দাউদ হায়দারের লেখা এক কবিতা নিয়ে সরব সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম। কবিতাটিতে যেমন অশ্লীলতার অভিযোগ তুলছেন অনেকে, তেমনই কেউ কেউ মনে করছেন কোনো বিশেষ একজনকে আক্রমণ করে লেখা হয়েছে কবিতাটি।
নারীবাদী লেখিকাদের নিয়ে লেখা সেই কবিতা প্রসঙ্গে নারী বিষয়ক ওয়েবপোর্টাল উইমেন চ্যাপ্টারের সম্পাদক সুপ্রীতি ধর চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, আসলে বুঝতে পারছি না কী বলবো! কারণ এটা যদি কবিতা হয়, তাহলে এতোদিন ধরে যে কবিতা পড়ে এসেছি, তাকে অপমান করা হবে। যা-তা লিখলেই তা কবিতা হয় না। নোংরা আবর্জনাময় ভাষা দিয়ে একটা কিছু লিখলাম, আর তা কবিতা হয়ে গেল, তাতো হয় না।
দীর্ঘদিন যাবত জার্মানিতে নির্বাসিত রয়েছেন এই লেখক, ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়’ কবিতাটি লেখার কারণে সবার রোষের শিকার হন তিনি। এরপর দীর্ঘদিন তাকে নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। সুপ্রীতি ধর মনে করেন, অনেকদিন ধরে তাকে নিয়ে কোনো আলোচনা নেই, সেখানে ফিরতেই এই অপচেষ্টা। তবে এটা যদি উনি বিশেষ কাউকে উদ্দেশ্য করেও লিখে থাকেন, তাহলেও আমি বলবো, সব মেয়েদের জন্যই অপমানজনক। উনার বর্ণনা, লেখার ঔদ্ধত্য সবটাই পুরুষতান্ত্রিক। এটা কোনো সাহিত্যের ভাষা না।
একই কথা বলছিলেন এটিএন নিউজের হেড অব নিউজ প্রভাষ আমিন। চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা আমরা সবাই বলি। কিন্তু মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলে অনেকসময় আমরা বা সিনিয়ররা এমন সব কথা বলি যেগুলো আসলে বলার যোগ্য নয়। নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে কিন্তু আপনাকে অবশ্যই দেশের আইন-কানুন মেনে মত প্রকাশ করতে হবে। নিজের বিবেকের অধীনে থাকতে হবে। আর শালীনতা শব্দটিই আমাদের সংবিধানে রয়েছে। আইনে হয়তো নিজের পোশাক আশাক নিয়ে কিছু বলা নেই, কিন্তু আমি কি চাইলেই যেকোনোভাবে অফিসে চলে যেতে পারি। সেখানে কিছু ম্যানার্স মেনে চলার বিষয় রয়েছে। ক্ল্যাসিক অনেক সাহিত্যেও অশ্লীলতা রয়েছে। কিন্তু সেটাকেই সেখানে পরিমার্জিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এত নোংরাভাবে সেটা কখনোই করা হয়নি। বা এমন কখনো হয়নি যে সেটা পড়ে গা ঘিনঘিন করেছে।
দাউদ হায়দারের প্রকাশিত এই কবিতার ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার প্রসঙ্গ আসলে সুপ্রীতি ধর বলেন, এখন তো অনলাইনে কতজন কতকিছু লিখছে, কিছুই করা যায় না মোটের ওপর। তারপরও উনি যদি জেনে থাকেন কতটা ঘৃণা উনি কামিয়েছেন এই লেখার মধ্য দিয়ে, যদি ন্যুনতম অনুশোচনাও তার ভিতরে জাগে, তাহলেই এটা তার জন্য শাস্তি হবে। নির্বাসিত কবি হিসেবে তার প্রতি যে শ্রদ্ধা ছিল, তা এক পলকেই খসে যাবে, তাও মনে করি না, কিন্তু উনার সম্পর্কে এখন আর ভাবনাগুলো যে ইতিবাচক হবে না, তা বলতে পারি।
প্রভাষ আমিন বলেন, দাউদ হায়দারের লেখাটি পড়লে বোঝা যায় তিনি ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে কবিতাটি লিখেছেন। কোনো একজনকে আক্রমণের জন্য লিখেছেন। তার অন্যান্য কবিতা ভালো। কিন্তু তার বয়স ও অবস্থানে থেকে এই কবিতাটা ঠিক যায় না। তবে কবিতাটির ব্যাপারে আমরা যেমন সমালোচনা করতে পারি বা তাদের অনুরোধ করতে পারি। কিন্তু মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রয়োজনে আমরা তার কবিতাটি উইথড্র করতে বলতে পারি না।
দাউদ হায়দার একজন বাংলাদেশী বাঙালি কবি, লেখক ও সাংবাদিক, যিনি ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে দেশ থেকে নির্বাসনের পর বর্তমানে জার্মানিতে নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন। সংবাদের সাহিত্যপাতায় ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎসায় কালো বন্যায়’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। তাঁর প্রথম কাব্য গ্রন্থের নাম ছিলো,‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ।’ তার কবিতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে মৌলবাদী গোষ্ঠী প্রচণ্ড প্রতিবাদ শুরু করে।
তৎকালীন বঙ্গবন্ধুর সরকার দাউদ হায়দারকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়। ১৯৭৩ সালে কবিকে নিরাপত্তামূলক কাস্টডিতে নেয়া হয়। ১৯৭৪ এর ২০ মে সন্ধ্যায় তাকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং ২১শে মে সকালে বাংলাদেশ বিমানের একটা রেগুলার ফ্লাইটে করে তাকে কলকাতায় পাঠানো হয়। ওই ফ্লাইটে তিনি ছাড়া আর কোনো যাত্রী ছিল না। এরপর জার্মানির নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক গুন্টারগ্রাসের সহযোগিতায় ২২ শে জুলাই ১৯৮৭ সালে তিনি জার্মানির বার্লিন শহরে যান এবং তারপর থেকে সেখানেই আছেন। তার প্রকাশিত বইগুলো হলো: সংগস অব ডেস্পায়ার (১৯৯২) এই শাওনে পরবাসে (১৯৮২) বানিশম্যান্ট (১৯৭৯) আমি পুড়েছি জ্বালা ও আগুনে (১৯৮২) এলোন ইন ডার্কনেস অ্যান্ড আদার পোয়েমস (১৯৭৮) জন্মই আমার আজন্ম পাপ(১৯৭৩) ইত্যাদি।