চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

আমার চ্যানেল: মুহম্মদ নূরুল হুদা

চ্যানেল আইয়ের ২৩ বছরে পদার্পণকে সামনে রেখে এক অভিনন্দন বার্তায় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেছেন: যেন চোখা এক ‘চ্যানেল আই’। হাইফেন দিয়ে দুটি চেনা ইংরেজি শব্দকে গেঁথে একটি যোটক শব্দে রূপ দেয়া যাক। তাহলে অর্থ দাঁড়াল কী? আমিই চ্যানেল? নাকি আমার চ্যানেল? যে যেমনটি বুঝবে বুজুক, আমি বুঝি ‘আমিই-চ্যানেল’। আর এই ‘আমার’ হৃদয়েই আছে বাংলাদেশ। চ্যানেল আই দেখি, দেখতে দেখতে শিখি।

শিখি আমার কৃষি, আমার নিশি, আমার প্রেম, আমার সাহিত্য, আমার নদী, আমার সংস্কৃতি, আমার ব্যক্তিক, সমষ্টিক, বৈশ্বিক সব সুকৃতির অভিব্যক্তি। আর এসবকিছুরই উৎস আমার দেশ, বাংলাদেশ। এই তো আমার হৃদয়ে স্ববিশ্ব ও স্বদেশ। এই তো আমার সরব গৌরব। এই তো আমার ধ্যানজ্ঞানের অপার আনন্দ। আর কী কী করে ‘আমার চ্যানেল’? উত্তরে বলতে হয়, কী করে না? কিংবা কী করবে না ভবিষ্যতে? আমার কেন যে কী মনে হয়, চ্যানেল আই মানে এক সর্বগ্রাসী কুড়ানিয়া। পাতাকুড়ানিয়া, শস্যকুড়ানিয়া, জীবনকুড়ানিয়া, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের সব ভালোমন্দ প্রবাহ কুড়ানিয়া। যা পায় তা-ই কুড়ায়; কখনো হাতে ধরা ক্যামেরার চোখে, কখনো অন্তর্লীন আমার চোখে। যা কিছু ধরে রাখে তাকে অমরত্ব দিতে চেষ্টা করে। যেমন করেছিল ১৯৯৯ সালে, যাত্রার শুরুতে।

তখন নজরুল জন্মশতবর্ষ পালিত হচ্ছে দেশে ও বিশ্বে। আমার সৌভাগ্য, আমি তখন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক। দুবছরব্যাপী নজরুল জন্মশতবর্ষ উদযাপনের সদস্যসচিব। এই দুবছরের কর্মকা-ের মধ্যে প্রায় প্রতিদিনই ছিল কোনো না কোনো অনুষ্ঠান। নজরুল ইনস্টিটিউটের সদ্যনির্মিত অডিটোরিয়াম থেকে শুরু করে শাহবাগে জাতীয় জাদুঘর, বাংলা একাডেমি, প্রতিটি জেলা সদর থেকে শুরু করে কলকাতা শান্তিনিকেতন- দিল্লী-লন্ডন হয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে অনুষ্ঠানমালা। সেই ঘোরলাগা মুহূর্তেই ফরিদুর রেজা সাগর ও শাইখ সিরাজ দুজনে মিলে প্রস্তাব করলেন, তারা আমাদের সব অনুষ্ঠান ধরে রাখতে চান। তার জন্য অনুমতি প্রয়োজন। না, কোনো অর্থ লাগবে না; রেকর্ড করা ও প্রচারের দায়িত্ব তাঁদের। আমরা সানন্দে রাজি হলাম। চ্যানেল আই তার ক্যামেরার চোখ দিয়ে সাধ্যমতো মূর্ত আঁধারে বিমূর্ত আকারে ধারণ করল জাতীয় কবির জীবন ও কর্মের নানা ভঙ্গি ও অভিব্যক্তি। তাঁর কবিতা-গান-নৃত্য, তাঁর তাবৎ সৃষ্টিকলা। আসলে ‘চ্যানেল আই’ এসেছিল এই সর্বভুক ব্রত নিয়েই। এই ব্রত বাংলার নন্দন-সংস্কৃতির ব্রত। মানুষের শুদ্ধাচারের ব্রত। বাংলাদেশকে সোনার বাংলা করার ব্রত। এ ব্রত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর। এ ব্রত আজ তাঁর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। এ ব্রত আজ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবাহিত সব বাঙালির। এ ব্রত আপনার আমার সব গণমানুষের।

