আজ ১৮ ডিসেম্বর, আন্তর্জাতিক অভিবাসন দিবস। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নানা আয়োজনে দিবসটি পালিত হচ্ছে। এবারের অভিবাসন দিবসে মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ‘অভিবাসীর অধিকার-মর্যাদা ও ন্যায়বিচার’। দিবসটি উপলক্ষ্যে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেছেন, অভিবাসী শ্রমিকরা যেনো কোনোরূপ শোষণ, বঞ্চনা ও হয়রানির শিকার না হয় তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেষ্ট থাকতে হবে।
প্রধনামন্ত্রী বলেছেন, মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের যে অর্জন সেখানে অভিবাসীদের বিরাট অবদান রয়েছে। অভিবাসন ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে অভিবাসন বিষয়ক আইনগত কাঠামো সংস্কারের এবং অভিবাসনে আগ্রহীদের আশানুরূপভাবে দক্ষ করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ চলমান রয়েছে।
আমাদের অর্থনীতির অন্যতম শক্তি হলো প্রবাসীরা। দেশের অর্থনীতির মহাবিপদের দিনেও অভিবাসীরা তাদের প্রেরিত রেমিট্যান্স দিয়ে অর্থনীতিকে নিরাপদ রেখেছেন। জাতীয় অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের অবদান অনস্বীকার্য। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ সালের কথাই ধরা যাক। বাংলাদেশি অভিবাসীরা ১৪৯৫৬.৭৩ মিলিয়ন ইউএস ডলার রেমিট্যান্স দেশে প্রেরণ করেন। যা মোট জাতীয় উৎপাদনের প্রায় ৭ শতাংশ। এ খাত থেকে অর্জিত অর্থ সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের ৯ গুণ এবং বৈদেশিক সহায়তার ৭ গুণ।
একথা সত্য প্রতিনিয়ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমাদের দেশের অভিবাসী কর্মীর সংখ্যা বাড়ছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস-২০১৮ উপলক্ষে প্রদত্ত বিএমইটির সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী সৌদি আরব, আরব আমীরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার, বাহরাইন, লেবানন, জর্ডান, লিবিয়া, সুদান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সাউথ কোরিয়া, ইটালি, জাপানসহ বিভিন্ন দেশে এ পর্যন্ত অভিবাসী মানুষের সংখ্যা প্রায় এক কোটির উপরে। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি কাজ করছে সৌদি আরব, আরব আমীরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কাতার, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন, লেবানন, সাউথ আফ্রিকা, সাউথ কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে। এর বাইরে আরো কিছু দেশ রয়েছে যেখানে বাংলাদেশের যুবশক্তি শ্রম বিক্রি করছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় প্রদত্ত হিসেবে ২০১৭ সালে মোট ১০ লাখ ৮ হাজার ৫২৫ জন কর্মী বাংলাদেশ থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মস্থান লাভ করে।
এ বছর এ পর্যন্ত (অক্টোবর) ৬ লাখ ১৪ হাজার ৫৮৫ জন কর্মী বিভিন্ন দেশে কাজ করার সুযোগ লাভ করে। এদিকে নারী কর্মী প্রেরণেও বেশ অগ্রগতি হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে নারী অভিবাসী ছিল ১ লাখ ২১ হাজার ৯২৫ জন। চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত নারী কর্মী গেছে ৮১ হাজার ২৫০ জন। মূলত জর্দান, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরবসহ বিশ্বের ৬৭টি দেশে বর্তমানে নারী কর্মীরা কাজ করছে। বৈশ্বিক নানা ঘটনা-প্রবাহ এবং নানা বাধা-বিপত্তির পরও প্রতিমাসে গড়ে যে পরিমাণ তরুণ-তরুণীর বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয় তা অবশ্যই উৎসাহব্যাঞ্জক এবং সাফল্যও বটে। এ জন্য অবশ্যই বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু একইসাথে এ কথাটিও উচ্চারণ করতে হয় আমাদের অভিবাসন খাত এখনও ‘দালাল’ নির্ভর হয়ে আছে। দালালদের দৌরাত্ম্য কোনো অংশেই কমেনি। দালাল ছাড়া যেনো এই খাত অচল। দালালদের দৌরাত্ম্যের কারণেই এই খাতের ব্যবস্থাপনাগত উন্নয়ন খুব একটা হয়নি। আবার দালালদের কারণেই এই খাতে অভিবাসন ব্যয় কমিয়ে আনাও সম্ভব হয়নি। এখনও তুলনামূলক হিসেবে আমাদের দেশের একজন শ্রম অভিবাসীর অভিবাসন খরচ সবচেয়ে বেশি। আর এ কারণে এমনটিই দেখা গেছে যে, একজন কর্মী বা শ্রমিক যে টাকা খরচ করে বিদেশ যায় চুক্তি মোতাবেক সে কাজ করে সেই খরচের টাকাই তুলতে ব্যর্থ হয়।
