জীবনানন্দের আবার আসিব ফিরে নয় ‘আবার’ এসেছে ফিরে। ৯০ দশক। শব্দে সুরে রকে কিংবা মেলোডিতে বাংলাদেশের ব্যান্ডের টগবগে ফুটে ওঠা কণ্ঠগুলো আবার এসেছে ফিরে সিডিবন্দী হয়ে। সিডিহীন সময়ে। নতুন শব্দে নতুন সুরে। ফিরে এসেছেন তারা স্মৃতিকাতর নব্বই দশকে কৈশোর কাটানো আজকের এক প্রকৌশলী যুবকের প্রানান্তকর প্রয়াসে। কেবল সময় সংরক্ষণের তাগিদে।
৯০ দশকের ৩৩ ব্যান্ডের ৩৮ জন শিল্পীর কণ্ঠে ৪১ টি গান প্রকাশিত হয়েছে এক মোড়কে ৩ সিডিতে। ‘আবার’ শিরোনামে। যদিও উদ্যোগী তরুণের ইচ্ছা ছিল ৫০-৬০ টি ব্যান্ড এর গান থাকবে। তা সম্ভব হয়নি অর্থ, কারো কারো অনাগ্রহ এবং কারো সময়স্বল্পতার কারণে। যারা গেয়েছেন কেউ নেননি পারিশ্রমিক। যে ব্যান্ড এবং কণ্ঠ উঠে এসেছে অ্যালবামে তা হল আশিকুজ্জামান টুলু (আর্ক), ওমর খালিদ রুমি (বাংলাদেশ), আনজুম আরা (ব্লু বার্ডস), নিলয় মোরশেদ(ব্লু হরনেট), ঝলক (ব্লু ওশান), নিকোলাস (কেইডেন্স), মেজবা ও পিয়াল (ডিফারেন্ট টাচ), কামাল (ডিজিটাল),স্বপন চৌধুরী (ড্রিমল্যান্ড), ফিডব্যাক (রোমেল ও লাবু রহমান), মনিটর (শামীম), মিউজিক টাচ (তুহিন), নিউ ইভস (নাসির), অডেসি (ইমতিয়াজ বাবু), অরবিট (আশরাফ বাবু), অভেশন (ইতু), পেপার রাইম (সাদ), পালস (কাজল), রেনেসাঁ (নকিব খান), স্পার্ক (ইকবাল), স্টারলিং (মামুন), স্পারটান (পান্নি), সাডেন (আগুন), নেক্সাস (নাজিব), নর্দান স্টার (মাহমুদ জুয়েল), তরুণ ব্যান্ড (তরুণ মুন্সী), তীর্থক (আইকো), দ্যা কিউ (রেশাদ মাহমুদ), দ্যা ওয়ার্ডস (তানিম মুন্সী), উইনিং (চন্দন ও রঞ্জন), উইন্ডস (আতিক হেলাল) এবং একক শিল্পী সাইফ।
যাত্রা হল শুরু
খুলনার শঙ্খ মোড় থেকে টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে ৩৫ টাকার ফিতার ক্যাসেটে ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’ কিংবা ‘স্কুল পলাতক মেয়ে’র কৈশোর। সোল্, নোভা, ফিডব্যাক, চাইম, রেনেসা কিংবা উইনিং প্রমিথিউস। কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যের মধ্য গগণে প্রকৌশলীর পেশাগত জীবনেও এ নেশা কাটেনি। বাংলাদেশের গান শোনা। বিশেষ করে সেই হারানো ৯০ দশক। সে তাড়না থেকে একক প্রচেষ্টায় ফেসবুকে জন্ম হয় আশিক মিউজিকের। ২০১৩ সালের ১০ জানুয়ারী। যার হেড অ্যাডমিন গহর আশিক। ৪০ বছরের যুবক আজ। যিনি তার বিয়ের চতুর্থ দিনে স্ত্রীর কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন একগাঁদা গানের অডিও অ্যালবাম পুরনো সময়ের। এমনই আসক্তি তার বাংলাদেশের পুরনো গান সংগ্রহে।
পেজটিতে মূলত পুরনো দিনের বাংলা গান সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হত। ব্যান্ড, সিনেমা, আধুনিক, লোকজ বাংলা এবং ক্ষুদ্র জাতিস্বত্ত্বার ভাষার গানের সংগ্রহশালাও এই আশিক মিউজিক। টেপ ক্যাসেট থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গানগুলোকে ডিজিটাল মাধ্যমে রূপান্তর করতে করতে সংগ্রহশালায় এখন রয়েছে ৫০০০ অ্যালবাম। যেখানে রয়েছে বাংলাদেশের প্রথম প্রকাশিত অডিও অ্যালবাম এমএ শোয়েব এর বেস্ট অব এম এ শোয়েব, দ্বিতীয় অ্যালবাম কুমার বিশ্বজিৎ এর অ্যালবাম সহ পাঁচ সহস্র অ্যালবাম।
