’, ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ থেকে এটিরও দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ হচ্ছে।
‘ইবিকাসের বংশধর’- রচনার পেছনের গল্প শুনতে চাই।
‘ইবিকাসের বংশধর’ গল্পটি বইয়ের নাম গল্প। গল্পটির আইডিয়া মাথায় আসে প্রায় দেড় বছর আগে, যখন আমি সমরেন্দ্রনাথ চন্দের ‘জীবজগতের লোকশ্রুতি’ বইটি পড়ছি। বইয়ে বক বা সারস সম্পর্কে একটি অধ্যায় আছে, যেখানে প্রসঙ্গক্রমে লেখা আছে গ্রিসের কবি ইবিকাসের কথা। প্রাচীন গ্রিক লোককথায় হত্যা কখনো লুকানো যায় না। মার্ডার উইল বি আউট- এই আপ্তবাক্য সম্বন্ধে একটি রোমাঞ্চকর ঘটনার কথা জানা যায়। যিশু খ্রিস্টের জন্মের প্রায় সাড়ে পাঁচ’শ বছর আগের কথা। গ্রিসে ইবিকাস নামে এক জনপ্রিয় কবি ছিলেন। অজ্ঞাত কারণে এক দস্যুর দল তাকে নির্জন জায়গায় ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। মৃত্যুর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে কবির মাথার ওপর দিয়ে এক ঝাঁক বক উড়ে যাচ্ছিল। কবি তাদের উদ্দেশে বললেন, ‘তোমরা হলে আমার হত্যার একমাত্র সাক্ষী। আমার হত্যার প্রতিশোধ তোমাদের নিতে হবে।’
অনেক দিন চলে গেল। কবির মৃত্যু একটা রহস্য হয়ে রইল। একদিন এক উন্মুক্ত রঙ্গমঞ্চে কোনো এক নাটকের অভিনয় চলছিল। এমন সময়ে হঠাৎ এক ঝাঁক বক মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যেতে দেখেই একজন অভিনেতা নিজের পাঠ বলার বদলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে ওঠে, ‘এই যে ইবিকাসের হত্যার প্রতিশোধকারীরা উড়ে যায়।’ এই উক্তি শোনামাত্র সচকিত রাজকর্মচারীরা সেই অভিনেতাকে আটক করে ইবিকাস হত্যা মামলা নতুন করে আরম্ভ করে। অবশেষে আসল হত্যাকারীরা ধরা পড়ে। কবির মৃত্যু রহস্যের কিনারা হয়।
আমি যখন ‘জীবজগতের লোকশ্রুতি’ বইয়ের বককে নিয়ে অধ্যায়টি পড়ছিলাম, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে তখন গুপ্তঘাতকরা কোনো এক বাউলকে হত্যা করে। আমার মাথায় তখন খেলে যায় ইবিকাসের কথা। তাকেও অজ্ঞাত কারণে গুপ্তঘাতকরা হত্যা করেছিল, বহু বছর পর হাজার হাজার মাইল দূরের বাংলাদেশের বাউলকেও গুপ্তঘাতকরা হত্যা করল। দুই হত্যাকাণ্ডের একটা ঐক্য খুঁজে পেলাম। গ্রিসের ইবিকাসকে কীভাবে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ফেলে একটা গল্প লেখা যায়, তা নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম।
এটাকে বিনির্মাণ বলা যেতে পারে। আমি ভাবতে থাকি…ভাবতে থাকি। ভাবতে ভাবতে গত বছরের জুন মাসের কোনো একদিন আমার মাথায় গল্পটির একটা অবয়ব দাঁড় করিয়ে ফেললাম। সেদিনই গল্পটি লিখতে শুরু করি। লিখতে দুদিনের বেশি লাগল না।
