বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিজড়া সম্প্রদায়ের সদস্যরা বলছে: তারাও মানুষ, অন্যান্য মানুষের মতো তাদেরও ভালোবাসা পেতে মন চায়। তবে এ ভালোবাসা কেবল তরুণ-তরুণীর ভালোবাসা নয়, তাদের প্রতি একটু সহানুভূতিশীল ও মানবিকতার ভালোবাসা।
তাদের দাবি: অন্যান্য মানুষের মতো আমাদেরও সমস্ত প্রয়োজনীয়তা ও অনুভূতি আছে। কিন্তু আমরা পরিবার-পরিজন, মা-বাবা, সমাজ-রাষ্ট্র সবকিছু থেকেই বিচ্ছিন্ন। যে ভালোবাসা ছাড়া কোন মানুষ বাঁচতে পারে না তা থেকেও আমরা বঞ্চিত। আমাদেরও ভালোবাসা পেতে মন চায়।
বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়েছে মেহেদি উৎসবের। হিজড়া সম্প্রদায়ের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে মেহেদি উৎসবের আয়োজন করে হিজড়াদের পরিচালিত ‘সাদাকালো কমিউনিটি বেজড অর্গানাইজেশন’।
দিনব্যাপী উৎসবে মেহেদির রঙে রাঙিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সাথে ভালোবাসা বিনিময় করেন হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা। হাতে মেহেদি লাগানোর ফাঁকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অনেক কথোপকথন হয়।
এসময় তারা বলেন: আমরা আসলে মানুষের একটু ভালোবাসা চাই। মানুষ যেন আমাদের ভালোভাবে গ্রহণ করে। আপনারা যদি আমাদের প্রতি একটু ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেন, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন, অন্য দশজনের মত আমরাও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারি।
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে যেন পিছিয়ে পড়া হিজড়া সম্প্রদায়ের জন্য কোটা রাখা হয় শিক্ষকদের প্রতি এমন আহ্বান জানিয়ে তারা বলেন: আমাদের পড়ালেখার সুযোগ নাই, চাকরির সুযোগ নাই, একটা বাসা ভাড়া পর্যন্ত আমরা পাই না। এভাবে যখন আমাদের কোনঠাসা করে রাখা হয় সমাজে, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তখন বাধ্য হয়েই অন্য পথ বেছে নিতে হয়।
এসময় হিজড়া জনগোষ্ঠীর এক স্বাবলম্বী সদস্য সামিউল আলম শাম্মী বলেন: আমিও একসময় মানুষের কাছে গিয়ে টাকা তুলতাম। কিন্তু আমার ভালো লাগতো না। যখন ঢাকার এডিশনাল ডিআইজি হাবিবুর রহমান স্যার বললেন তুমি কাজ করতে চাও কিনা? আমি একটা বিউটি পার্লার করার চিন্তা করলাম। উনার সহযোগিতায় আজ আমি বিউটি পার্লার দিয়ে স্বাবলম্বী। আমার বিউটি পার্লারে এখন চারজন হিজড়া কাজ করছে।
শাম্মী আরও বলেন: আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা এ আয়োজন করেছি। কারণ এখানের শিক্ষার্থীরাই একসময় দেশের বড় বড় জায়গায় যাবেন। তখন আমাদের সম্পর্কে তাদের যেন কোন ভুল ধারণা না থাকে।
সকালে আয়োজনের উদ্বোধনী ঘোষণার সময় অধ্যাপক ড. মোজাম্মেল হক বলেন: বিশ্ববিদ্যালয়ে এরকম একটি উৎসবের আয়োজন করা যাবে কখনো ভাবিনি। যখনই প্রস্তাব পেয়েছি, স্বানন্দে গ্রহণ করেছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা খুবই ভালো, তারা আপনাদেরকে ভালোভাবে গ্রহণ করবে। আপনারা কখনো নিজেদেরকে আলাদা ভাববেন না। আপনারা আমাদের এই সমাজেরই অংশ।
আয়োজনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকা নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রেজোয়ানা করিম স্নিগ্ধা বলেন: আমরা যাদের হিজড়া বলে দূরে ঠেলে দেই, নেতিবাচক ধারণা পোষণ করি তারাও কিন্তু আমাদের মতই মানুষ। সমাজের নিচু স্তর থেকে উঁচু স্তর পর্যন্ত অধিকাংশ মানুষই তাদের ব্যাপারে ভুল ধারণা পোষণ করে। এ আয়োজনের উদ্দেশ্য সে ভুল ধারণাটা ভেঙে দেওয়া।
তিনি আরও বলেন: আজকে এখানে তৃতীয় লিঙ্গের যে মানুষেরা এসেছেন এরা সবাই স্বাবলম্বী, কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। একসময় এরাও কিন্তু মানুষের কাছে গিয়ে টাকা তুলতো। কিছু উদার মানুষের সহযোগিতায় এরা এখন বিউটি পার্লার দিয়ে, ট্রেইলারি হাউজ দিয়ে নিজেরাই জীবিকা উপার্জন করছে। আমরা এটাই দেখাতে চাই যে, ভালোবাসা দিলে, সমাজে সুযোগ দিলে এরাও অনেক কিছু করতে পারে।
নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধার সঞ্চালনায় এতে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের শুভেচ্ছা ও একাত্মতা ঘোষণা করে কথা বলেন উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ফিরোজা হোসেন, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শামীমা সুলতানা লাকি, দর্শন বিভাগের অধ্যাপক এ এস এম আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া, সহকারী অধ্যাপক সৈয়দ নিজার আলম, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আনন জামান, ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পিংকী সাহা ও পারভিন জলি।