মালয়েশিয়া, সৌদি আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এরকম হাজার হাজার উদাহরণ রয়েছে। বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন ২০১৩ প্রণয়ন করা হলেও দালালদের তৎপরতা বন্ধ হয়নি। দালালরা আগের মতই সক্রিয় রয়েছে। একইভাবে রিক্রুটিং এজেন্সিসমূহের জবাবদিহিতাও সেভাবে নিশ্চিত হয়নি। দালালদের কারণে অনেক পরিবারকে পথে বসতে হয়েছে। অনেকে দালালের প্রলোভনে পড়ে জমি জমা বিক্রি করে টাকা পয়সা তুলে দিলেও দেখা গেছে আর বিদেশ যেতে পারেনি। এরকম অবস্থায় অনেকের অত্মহত্যার সংবাদও পত্রিকায় এসেছে। দালালদের সবচেয়ে বেশি প্রতারণার শিকার হয়ে থাকে নারীরা। নারী কর্মীদের সরলতার সুযোগ নিয়ে দালালরা নানা কৌশলে অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নেয়। দালালদের কারণে বহু নারীকে আজ পথে বসতে হয়েছে, নির্যাতিত হতে হয়েছে। অনেক নারী বিদেশে গিয়ে প্রতিশ্রুতিমতো চাকরির সুরক্ষা না পেয়ে চোখের জল সম্বল করে দেশে ফিরে এসেছে। অনেকে নারীকে সৌদি আরব, লেবাননসহ কয়েকটি দেশে বিভিন্ন বাড়িতে রেখে দালালরা দিনের পর দিন শারীরিক, মানসিক অত্যাচার করেছে।
তবে অভিবাসন খাতে ‘দালাল’ বা ‘উপ-দালাল’ প্রতিপালন করে থাকে মূলত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোই। কিছু কিছু বৈধ-অবৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি আছে যারা পুরোটাই দালাল নির্ভর। মূলত তাদের নিয়োগকৃত দালালরাই বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে কর্মী সংগ্রহ করে আনে। দালালরা সংগৃহীত প্রতি কর্মী বাবদ এজেন্সিগুলোর কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট কমিশন যেমন পেয়ে থাকে, তেমনি আবার নানা প্রলোভন দেখিয়ে তারা গোপনে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে থাকে। বেশিরভাগ দালালই অভিবাসী হতে ইচ্ছুক কর্মীদের কাছে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করেন। বেশি বেতন আর সুযোগ সুবিধার কথা বলে তারা অভিবাসী হতে ইচ্ছুকদের আয়ত্তে নেয়। এরপর পাসপোর্ট তৈরি, মেডিকেল টেস্ট, সত্যায়ণ, ভিসা ক্রয় এরকম নানান খাত দেখিয়ে সবখান থেকেই অতিরিক্ত টাকা আদায় করে নেন। দালালদের খপ্পড়ে সবচেয়ে বেশি পড়ে লেখাপড়া না জানা অদক্ষ কর্মীরা।
বর্তমানে সারাবিশ্বের কর্মী রিসিভিং দেশগুলো এখন আর আগের মতো অদক্ষ বা নন স্কিল্ড কর্মী নিতে চায় না। জনশক্তির বাজার ভীষণ রকম প্রতিযোগিতামূলক হওয়ার কারণে দক্ষ বা স্কিল্ড কর্মীর চাহিদাই বেশি। কিন্তু অনেক বছর পেরিয়ে গেলেও স্কিল্ড কর্মী তৈরিতে আমরা এখনও সক্ষমতা দেখাতে পারেনি। স্কিল্ড কর্মী তৈরিতে সরকারি বেসরকারি কিছু উদ্যোগ দৃশ্যমান থাকলেও তার কাভারেজ ততোটা বেশি নয়। বিএমইটির আওতায় এ পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় ৬৪টির মতো কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। এদিকে বেসরকারি উদ্যোগেও বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চলমান রয়েছে। কিন্তু নানা প্রচার-প্রচারণা সত্ত্বেও প্রশিক্ষণ না নিয়ে অনেকেই দালালের উপর ভর করে বিদেশে পাড়ি দেওয়াটাকেই বেশি পছন্দ করে। জনশক্তি প্রেরণে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সরকার অনুমোদিত একটি বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিকে অনেকগুলো শর্ত ও ধাপ সম্পন্ন করে একজন কর্মীকে বিদেশে প্রেরণ করতে হয়। কর্মী প্রেরণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সির মাঝে যেমন প্রতিযোগিতা রয়েছে তেমনি রয়েছে অধিক মুনাফা লাভেরও প্রত্যাশা। অনেক রিক্রুটিং এজেন্সি বিভিন্নভাবে মনোপলিও করে থাকে। তবে অনেক রিক্রুটিং এজেন্সি আছে যারা সরকারের আরোপিত শর্ত ও গাইডলাইন ধরে কর্মী প্রেরণ করে থাকে। যেখানে কর্মীর চাকরির নিশ্চয়তা, সুযোগ-সুবিধা, বেতন এগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। যারা অনেকটাই দালালমুক্তভাবে কর্মী প্রেরণ করে থাকে।
আমাদের অভিবাসন খাতের বিষফোঁড়া হলো দালালরা। দালালদের যদি একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও আইনী কাঠামোর মধ্যে না আনা হয় তাহলে এই খাতের অনেক অনিয়ম ও ত্রুটি বন্ধ করা সম্ভব হবে না। একইভাবে অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়ে উঠবে না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)