বাংলা ভাষাকে, তার সৃষ্টিশীলতাকে বিশ্বের সর্বপ্রান্তে প্রসারিত করা চাই। যতদূর বাংলা ভাষা ততদূর প্রসারিত হোক বাংলা ও বাঙালির অন্তরের ঐশ্বর্য।

কথক যার পরিচয়, তার পরিচয় মূলত কথায়, অথবা গানে, অথবা সংগীতে। তার অবলম্বন উক্তি, শ্রুতি ও দ্যুতির ছন্দ। সেই ছন্দ ভর করে শরীরে ও মনে। ফলে নৃত্যময় হয়ে ওঠে তার অস্তিত্ব। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই ‘চ্যানেল-আই’ গান গায়। সেই গানে গানে সকালের শুরু, তারপর দিনের বিস্তার। সংগীত শুধু ব্যক্তিমনকেই শুদ্ধ করে না, গণমনকে আনন্দধারায় বিশোধিত করে। নবীন প্রবীণ সব শিল্পীর অংশগ্রহণে বাংলার লোকগীতি থেকে উচ্চাঙ্গ সব সংগীত-ঘরানা মানবমনের উৎকর্ষ বাড়ায়। সঙ্গে থাকে বাঁশি, বেহালা, আরো কত যন্ত্রধ্বনি। সব যন্তর এসে অন্তর বাজায়। অন্তরে অন্তরে গান আর গান। মাঠের গান, হাটের গান, নৃত্যের গান, চিত্তের গান বাদ যায় না কোনো গান।

গানের পরে আসে সংবাদ। সকালের সংবাদ। রাজধানীর সব প্রধান প্রধান সংবাদপত্রের প্রধান প্রধান সংবাদ। তাই নিয়ে জনমনে সচেতনতার বিস্তার। গানে-সংবাদে-সুখেদুঃখে বেঁচে থাকে মানুষ। রেওয়াজটা চালু হয়ে যায় সবমহলে। সবাই বানায় আধুনিকতম বায়োস্কোপ। তবে পথিকৃৎ হয়ে থাকে ‘চ্যানেল আই’। তার বিপরীতে আছে নিশিতর্ক। রাজনীতি থেকে প্রজানীতি, দাম্পত্য থেকে লাম্পট্য, পাত্রাধার থেকে তৈলাধার বাদ যায় না কোনো কিছু। টকঝাল ইষ্টিমিষ্টি সর্ব রসের টক-শো। গালগল্প থেকে গালাগাল, গালাগাল থেকে গলাগলি। কথায় কথায় কথা-কুস্তি। শো শেষে হাসতে হাসতে দুস্তি। এইতো গণতন্ত্রের কথ্যমন্ত্র। উসকে দেয় উপস্থাপক, লড়াই করে দুই বাক্যবাগীশ। সত্য ও মিথ্যা বারবার ঘরবদল করে। মিটিমিটি হাসে বহমান সময়। জয়, তর্কাতর্কের জয়।

কথায় কথায় যুক্ত নতুন কথা। নতুন শব্দ। নতুন বাকভঙ্গি। সমতা থেকে মমতা। দেশি শব্দের সঙ্গে ভিনদেশির মিতালি। একদেশের বুলির সঙ্গে অন্যদেশের গালি। মান যায় মান-ভাষার। প্রমিত ভাষায় যুক্ত হয় অশুদ্ধ প্রচলন; কত শব্দ সর্বনাশা।