সেই সংগ্রহ থেকে প্রায় প্রতিদিন ফেসবুক পেজে শেয়ার হয় সেসব গান। সঙ্গে থাকে গানগুলোর পেছনের গল্প, ব্যান্ডগুলোর কথা, গানের মানুষদের নিয়ে নানা তথ্য।
প্রসঙ্গ ‘আবার
‘আবার’ অ্যালবামের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে গহর আশিক চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘পেজ চালাতে গিয়ে মনে হল, ৯০ দশকের লিজেন্ডদের গলায় যদি নতুন গান শোনা যায় তাহলে কেমন হয়? পাশাপাশি এখনকার প্রজন্ম সেই সময়ে এ দেশের ব্যান্ডের ইতিহাস সম্পর্কে বেশ অজ্ঞ। ৯০ দশকের বাংলাদেশের ব্যান্ড বলতে তারা হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি ব্যান্ডের নাম জানে যা খুব দুঃখজনক। মাত্র ৬/৭টি ব্যান্ডের ওপর ভর করে বাংলাদেশের ব্যান্ড আজ এই অবস্থানে আসেনি। মজার ব্যাপার হলো, অনেকেই এ সব ব্যান্ডের জনপ্রিয় গান দিয়ে এখন স্টেজ মাতায় কিন্তু তারা সে সব ব্যান্ড কিংবা সেই গান কার গাওয়া ছিল তা জানে না। ফলে ভাবলাম তাহলে অ্যালবাম ও নতুন গানের সূত্র ধরে সেই সময়ের শিল্পীদের নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘পুরনো অ্যালবাম সংগ্রহ ও সংরক্ষণের পথ পরিক্রমায় অনেক শিল্পীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ হয়েছে। এমন অনেক শিল্পী ছিলেন যাঁদের নিজেদের কাছেও ছিল না প্রকাশিত অ্যালবাম। তাঁরাও এই পেজের সূত্র ধরে নিজেদের অ্যালবাম সংগ্রহ করেছেন। স্বভাবত একটা যোগাযোগ তৈরী হয় তাদের সঙ্গে। পাশাপাশি ফেসবুকের মাধ্যমেও অনেকের খোঁজ পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ব্যান্ডের ওমর খালেদ রুমি এবং ফিডব্যাকের ফোয়াদ নাসের বাবু ভাই অসম্ভব সাহায্য করেছেন অনেককে খুঁজে পতে। ‘আবার’ অ্যালবামটি করার প্রস্তাব দেওয়া হলে অধিকাংশ শিল্পী এবং ব্যান্ড একবাক্যে রাজি হয়ে যান।’
সে সময়ের অনেক তারকা শিল্পী এই অ্যালবামে নেই কেন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ইচ্ছা ছিল সবাইকে নিয়ে প্রায় ৫০/৬০ টি ব্যান্ডসহ অ্যালবামটি করব। তবে যারা আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন, শুধু তারা আছেন অ্যালবামে। অনেকেই ব্যস্ততার কারণে গান দিতে পারেননি। অনেকে আগ্রহ প্রকাশ করেননি। এটাতো হতেই পারে। সব চাওয়াতো আর পূর্ণ হয় না। তবে আমার চেষ্টা রয়েছে সে সময়ের বাকীদের কণ্ঠেও নতুন গান আনার। সবমিলিয়ে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এতজন শিল্পীকে একত্রিত করাটা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জটি পার করেছি আমরা।
