বছরে বারো মাসের প্রতিটি মাসেরই গুরুত্ব এবং তাৎপর্য রয়েছে। তেমনি বছরের তৃতীয় (ইংরেজি) মাস মার্চ। মার্চ মাস আমাদের জাতীয় জীবনের বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ এবং ইতিহাস বিখ্যাত একটি মাস। মার্চ আমাদের জাতীয় জীবনে ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। পূর্ব বাংলার তথা পূর্বপাকিস্তানের তেইশ (১৯৪৭-১৯৭০) বছরের সম্পর্কে প্রায় সকলেই অবগত। তথাপি, মার্চের বৈশিষ্ট্য যেন বাঙালি জাতির জীবনে অদৃশ্য এক ভাস্কর্য হয়ে সমুন্নত শিরে দণ্ডায়মান!
যদি এমন হতো, বিশাল এক উদ্যান। মাঝখানে একটি জায়গা বৃত্তাকার। বৃত্তাকরের মাঝখানে উঁচু বেদিতে ৭ই মার্চের ভাষণরত বঙ্গবন্ধু। গোলাকারকে ঘিরে সাহসী নারী-পুরুষের হাতে উদীয়মান পতাকা ১৯৭১এর ২মার্চ সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা, পাক সেনার হাতে নিহত শিশু। বৃদ্ধের প্রতি গুলি বর্ষণ।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার জন্য আমরা যে সংগ্রাম চালিয়েছি তা মূলত ১৯৪৭-এর পর থেকেই সূচনা হয়েছে। আরো খানিকটা পেছনে গেলে বলা যায় ভারতবর্ষ নিয়ে আলোচনার এক সভায় ১৯৪০ সালে লাহোরে এক গোল টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়; যা লাহোর প্রস্তাব নামে খ্যাত। তৎকালীন কৃষক-প্রজা পার্টির নেতা শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক লাহোর প্রস্তাবের গোল টেবিল বৈঠকেই আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশকে একটি অখণ্ড স্বাধীন রাষ্ট্র দাবির প্রস্তাব পেশ করেছিলেন।
১৯৪৮ সালে বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নিয়ে শুরু হয় আমাদের সংগ্রাম। এরই ধারাবাহিকতা স্পর্শ করে ১৯৭১ সালকে।
১৯৪৭ সালের শেষ প্রান্তে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠিত হয়। ১১ মার্চ “বাংলাভাষা দাবি দিবস” হিসেবে কর্মসূচী পালনের বিশেষ ভূমিকা রাখে ছাত্র সমাজ। তৎকালীন ছাত্র নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। প্রতিবাদে ১২ মার্চ ও ১৫ মার্চ পর্যন্ত ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন চাপের মুখে বাধ্য হয়ে ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে ৮ দফা দাবি পূরণে স্বাক্ষর করেন।
১৯৪৮ সালের ১৯ শে মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন। ২১ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা দেন “উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” তার ঘোষণায় উপস্থিত জনতা না, না ধ্বনিতে চারদিক কম্পিত করে তোলে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবেশেও একই ঘোষণা দেন। যার ফলশ্রুতিতে ছাত্ররা প্রতিবাদমুখর হয়ে না, না বলে জিন্নাহর কথার প্রতিবাদ জানায়।
প্রতিবাদ মিছিল, স্লোগান (রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই) আর তাজা প্রাণের রক্তের স্রোতের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হলো বাঙালির প্রাণের ভাষা, মায়ের মুখের ভাষা বাংলা। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে কত না বেদনা সিক্ত আর প্রতিবাদমুখর-গান-কবিতা, গল্প উপন্যাস, নাটক। তেমনি একটি অমর গান, আব্দুল গাফফার চৌধুরীর রচনায়, আলতাফ মাহমুদ-এর সুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।
১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। যুক্তফ্রন্টে পূর্ব বাংলার জনগণ নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় ২১ দফা সনদ তৈরি করে। কিন্তু বাঙালিদের দাবিয়ে রাখতে পাকিস্তান সরকার ষড়যন্ত্রের পথ বেঁচে নেয়। ফলে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যায়। এভাবে পূর্ববাংলার জনগণ পাকিস্তান সরকারের বৈষম্য থেকে রক্ষা পেতে, নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে প্রাণান্তকর সংগ্রাম চালিয়ে যায়।
ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে, ১৯৫৪ এর যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা দাবি, আইয়ুব খানের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচী বাস্তবায়নের আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারে বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য রাজবন্দী নেতাদের মুক্তির দাবি, ১৯৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ তেইশ (১৯৪৭-১৯৭০) বছরের সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে বাংলার নিপীড়িত মুক্তিকামী মানুষ পৌঁছেছে ১৯৭১ সালের মুক্তির সংগ্রামে।