তখন ঠেকানো চাই বিকৃতি। ইতিহাস বিকৃত হলে চাই ইতিহাসবিদ, ভাষা বিকৃত হলে ভাষাবিদ। আর বানান বিপর্যয় নিয়ে ‘চ্যানেল আই’ চালু করে ‘বাংলাবিদ’। শব্দটি নতুন, কিন্তু ভুল শব্দ নয়। এই কাজ স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি বা কোনো একাডেমির। তবে ‘চ্যানেল আই’ মনে করে এ কাজ তো তারও।

কেননা বিশেষ অঞ্চল থেকে সর্বাঞ্চলের ভাষা মুখে নিয়ে ভাষাসঙ্গম চলে এইসব আকাশ-চ্যানেলেই। তা থেকে জন্ম নেয় যে নতুন ভাষাশিশু, সে-ই হচ্ছে নতুন মন, নতুন তনু। তাকে লালনের দায়িত্বও নেয় চ্যানেল আই। তাই বাংলাবিদের সঙ্গী তর্কবিদ, আইনবিদ, আরো আরো কত বিচিত্র বিষয়বিদ। দিন যায়, মাস যায়, যুগ যায়। আসে কত অনলাইন, সকলেই নিজের নিজের কথা বলে। হাজার বার বলে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে, জনে জনে বলে। কথা যুক্তি ও অপযুক্তির হাত ধরে কেবল ফেননিভ হয়ে যায়। সংবাদ বরবাদ হয়ে যায়। তখন প্রয়োজন ‘টু দ্য পয়েন্ট’। আমার চ্যানেল তাকেও আমন্ত্রণ জানায়।
সব কিছুতে সেই তো প্রথম। অদম্য ‘চ্যানেল আই’, তার দমেরও শেষ নাই।

এভাবেই প্রতিবছর চ্যানেল আই ঘটাচ্ছে পালাবদল। চিরনতুনেরে দিচ্ছে ডাক। মন্তব্য করে নানা গুণী। ‘যারা চ্যানেল আইয়ের সঙ্গে আছেন তারা একেবারে ছোটবেলা থেকেই টেলিভিশনের সঙ্গে জড়িত।’ আমি তো দেখি যারা এই চ্যানেলে প্রবেশ করেন, তারা সেখানেই জীবনটা সঁপে দেন। ফলে এই চ্যানেলের যাত্রা মানে একটি সামষ্টিক পরিবারের সংঘযাত্রা।

সংঘশক্তিই মূল শক্তি। এই হৃদয় জুড়ে মাটি ও মানুষ। তার সঙ্গে আছে প্রত্যহের পরিবেশ, প্রকৃতি ও জীবন। আছে বাঙালির খানাপিনা, আছে কেকা ফেরদৌসীর রান্নাবান্না। আছে রবীন্দ্র-নজরুল-লালন ও তাদের পরম্পরা। নববর্ষ, বাঙালি, বইমেলার সঙ্ঘযাত্রা। আছে অমর একুশের মেলা থেকে সরাসরি সম্প্রচার। ক্ষুদে তারকার সঙ্গেও দর্শক-শ্রোতার দরাদরি। আছে ব্যবসা-বাণিজ্যের ভাবী নেতা। শেয়ার বাজারের নতুন ক্রেতা। আছে দর্শকপ্রিয় নানান অনুষ্ঠান। আর ভাগ্যলক্ষ্মীর সুখটান। দর্শকশ্রোতার হিরো, হিরোদের দর্শকশ্রোতা।

ঘটকের নাম চ্যানেল আই।

ভয় নাই, ওরে ভয় নাই। এই চ্যানেলে আমিও যখন তখন যাই।

গুডবাই, আপাতত গুডবাই।