‘আবার’ অ্যালবামটিকে শুধু গানের সিডির ভেতর সীমাবদ্ধ না রেখে ইতিহাসের অংশ করার চেষ্টা বিদ্যমান। দেশের প্রবীণ ও প্রথিতযশা সংগীতশিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে বাংলাদেশের ব্যান্ডের শুরু থেকে এযাবত্কালের ধারাবাহিক বিভিন্ন তথ্য কয়েক পাতা জুড়ে দেওয়া হয়েছে এ অ্যালবামে। এ প্রসঙ্গে ফিডব্যাকের প্রধান ফোয়াদ নাসের বাবু বলেন, ছেলেটি যা করেছে বা করে চলেছে তা ইতিহাস হয়ে থাকবে। কারণ আগামী প্রজন্ম যখন বাংলাদেশের ব্যান্ডের ইতিহাস বা বাংলাদেশের অডিও ইন্ডাস্ট্রির তথ্য খুঁজবে তখন ‘আবার’ এবং ফেসবুক পেজ আশিক মিউজিকের দ্বারস্থ হতে হবে। যা আরো আগেই আমাদের সময়েরই কারো করা উচিত ছিল।
রেকর্ডিংয়ের চ্যালেঞ্জ
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল বিদেশে থাকা শিল্পীদের দিয়ে গান করানো। গহর আশিক বলেন, ‘অ্যালবামের ৩৩ ব্যান্ডের বেশির ভাগ শিল্পী প্রবাসে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে কি ধরণের গান তারা দেবেন সে চাওয়াটা জানানো হয়েছে এবং শিল্পীরাও তা বুঝেই গান করে পাঠিয়েছেন। কয়েকজন শিল্পীর গান এখান থেকে মিউজিক ট্র্যাক করে পাঠানো হয়েছিল আর তাঁরা ওখান থেকে ভয়েস দিয়েছেন। কয়েকজন শিল্পী অবশ্য দেশে বেড়াতে এসে গানের কাজ করে দিয়েছেন। সেই সময়ের প্রতিটি ব্যান্ড ও শিল্পীদের নিজস্ব একটা ধরণ ছিল। এই অ্যালবামের কম্পোজিশনে সেই ব্যাপারটিকেই বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। যেন সকলের স্বকীয়তা বজায় থাকে।
গহর আশিক আরো বলেন, প্রধানতম সমস্যা ছিল স্পন্সর সমস্যা। উল্লেখযোগ্য কোনো স্পন্সর নেই অ্যালবামে। মাইক্রোসফট, ফ্লোরা সিস্টেম্স, এমিনেন্ট ট্রেডিং, মেরিডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল, স্পৃহা, স্টার টেক এবং টোটো অনেকটা সহযোগিতা করলে নিজের বেতন আর ধার-দেনা করে বের হয়েছে এই অ্যালবাম। সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল এতে যাঁরা গান করেছেন কেউই কোনো পারিশ্রমিক নেননি।
অবশেষে সিডি
গানগুলোর প্রকাশনায় বিভিন্ন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের কাছে গেছেন আশিক। কেউ তেমন আগ্রহ দেখায়নি। ফলে নিজেই একটি অডিও পরিবেশনা এবং প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান নিয়ম মেনে শুরু করেন। বর্তমানে গানের বাজার মূলত অনলাইনভিত্তিক। কিন্তু লাভের কথা চিন্তা না করে অডিও সিডি করার সিদ্ধান্ত নেয় প্রতিষ্ঠানটি। এখন দেশে সিডি-ক্যাসেটের দোকান নেই বললেই চলে। Ashik Music ফেসবুক পেজ ভিজিট করলে অ্যালবাম পাওয়ার উপায় জেনে নেওয়া যাবে। সিডির সঙ্গে প্রচ্ছদ ও পোস্টারের প্রসঙ্গও চলে আসে। অ্যালবামের প্রতিটি শাখায়ই সে সময়ের মানুষদের অংশগ্রহণ রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। সে সময়ের অ্যালবামগুলোর জনপ্রিয় ডিজাইনার হুমায়ুন কবিরকেও খুঁজে বের করে আশিক মিউজিক। এই অ্যালবামে থাকা প্রতিটি ব্যান্ডের কিছু তথ্য অ্যালবাম কাভারে যুক্ত করা হয়েছে।
নিজস্ব ওয়েবসাইট www.ashikmusic.com থেকেও অ্যালবামের অডিও গান নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে নামিয়ে শোনা যাবে।