করোনা আতঙ্কে বাংলাদেশ। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশের মানুষও যুদ্ধে যেন নেমেছে করোনা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে, নিজের পরিবারকে মুক্ত রাখতে-সর্বোপরি দেশকে মুক্ত রাখতে। এ যুদ্ধে আমাদের জয়ী হতেই হবে।
কেন জানুয়ারি মাস থেকে আমাদের বিমানবন্দরগুলোতে বিদেশ ফেরতদের কোয়ারেন্টাইনে নেয়া হয়নি? কেন অবলীলায় লাখ লাখ বিদেশ ফেরতদের দেশে ঢোকার সুযোগ দেয়া হলো? এ বিতর্কে যাওয়ার অবশ্যই অনেক যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে, তারপরেও বর্তমান বাস্তবতায় ওই বিতর্কের চেয়ে বেশি প্রয়োজন নিজে সচেতন থাকা, অপরকে সচেতন রাখা। ভুল যা হবার হয়ে গেছে। যার খেসারত আমাদের দিতে হচ্ছে, হয়তো অনেককাল দিতেও হবে।
বিশ্বের অনেক দেশের মত বাংলাদেশেও লকডাউন চলছে। একাত্তরে আমাদের যুদ্ধটা ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। এবারকার যুদ্ধ হচ্ছে ঘরে থেকে নিজেকে সুরক্ষা করা, নিজের পরিবারকে সুরক্ষা করা। পাশাপাশি অন্যদেরকেও ঘরে থাকার পরামর্শ দেওয়া।
ঘরে থাকা কারো জন্যে আনন্দের। আবার কারো জন্য নিরানন্দের। আনন্দ তাদের, যাদের টাকা পয়সার অভাব নেই। তিন মাসের খাবার কেনা হয়ে গেছে যাদের। এক বস্তার জায়গায় তিন বস্তা চাল কেনা হয়েছে। তিন কেজি গরুর মাংসের জায়গায় ১০ কেজি কেনা হয়েছে। এভাবে প্রত্যেকটা জিনিস কেনা হয়েছে তিনগুণ-চারগুণ করে। শুধু পরিবার-পরিজনকে নিয়ে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোবে আর ঘরের বাইরে বেরুলে মাস্ক পরে থাকলেই চলবে।
কিন্ত ঘরে থাকা যাদের জন্যে নিরানন্দের? তারা কি করবে? কোথায় থেকে চাল আসবে? কোথায় থেকে ডাল আসবে? তরকারি আসবে? তাদের কথা কেউ কি ভাবছে? যারা গার্মেন্টসে চাকরি করে, তাদের কি হবে? যারা তরকারি বিক্রি করে, রিকশা চালায়, সিএনজি চালায়, বাসের কন্ডাক্টার, ড্রাইভার তাদের কি হবে? তাদের কথা ভেবেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি তাঁর জাতির উদ্দেশে ভাষণে স্পষ্ট করে বলেছেন, নিম্ন আয়ের মানুষের পাশে দাঁড়াতে। যাদের কোনো জমানো টাকা নেই। তারা যেন খাবার পায় ঠিকমত।
আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ আছেন যাদের রয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ। তারা কি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন না এই ক্রান্তিকালে?