এ বইয়ের অন্যতম একটি গল্প ‘কুয়ার বাইরে’। গল্পের বিষয় সমমায়িক ঘটনাবলী। মাওলানা আবুল কাশেম ফেনবী গল্পের প্রধান চরিত্র। তিনি একটি কওমি মাদ্রাসার মুহতামিম (পরিচালক) এবং একটি ইসলামি মৌলবাদী সংগঠনের আঞ্চলিক নেতা।
তার ছেলে থাকে ইন্দোনেশিয়ায়। ঢাকার হাইকোর্টের সামনে থেকে তখন গ্রিক দেবী থেমিসের ভাস্কর্য সরানোর জন্য হেফাজতে ইসলামসহ সমমনা কয়েকটি ইসলামি রাজনৈতিক দল আন্দোলন করছে। ঠিক সেই সময়ে মাওলানা আবুল কাশেম ফেনবী ইন্দোনেশিয়ায় তার ছেলের কাছে বেড়াতে যায়। ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশ, অথচ সেদেশের এয়ারলাইন্সের নাম মহাভারতের পাখি গারুড়ার নামে। সেদেশে ভারতীয় পুরাণ ‘রামায়ণ’ মঞ্চস্থ হয়। সেদেশের রাজ্য বালিদ্বীপের সর্বত্র নানা ভাস্কর্য স্থাপিত। সেদেশের টাকার গায়ে হিন্দুদেবতা গণেশের মূর্তি আঁকা।
মাওলানা আবুল কাশেম ফেনবীর অবাক লাগে। মুসলিম দেশ, অথচ সংস্কৃতি কিনা সম্পূর্ণ আলাদা! এইসব ঘটনা তাকে দারুণ প্রভাবিত করে। দেশে ফিরে তিনি সম্পূর্ণ বদলে যান। ইসলামি মৌলবাদী সেই সংগঠন থেকে পতদ্যাগ করেন। তিনি বুঝতে পারেন, ধর্ম ও সংস্কৃতি যে সম্পূর্ণ আলাদা দুটি বিষয়।
গল্পটি লেখার পর প্রকাশের জন্য কোনো পত্রিকায় না দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম। মনে আছে, ১৩৮৯ জন পাঠক গল্পটিতে লাইক দিয়েছিলেন, মন্তব্য করেছিলেন ৩৫৬ জন এবং শেয়ার নিয়েছিলেন ৬৮৬ জন। বাংলাদেশ, কলকাতা, আগরতলা ও আসামের বিভিন্ন অনলাইন, মাসিক পত্রিকাসহ বাংলা ভাষার মোট ১৭টি পত্রিকায় গল্পটি প্রকাশ হয়। একজন পাঠক গল্পটির প্রিন্ট নিয়ে ৫শ ফটোকপি করে একটি ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠনের নেতাকর্মীদের কাছে পাঠিয়ে দেন। একটি গল্প নিয়ে পাঠকদের এমন উচ্ছ্বাস, এমন প্রশংসা সত্যিকারার্থেই আমাকে দারুণ আপ্লুত করেছিল। এর আগে কোনো গল্প লিখে এত সাড়া, এত প্রশংসা এবং এত পাঠক আমি পাইনি।
আপনার গল্প ও উপন্যাস পড়লে বোঝা যায় প্রচুর পড়েন। আপনার পাঠাভ্যাস সম্বন্ধে ‘চ্যানেল আই অনলাইনে’র পাঠকদের যদি ধারণা দিতেন…।
মানবসভ্যতা বিকাশে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে তার নাম বই। জ্ঞানসমুদ্রের কল্লোল শোনা যায় বইয়ের পাতায়। যুগে যুগে অনুসন্ধিৎসু মানবগোষ্ঠী তার যাতায়াতে যে বিচিত্র জ্ঞান আহরণ করেছে তারই লিখিত রূপ হচ্ছে বই। বইয়ের পাতার কালো অক্ষরে অমর হয়ে আছে জ্ঞানের চিরন্তন দ্যুতি। বইয়ের পথ মানে জ্ঞানার্জনের পথ। জ্ঞানকে প্রদীপের সঙ্গে তুলনা করা হয়।
