‘আমলা নয় মানুষ সৃষ্টি করুন ‘- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিখ্যাত এই উক্তির নমুনায়ন ও প্রভাব আমরা প্রায়শই প্রত্যক্ষ করে থাকি। আর তা থেকে সহজেই অনুমেয় হয় যে, কতটা আক্ষেপ আর ক্ষোভের কারণে বঙ্গবন্ধু উল্লেখিত উক্তিটি করেছিলেন।
আমলাদের ক্ষমতার সামান্য ছাপ সম্প্রতি সারা বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে; সরকারের একজন উর্দ্ধতন আমলার অপেক্ষায় ফেরি ঘাট থেকে ছেড়ে যায়নি নির্দিষ্ট সময়ের ফেরী যার পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাম্বুলেন্সেই প্রাণ গেল স্কুলছাত্রের মর্মে দেশের প্রায় সবক’টি পত্রিকা খবর ছেপেছে। অথচ ওই আমলা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের জনগণের ট্যাক্স ভ্যাটের টাকায় বেতন-বোনাস দেওয়া হয়। স্বাভাবিকভাবে তাদের উচিত জনগণের সেবক হওয়া কিন্তু উল্টো তারা শোষকের ভূমিকায় উত্তীর্ণ হয়, বিষয়টা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের সাথে স্পষ্টতই অশালীন ও অবান্তর। কিন্তু এই অবান্তর বিষয়টি আমাদের দেশে চলে আসছে নিয়মের মতোই দীর্ঘদিন ধরেই।
বিষয়টা কতটা হৃদয় বিদারক! অ্যাম্বুলেন্সে থাকা তিতাসের স্বজনেরা ঘাটের কর্তৃপক্ষকে ফেরি ছাড়তে শত অনুরোধ জানানো স্বত্বেও ঘাট কর্তৃপক্ষ সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তার দোহাই দিয়ে ফেরি ছাড়া বন্ধ রাখে এবং স্কুল ছাত্র তিতাসের মৃত্যু হয় এ্যাম্বুলেন্সেই। বিষয়টা কি দাঁড়ালো? স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টিও নেই আমাদের।
তিতাসের পরিবার কিভাবে এই শোক সহ্য করবে? হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণের পর মৃত্যু হলে সেটাও অভিভাবকদের মনে আক্ষেপ সৃষ্টি করে (পরিবারের যে কোন সদস্যের মৃত্যুই অনাকাঙ্খিত ও আক্ষেপের) কিন্তু তিতাসের অস্বাভাবিক মৃত্যু স্বাভাবিকভাবেই পরিবারের মনে দীর্ঘদিন ধরে আক্ষেপ এবং দ্রোহের সৃষ্টি করবে এবং আমৃত্যু উক্ত পরিবারটিকে যন্ত্রণা ও অপরাধবোধে ভোগাবে নি:সন্দেহে। কেননা, তারা তাঁদের প্রিয় তিতাসের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারেনি আমলাতান্ত্রিক শোষণ ও নিপীড়ন ব্যবস্থাপনার কারণে।
উপরোক্ত ঘটনার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও আলোকপাত থেকে বেশ কয়েকটি ইস্যুর অবতারণা হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, সরকারি আমলাদের এহেন গর্হিত চরিত্রের উদাহরণের অনেক কিছুই হয়তো সংবাদমাধ্যমে আসে না, তাই সব কিছুই আমাদের গোচরীভূত হয় না। তবে যে গুলোই সংবাদমাধ্যমে আসছে সেসব ঘটনাই আমাদের শঙ্কিত ও ভয়ের মধ্যে রাখছে সর্বদা।
১. বাংলাদেশের আমলারা সাধারণত ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকেন (অবশ্য সবাইকে এক পাল্লায় মাপা ঠিক হবে না, সকলেই অভিযোগের দোষে আদিষ্ট নয়)। আইন সবার জন্য সমান এ বিষয়টি বিশেষ করে আমলাদের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখা যায়। আমরা বেশ কয়েকবার পত্রিকার পাতা ও টেলিভিশনের মাধ্যমে জানতে পেরেছি, ক্ষমতার অপব্যবহার করে উল্টো পথে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন সরকারের উচ্চপদস্থ আমলারা। বেশ কয়েকদিন আগে অনুষ্ঠিত ডিসি সম্মেলনে সরকারের নিকট ডিসিগণ কর্তৃক উদ্ভূত দাবি দাওয়া নিয়ে জনমনে ব্যাপক বিভ্রান্তি ও ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়। গ্রামে গঞ্জে একটি প্রবাদ আছে, “যে বনে যায় সেই বাঘের রূপ ধারণ করে”।
আমলারা রাষ্ট্রের সব নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে থাকে বিধায় সব কিছুই নিজেদের সুবিধামতো করার চেষ্টা করে এবং রাষ্ট্রও সেখানে মৌন সম্মতি প্রদান করে থাকে। সম্প্রতি নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জ-২০১৮ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয়ীদের রেখেই যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ছয়জন কর্মকর্তা। কেমন আজগুবি কাহিনী, যাদের জন্য আয়োজন তাদেরকে রেখেই আমেরিকা সফরে চলে গেলেন আমলারা। অবশ্য এই আমলারাই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা পালন করে থাকে!
২. মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব পরিমন্ডলে ব্যাপক সুনাম ও সুখ্যাতি অর্জন করেছে। কিন্তু গতকালের ঘটনায় ঘাট কর্তপক্ষ যে নজির রেখেছে সেটি মানবিক বাংলাদেশের বিপরীত সূচক নির্দেশ করে থাকে। ঘাট কর্তৃপক্ষের একবারের জন্যও অসুস্থ তিতাস ও তার আত্নীয়স্বজনের আহাজারির কথা মনে আসেনি। সরকারি কর্মকর্তার মৌখিক আদেশকে তারা সরকারের নির্দেশ বলে মেনে নিয়ে বাকি সব কিছুকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছে।
অবশ্য তাদেরই দোষ কিসে! তারা প্রতিনিয়ত সরকারের আমলার হুকুম মেনে চলতেই বদ্ধপরিকর। তবে তারা যে অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে, আমার মনে হয় ফেরীঘাটে যারা লিজ নিয়ে দায়িত্ব পালন করে থাকে তারা প্রত্যেকেই সাধারণ জনগণের সাথে অমানবিকতার পরিচয় দিয়ে থাকে। মানুষ কতটা অসহায় হয়ে পড়েছে ফেরী কর্তৃপক্ষের নিকট গতকালের চিত্রটি কিন্তু আমাদের সে কথাটিই মনে করিয়ে দেই।
৩. এইযে তিতাস পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল, তাকে তো আর ফিরে পাওয়া যাবে না। আমরা তিতাসের বিদেহী আত্নার মাগফেরাত কামনা করি এবং তার শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই। তবে এরূপ ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে না ঘটতে পারে সে জন্য আপামর জনগণের জন্য যুগোপযোগী ও কল্যাণকর উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। আইন সবার জন্য সমান এর প্রয়োগ রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে চলমান ও চর্চা করতে হবে। আমলা হোক আর যেই হোক কারোর জন্য কোনরূপ বাড়তি সুবিধা দেওয়ার কোন বিধান স্বাধীন বাংলাদেশে চলতে দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্র এবং কারণ সাপেক্ষে রাষ্ট্রে লিখিত প্রজ্ঞাপনের ভিত্তিতে বিশেষ সময়ে সুবিধা প্রদান করা যেতে পারে, অন্যথায় নয়।
৪. তিতাসের এই মৃত্যুর জন্য দায়ীদের শাস্তি কি হতে পারে? প্রচলিত আইন এবং বিধি মোতাবেক উক্ত আমলার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণ অবশ্যম্ভাবী। সেইসঙ্গে অর্থদণ্ডও নেয়া যেতে পারে ক্ষতিপূরণ হিসেবে।
৫. পাশাপাশি ফেরী ঘাট ইজারা নেওয়া কর্তৃপক্ষের ইজারা বাতিল করে আইন ও বিধি মোতাবেক শাস্তি প্রদান করতে হবে। যদি তাদেরকে শাস্তি ও জরিমানার আওতায় আনা যায় তাহলে সারা বাংলাদেশে একটি মেসেজ দেওয়া সম্ভব হবে যে, রাষ্ট্র সকলের এবং সবার জন্য আইন সমান। যে কেউই ক্ষমতার অপপ্রয়োগ ঘটিয়ে অবৈধ সুবিধা ভোগ করবে তাকেই শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা হবে এমন বার্তা সকলের জন্য দৃষ্টান্ত ও উদাহরণ হয়ে থাকবে।
কাজেই, কতিপয় আমলাদের যে দৌরাত্ন দেশের বিভিন্ন জায়গায় লক্ষ্য করা যায় তা থেকে পরিত্রাণের জন্য এখন থেকেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী হয়ে পড়েছে। অন্যথায়, আমলাদের আমলাগিরি (নেতিবাচক) বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণকে সহ্য করতে হবে। উন্নয়নের যে ধারা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বহমান রয়েছে সে ধারাকে অব্যাহত ও সুশাসন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে সকলের জন্য আইনের শাসনের প্রয়োগবিধি ঘটাতে হবে।
অন্যথায়, সকল উন্নয়ন বুমেরাং হয়ে যাবে; পাশাপাশি মানবিক উন্নয়নের বিকাশ ঘটাতে হবে মানবিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বার্থে। সবিশেষ এই কামনা করি, তিতাসের মতো যেন কাউকে অনাকাঙ্খিত মৃত্যুবরণ করতে না হয়। রাষ্ট্রকেই সকল নাগরিকের জন্য সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। পরিশেষে, প্রত্যেক পরিবারের অভিভাবকদের নিকট সবিনয়ে অনুরোধ জানাই আমরা যেন ছেলেমেয়েদের নৈতিক শিক্ষায় বলীয়ান করে পরিপূর্ণ মানবিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে গড়ে তুলতে পারি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)