ইতোমধ্যে আমরা জেনেছি আমাদের ১৭জন ক্রিকেটার করোনাভাইরাস প্রতিরোধে নেমেছেন। তহবিল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন তারা। তাদের মাসিক বেতনের ৫০ শতাংশ দেবেন এই তহবিলে।
তাদের এই উদ্যোগের মত এনজিও প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসতে পারে। এগিয়ে আসতে পারে দেশের অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও। ব্যক্তি পর্যায়েও অনেক রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, সাংসদসহ নেতারাও এগিয়ে এলে আর খাওয়ার চিন্তা করতে হবে না রিকশাচালক-বাসচালকসহ নিম্ন আয়ের মানুষদের।
করোনা ভাইরাসকে মোকাবিলা করাই এ মুহূর্তের প্রধান কাজ। আর সেজন্য জনগণকে সচেতন করার দায়িত্ব সরকারসহ স্বেচ্ছাসেবি সামাজিক সংগঠনগুলোর। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমাদের অনেক বড় বড় এনজিও প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। যারা এদেশের মানুষের মাঝে ঋণ নিয়ে দ্বিগুণ তিনগুণ করে আদায় করেছে, করছে- তাদেরকে এই দুর্যোগের সময় দেখা যাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে না হাজার হাজার কোটি টাকা কামিয়ে নেয়া মোবাইল কোম্পানিগুলোকেও।
সরকারের এই ক্রান্তিকালে কোথায় সেই ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ ? যাদেরকে আমরা দেখে থাকি সরকারকে তোয়াজ করার জন্যে কোটি কোটি টাকা খরচ করে টেলিভিশন আর পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। নাকি এই করোনাভাইরাসের ক্রান্তিকালে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ালে তাদের কোনো ফায়দা হবে না, ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নতি ঘটবে না-এটা ভেবে দূরে সরে আছে এখনও।
কোথায় সেই ঋণখেলাপিরা? যারা হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে নিয়ে ফেরত না দিয়ে দিব্যি পায়ের ওপর পা তুলে এখনো বসে আছে আরামদায়ক চেয়ারে, সসম্মানে। সরকারকে নানাভাবে সাত-পাঁচ বুঝিয়ে ঋণখেলাপিদের নানা প্রণোদনার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তারাই। এবারের করোনাভাইরাসের কারণেও ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়িয়ে জুন করা হয়েছে তাদের জন্যে। তারাওতো এই সময় সাধারণ মানুষের পাশে আসতে পারে।
সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারেন সরকার দলীয় অনেক নেতারা। যারা গত ১০/১১ বছরে সরকারের ছত্রছায়ায় শত শত কোটি টাকা কামিয়ে বৈধ করে ফেলেছেন। তাদের মধ্যে থেকে দুই একজন শুধু ধরা পড়েছে ক্যাসিনো অভিযানে। বাকিরা রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। অনেকে আবার পদপদবী পেয়ে আসীন হয়েছে ক্ষমতার অনেক উচুতে। তারা কি এই করোনাভাইরাসের সময়- যাদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে, তাদের পাশে এসে দাড়াতে পারেন না?
অনেকেই আজ বলাবলি করছে দেশের এই লকডাউন অবস্থা বেশিদিন চললে যাদের ঘরে খাবার থাকবে না, তাদেরকে সামাল দিতে পারা যাবে না। মানুষের পেটে যখন খাবার থাকে না, সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে হুশ-জ্ঞান হারিয়ে ফেলে যা-ইচ্ছে তা-ই করতে কোনো প্রকার কুণ্ঠাবোধ করেনা। আর তখনই সমাজে ছিনতাই রাহাজানি-ডাকাতি বেড়ে যায়। কেউ বাজার করে নিয়ে যাচ্ছে দেখে দৌড়ে এসে ছিনিয়ে নিতেও কোনো প্রকার চিন্তা-ভাবনা করার মত জ্ঞান থাকবে না।
আমরা সেই অবস্থা দেখতে চাই না। আমরা যেমন একাত্তরের সেই ভয়াল দিনগুলোতে এক হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করেছিলাম,এখনো এই করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সবাই সবাইর জন্যে সুরক্ষা থাকবো। আমার কারণে অন্য কেউ যেন আক্রান্ত না হন, এই মানসিকতা গড়ে তুলবো। শুধু নিজে সুরক্ষা থাকলে চলবে না। অন্য যার সুরক্ষা থাকার সামর্থ নেই তাকেও সুরক্ষা থাকার উপকরণসামগ্রী বিনামুল্যে বিতরণ করার মানসিকতা গড়ে তুলি। যার ঘরে খাবার নেই তাকেও খাবার তুলে দিই। যেমন সাহায্য করেছিল একাত্তরে অনেক দেশ আমাদের।
আর যারা সাহায্য করবে না তারা পরোক্ষভাবে একাত্তরের সেই ঘৃণ্য মানুষগুলোর মতোই আমাদের মনে জায়গা পাবে, সারাজীবন। কারণ বিপদের সময়টাতেই প্রকৃত বন্ধুর পরিচয় পাওয়া যায়-সেই বহুল প্রচলিত বাণীটিই আমাদের মনে পড়ছে।
এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)