আর সেই জ্ঞানের রহস্যময় ভাণ্ডার হলো বই। একজন মানুষ যখন পৃথিবীতে জন্মায় তখন সে মানুষের আকার নিয়ে জন্মালেও তাকে কি ঠিক মানুষ বলা যায়? না, বলা যায় না। সে তখন অন্যান্য প্রাণীর মতোই একটা প্রাণী মাত্র। মানুষের ইতিহাস জ্ঞানের ইতিহাস। জ্ঞানচর্চার মধ্য দিয়েই মানুষ মানুষ হয়ে উঠেছে। একটা শিশু তখনই প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠে, যখন সে নানা জ্ঞানে জ্ঞানী হয়ে ওঠে। সাধারণ প্রাণী থেকে মানুষে উন্নীত হওয়ার সিঁড়ি হচ্ছে বই। লেখক হওয়ার জন্য নয়, মূলত মানুষ হওয়ার জন্যই আমি বই পড়ি। আমি যেখানেই যাই আমার সঙ্গে একটি বই থাকে।
আমি যখন সাভারে থাকতাম, সাভার থেকে প্রতিদিন ঢাকার বাংলা মটরে অফিসে যাতায়াত করতাম। সাভার থেকে বাংলা মটরে আমার অফিসে আসতে সময় লাগত দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। যেতেও তাই। এই সময়টা আমি বাসে বসে বসে পড়তাম। পৃথিবীর বহু ক্লাসিক সাহিত্য আমি বাসে বসে পড়েছি। এখন আমি অফিসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে বই পড়ি, রাতে ঘুমানোর আগে বই পড়ি। একটানা এক সপ্তাহ বই না পড়লে নিজেকে মূর্খ মনে হয়। মূর্খতার কবল থেকে বাঁচতে আমাকে বই পড়তে হয়।
কোন গল্প বা উপন্যাস লেখার জন্য সবচে বেশি পড়াশুনা করতে হয়েছে? সেটা কেমন ছিল?
আমার মনে হয় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিয়ে রচিত ‘বেগানা’ উপন্যাসটি লেখার জন্য সবচেয়ে বেশি স্টাডি করতে হয়েছে। উপন্যাসটি লেখার আগে আমাকে মিয়ানমার সম্পর্কে জানতে হয়েছে, আরাকানের ইতিহাস জানতে হয়েছে। রোহিঙ্গাদের আচার-আচরণ, স্বভাব-চরিত্র এবং তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে বিস্তর গবেষণা করতে হয়েছে আমাকে। যেতে হয়েছে বাংলাদেশে বিভিন্ন রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিশতে হয়েছে। তাদের ভাষাটাকে আয়ত্ত করতে হয়েছে।
এছাড়া গত বছর প্রকাশিত উপন্যাস ‘শেষ জাহাজের আদমেরা’ লেখার সময়ও প্রচুর স্টাডি করতে হয়েছে। উপন্যাসটির বিষয় মালয়েশিয়ায় মানবপাচার। চার’শ বছর আগে মগ-ফিরিঙ্গিরা এ দেশের উপকূল থেকে মানুষদের ধরে নিয়ে দাক্ষিণাত্যের বন্দরে বন্দরে ইংরেজ-ফরাসি-ওলন্দাজ বণিকদের কাছে বিক্রি করে দিত। সেই মানবপাচার এখনো বন্ধ হয়নি। ধরন পরিবর্তন হয়েছে শুধু। দুই ধরনের মানবপাচারকে আমি একটি সুতোয় গাঁথতে চেয়েছি উপন্যাসটিতে। এজন্য আমাকে প্রচুর পড়তে হয়েছে। পড়তে হয়েছে সমুদ্র সম্পর্কেও। কারণ উপন্যাসটির পটভূমি বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সমুদ্র।
কালি ও কলম পুরস্কারপ্রাপ্ত উপন্যাস ‘রাজনটী’র দ্বিতীয় সংস্করণ আসছে এবার। বইটি প্রকাশের আগে কেমন প্রত্যাশা ছিল, কতটুকু পূরণ হয়েছিল?
উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ২০১১ সালে। একই বছর উপন্যাসটির জন্য আমাকে এইচএসবি-কালি ও কলম তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। পাঠকরাও গ্রহণ করেছেন উপন্যাসটি। এ যাবত যে কটি উপন্যাস লিখেছি, পাঠকদের সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া পেয়েছে এই উপন্যাসটির। হয়ত বিষয়বস্তুর কারণে পাঠকেরা এটিকে গ্রহণ করেছেন। প্রায় সোয়া দুই শত বছর আগের একজন নটী এবং তার অর্থে নির্মিত একটি মসজিদকে কেন্দ্র করে এমন বিষয়বস্তুর উপন্যাস পাঠকদের ভালো লাগারই কথা।
উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশের ছয় বছর পরের কথা। একদিন রাত করে বাসায় ফেরার পর পড়তে কিংবা লিখতে ইচ্ছে করছিল না। ক্লান্ত ছিলাম কিছুটা। আমার কোনো বই প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর সাধারণত পড়ি না। পেছনে ফিরে তাকাতে ইচ্ছে করে না। সেদিন কী ভেবে আলমিরা থেকে উপন্যাসটি নামিয়ে পড়তে শুরু করলাম। পড়তে পড়তে বিস্তর ভুলত্রুটি, শব্দপ্রয়োগ এবং বাক্যের দুর্বলতা চোখে পড়ল।
আমি পারতাম উপন্যাসটি পুনর্লিখন করতে। করলাম না। কারণ, আমি কী ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে লেখালেখির পথ অতিক্রম করেছি, তার সাক্ষী হিসেবে থাকুক উপন্যাসটি। পরবর্তীকালের পাঠক তাতে বুঝতে পারবেন আমার লেখালেখির ধারাবাহিকতা। তাই এই সংস্করণে কিছু শব্দ ও বাক্য সম্পাদনা ছাড়া বিশেষ কোনো পরিবর্তন করিনি। আশা করছি এতে উপন্যাসটি আরও সুখপাঠ্য হবে।
হোর্হে লুইস বোর্হেস ঠিকই বলেছিলেন, ‘যা কিছু আমি প্রকাশ করি তা সবই খসড়া। সব মৌলিক রচনাই অবিরাম সংশোধনযোগ্য।’ ভবিষ্যতে ‘রাজনটী’ হয়ত আবার সম্পাদনা করব, আবার সংশোধন করব। আমি আসলে নিজেকে ক্রমাগত ভাঙছি।
‘রাজনটী’ যখন প্রকাশের সময় এটা ছিল আপনার প্রথম উপন্যাস। দ্বিতীয় প্রকাশের সময় এটি পুরস্কারপ্রাপ্ত একটি বই। দুই প্রকাশের অনুভূতি কি আলাদা?
‘রাজনটী’ প্রথম প্রকাশের সময় বেশি আনন্দিত ছিলাম, সন্দেহ নেই। কারণ লেখালেখির শুরুর দিকের বই বলে কথা! তবে দ্বিতীয় সংস্করণের আনন্দটা অন্য রকমের। বইটা আমি সম্পাদনা করতে পেরেছি, এটা আমার জন্য অন্য রকমের এক আনন্দ। আর পুরস্কার নিয়ে আমার বিশেষ কোনো আনন্দ নেই। পুরস্কার আমার মধ্যে বাড়তি কোনো আনন্দ তৈরি করে না। করলেও এতদিনে সেই আনন্দ উবে গেছে।
পুরষ্কার পাওয়ার জন্য বিশেষ কোনো দিকে যত্ন নিয়ে লেখেন?