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ভুট্টো এক অধিবেশনের ঘোষণা দেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভুট্টো-ইয়াহিয়া ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে ৩ মার্চের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করার প্রতিবাদে শেখ মুজিবুর রহমানসহ সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারা দেশে হরতাল পালিত হয়।
চেতনায় উদ্ভাসিত ছাত্রনেতারা ২ মার্চ প্রথম বারের মতো বাংলার মাটিতে লাল-সবুজের (তখন আমাদের জাতীয় পতাকায় সূর্যের উপর লাল বৃত্তের মাঝখানে হলুদ রঙের কাপড়ে তৈরি বাংলাদেশের ম্যাপ ছিল) পতাকা উত্তোলন করতে সক্ষম হয়েছিল।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনার রেসকোর্স সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ভাষনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠীর প্রতারণার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন “প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলে। তোমাদের যার কাছে যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা কর। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দিব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। জয়বাংলা।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাংলার জনগণ দৃঢ় চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়। পূর্ব পাকিস্তানের সকল কার্যক্রম অচল প্রায় হয়ে যায়। রেডিওতে, ঘরে ঘরে, মানুষের মুখে মুখে চলতে থাকে জয় বাংলা বাংলার জয়; হবে-হবে হবে নিশ্চয়। কোটি প্রাণ একসাথে জেগেছে অন্ধকারে নতুন সূর্য দেখার এই তো সময়।
অবস্থা ভয়াবহ দেখে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত ভুট্রো-ইয়াহিয়া নানা অজুহাতে সময় অতিবাহিত করতে থাকে। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর হত্যা পরিকল্পনায় অপারেশন সার্চ লাইট নামক নীল নকশা তৈরি করে। হত্যাযজ্ঞের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ২৫ মার্চ রাতের ভুট্রো আর ইয়াহিয়া গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন।
২৫ মার্চ রাতের মধ্যেই ঘুমন্ত বাঙালির উপর শুরু হয় বর্বরোচিত গণহত্যা। বাঙালি জাতির ইতিহাসে ২৫ মার্চ কালরাত্রি নামে পরিচিত। কালরাত্রি অতিবাহিত (দিনের আলো ফোটার পূর্বে) হওয়ার পূর্বেই ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সমগ্র জাতি অর্থাৎ প্রায় সাড়ে সাত কোটি বাঙালিই পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
দুই লক্ষ লাঞ্ছিত আর ত্রিশ লক্ষ তাজা প্রাণের বিনিময়ে মাত্র নয় মাসে দেশ হানাদার মুক্ত হয়েছে। আমরা বিজয়ী হয়েছি। স্বাধীনতা অর্জন করে আমরা আজ স্বাধীন দেশের নাগরিক। ২৬ মার্চ আমরা স্বাধীনতা দিবস পালন করি।
সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গৌরবের মাস মার্চেই জন্মগ্রহণ করেছেন ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ ফরিদপুর জেলার (বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলা) টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন এবং আন্তর্জাতিক শিশু দিবস আমরা একই সাথে উদযাপন করে থাকি। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ১৭ মার্চ দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় আর আনন্দের সাথে পালন করা হয়।
২০১৮ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে জাতিসংঘ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশকেও একটি উন্নত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। যা আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ এবছরই (২০১৮) ঐতিহাসিক ভাষণ হিসেবে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যা জাতীয় জীবনে আমাদের অনেক বড় অর্জন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ থেকে কবি নির্মলেন্দু গুণ কবিতা রচনার করেছেন- স্বাধীনতা এ শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো….
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)