কোনো লেখকই পুরস্কারের জন্য লেখেন না। আমি তো নই-ই। লেখকের যদি লেখার শক্তি থাকে পুরস্কার তার পেছনে ছোটে, পুরস্কারের পেছনে তাকে ছুটতে হয় না। পুরস্কার আমার মুকুট নয়, মুকুটের পালকও নয়। পুরস্কারকে আমি বাহুল্য একটি পরিধান হিসেবে দেখি। যেমন আঙটি, যেমন গলার হার। পরলেও চলে, না পরলেও চলে। তবে প্রত্যেক পুরস্কারেরই একটা সামাজিক মূল্য আছে। আমি যা লিখছি তা আদৌ কিছু হলো কিনা, পুরস্কারের মধ্য দিয়ে তার একটা মূল্যায়ন ঘটে। পুরস্কারকে একটি সামাজিক স্বীকৃতিও বলা চলে। কিন্তু আমি লেখার সময় পুরস্কারের কথা মাথায় নিয়ে লিখি না। পুরস্কারের জন্য লেখার কোনো যত্ন নিই না।
পুরষ্কার আপনার মধ্যে কী ধরনের পরিবর্তন এনেছে?
লেখালেখিতে কোনো পরিবর্তন আনেনি। তবে একটা ব্যাপারে পরিবর্তন এসেছে। পুরস্কারগুলো পাওয়ার আগে টাকার অভাবে আমি পছন্দের বইগুলো কিনতে পারতাম না। পুরস্কারের টাকা দিয়ে এখন কিনতে পারি। পরিবর্তন শুধু এটুকুই।
তরুণদের স্বপ্নের সবকটি পুরষ্কার আপনার হাতে। পরবর্তী টার্গেট কী?
পুরস্কার নিয়ে আমার কোনো টার্গেট নেই। পুরস্কারের ব্যাপারটা কখনোই আমার মাথায় থাকে না। আমি লিখেছি, লেখার জন্য আমার বইকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। আমি না লিখে যে কেউ লিখলেই তাকে পুরস্কৃত করা হবে, যেহেতু পুরস্কারপ্রথা চালু আছে। পুরস্কারটি চালু রাখার জন্য কাউকে না কাউকে পুরস্কার দিতেই হবে, এটা আমাদের এখানে রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কখনো বলা হয় না, এ বছর মানসম্পন্ন বই পাওয়া যায়নি, তাই পুরস্কার দেওয়া গেল না। পুরস্কার কমিটি প্রতিবছরই মানসম্পন্ন বই পায়। তাদেরকে পেতে হয়। নইলে পুরস্কারটি জারি রাখা যাবে না। পুরস্কারপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে আমার আলাদা কোনো বিশেষত্ব তৈরি হয়নি।
আর যদি লেখালেখির পরবর্তী টার্গেটের কথা বলেন, তাহলে বলব, আমি এখন একটি উপন্যাস লিখছি। ২০১৩ সালের একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকে প্রকাশিত দুই কলামের একটি নিউজ পড়ে উপন্যাসটির আইডিয়া মাথায় এসেছিল। নিউজটির স্ক্রিনশট আমি মেইলের ড্রাফটবক্সে রেখে দিয়েছিলাম এমন ভাবনা থেকে―কোনোদিন হয়ত কাজে লাগবে, কোনোদিন হয়ত এ বিষয়ে একটি উপন্যাস লিখতে পারব। চার বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। লেখা হয় না। কী লিখব কিছুই ঠিক করতে পারি না।
এরই মধ্যে বেরিয়ে গেল দুটো উপন্যাস― কালকেউটের সুখ, শেষ জাহাজের আদমেরা। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি এক বিকেলে তরুণ সাংবাদিক ও গল্পকার হাবিবুল্লাহ ফাহাদসহ শাহবাগ মোড় থেকে আজিজ মার্কেটের দিকে যাচ্ছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে আলাপ করছিলাম পত্রিকার ঐ স্ক্রিনশটটি নিয়ে। কথা বলতে বলতে হঠাৎ কল্পচোখে ভেসে উঠল অন্ধকার রাত। গাঢ় অন্ধকারে একটা লোক দৌড়চ্ছে…দৌড়চ্ছে। এবং শুনতে পেলাম মাথায় খসখস শব্দ। একটি উপন্যাসের অধ্যায়গুলো আমার মাথায় যেন লেখা হচ্ছে। আমি তখন এতটাই বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলাম, ফাহাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুত বাসায় চলে এলাম। বাসার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে কানে বাজল, কে যেন বলছে, ‘শহরের সমস্ত ফুলের দোকান শূন্য হয়ে পড়েছে, সিটি কর্পোরেশনের তেত্রিশজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী টানা চব্বিশ ঘণ্টা ফুলের স্তূপ পরিষ্কার করেও কফিনটির সন্ধান পেল না।’
প্রায় পঁচিশ দিন কেটে গেল।
এক ছুটির দিনে পড়ছিলাম আঁদ্রে মোরোয়ার ‘লেখকের শিল্পকৌশল’ প্রবন্ধটি। সেখানে তিনি লিখছেন, “বিষয় নির্বাচন শেষ হয়ে গেলেই লিখতে আরম্ভ করা উচিত। পানিতে ঝাঁপ দেওয়ার সময়ে যেমন কেউ পূর্বাপর ভেবে ঝাঁপ দেয় না, পুস্তক লেখা আরম্ভ করার সময়েও ঠিক তেমনি পূর্বাপর না ভেবে ঝাঁপ দেওয়া উচিত। তীরে দাঁড়িয়ে ভাবনা চিন্তা করলে সাঁতার কাটা কোনোদিনই শেখা যায় না। একবার নেমে পড়লে সাঁতারু স্রোত ও পানির শীতলতার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে শিখে। প্রথম করণীয় হলো, কি করতে হবে তা স্থির করা। কেননা এ ছাড়া কোনো কাজই সমাপ্ত হতে পারে না। রচনা একবার আরম্ভ করলে, তার বৈশিষ্ট্য আপনা-আপনি ফুটে উঠবে।”
কথাগুলো আমাকে এতটাই অনুপ্রাণিত করল, সঙ্গে সঙ্গেই উপন্যাসটি লিখতে বসে গেলাম। মার্চের ১৫ তারিখ ছিল সেদিন।
১৭ তারিখের মধ্যে ২৭শ শব্দ লিখে মনে হলো কয়েকটি স্থান ঘুরে আসা দরকার। সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং একজন শুভাকাঙ্খীর সার্বিক সহযোগিতায় বিষয়সংশ্লিষ্ট কয়েকটি স্থান ঘুরে এলাম। ফিরে এসে আবার শুরু করলাম লেখা। বাংলাদেশের সাম্প্রতিকালে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর রাজনৈতিক ঘটনাকে ধারণকারী এবং মোটামুটি সমগ্রতাস্পর্শী এই উপন্যাসটি লিখে শেষ করতে হয়ত এক বছর, দু-বছর কিংবা তিন বছর লেগে যেতে পারে। ইতোমধ্যেই ৫০ হাজার শব্দ লেখা হয়ে গেছে। লেখা শেষ করে বেশ কয়মাস ফেলে রাখব। তারপর শুরু করব সম্পাদনা।
আপনার লেখা পড়লে বোঝা যায় অতি ক্ষুদ্র বিষয়ও আপনি গভীর ও গুরুত্বের সাথে দেখেন এবং লেখায় তা উপস্থাপন করেন। দেখার চোখটা তৈরি হলো কীভাবে?
লেখকের তো দেখার চোখ থাকতে হয়। সাধারণ মানুষ যে জিনিসটিকে একরকমভাবে দেখেন, লেখক দেখেন অন্যরকমভাবে। লেখক যদি অন্যভাবে দেখতে না পারেন, তবে তিনি লেখক কিসের? দেখার চোখটা আসলে তৈরি করে নিতে হয়। এই চোখ তৈরির জন্য দরকার মানুষের সঙ্গে মেশা, প্রকৃতির কাছে যাওয়া, ধ্যান করা এবং বই পাঠ করা। আপনি যত বেশি বই পাঠ করবেন ততই আপনার দেখার চোখটি শাণিত হবে। আমিও চেষ্টা করছি আমার দেখার চোখটাকে শাণিত করতে। কখনো বই পড়ে, কখনো মানুষকে পড়ে, কখনো প্রকৃতিকে পড়ে।
আপনার লেখায় দেখা যায় কঠিন বিষয় সহজভাবে ধরা দিয়েছে। সমন্বয়টা করেন কীভাবে?
আমার গল্প-উপন্যাসের বিষয়গুলো কঠিন কিনা জানি না। হয়ত কঠিন। আমি চেষ্টা করি কঠিনকে সহজভাবে লেখার। আমি মনে করি, যে যত বড় লেখক তার ভাষা তত সহজ।
এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু কী?
বিষয়বস্তু আপাতত গোপন থাকুক।
বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ কোথায়?
সাহিত্যের প্রতি তরুণদের প্রচুর আগ্রহ দেখতে পাই। আগ্রহ না থাকলে প্রতি বছর এত এত বই প্রকাশিত হতো না। তার মানে সাহিত্যচর্চা হচ্ছে। কিন্তু ফসলটা ভালো হচ্ছে না। আমার যে পাঠরুচি, সেই ধরণের বই খুব বেশি খুঁজে পাই না। তবে আশার কথা, চর্চাটা যেহেতু হচ্ছে, ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই ভালো ফসল হবে। একদিন বাংলাদেশ হবে বাংলা সাহিত্যের রাজধানী।
সম্পাদনা, গবেষণা, প্রবন্ধ, সৃজনশীল লেখা… কোনটাকে বেশি প্রাধান্য দেন। কেন?
গল্প-উপন্যাস তো সৃজনশীল লেখা। আমার প্রথম প্রাধান্য উপন্যাস, দ্বিতীয় গল্প। এছাড়া অন্য কিছু লেখার ইচ্ছে আপাতত নেই। এ দুটি মাধ্যমে লিখে আমি স্বস্তি পাই, সে কারণেই এ দুটিকে প্রাধান্য দিই।
কোন কোন লেখকের লেখা পড়লে তাদের মতো হতে ইচ্ছে করে?
কোনো লেখকের লেখা পড়ে আমার ইচ্ছে করে না তাদের মতো হতে। তাদেরকে ছড়িয়ে যেতে ইচ্ছে করে। ফকনারের লেখা পড়ে যেমন তাকে চেনা যায়, তলস্তয়ের লেখা পড়ে যেমন তাকে চেনা যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা পড়ে যেমন তাকে চেনা যায়, আমি চাই, আমার লেখা পড়ে পাঠক আমাকে চিনুক। আমি আমার মতো হতে চাই, অন্য কারো মতো নয়।
কেন লেখক হলেন?
মন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে কঠিন। সম্ভবত এরচেয়ে কঠিন প্রশ্ন আমার জন্য আর হতে পারে না। কেন যে লেখি! এর উত্তর আমার জানা নেই। প্রশ্ন যেহেতু করেছেন, অনুমান করে উত্তর হিসেবে এই কথাগুলো বলা যায় : আমি বিস্তর কথা বলতে চাই। কথা বলতে চাই বলেই গল্প-উপন্যাস লিখি। আমার কথার পরিমাণ এত বেশি যে, শিল্পের অন্য কোনো মাধ্যমে―যেমন কবিতা, নাটক, গান―ধরা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তাই আমি উপন্যাস লিখি। কিংবা এমনও হতে পারে, গল্প-উপন্যাসে আমি কথা বলতে যতটা স্বচ্ছন্দবোধ করি শিল্পের অন্য কোনো মাধ্যমে ততটা করি না, তাই আমি গল্প-উপন্যাস লিখি। কিংবা এমনও হতে পারে, গল্প শোনার আকাঙ্খা মানবসভ্যতার আদিম কাল থেকে আধুনিক কাল অবধি চলে আসছে। আমার রক্তের মধ্যে সম্ভবত সেই গল্পকারের রক্ত প্রবাহিত, আদিকালে যে গল্প শুনিয়ে মানুষকে বিমোহিত করত। আমি সম্ভবত তারই উত্তরাধিকারী। সেজন্যই আমি লিখি।