চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

আপনি শতায়ু হোন এটিএম শামসুজ্জামান

বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান। সকল শ্রেণিপেশার দর্শকদের মাঝেই একনামেই তিনি পরিচিত। তার নামের সঙ্গে অভিধা যোগ করতে হয়না। তিনি নিজেই এক প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ অভিনয় জীবনে নানামুখী চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি দর্শকদের হৃদয় যে আসন গেড়েছেন সেটা চিরস্থায়িত্ব পেয়েছে ইতোমধ্যেই। এখনও তিনি আছেন অভিনয়ে। তবে কিংবদন্তি হতে, স্মরণীয় হতে আর কোন চরিত্রে আর কোন নাটক-চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে হতো না তার; এমনই এক ব্যক্তিত্ব তিনি।

তাকে চলচ্চিত্রের মানুষ বলতে পারেন কেউ, কেউ বলতে পারেন নাটকের মানুষ, কেউ বলতে পারেন পরিচালক, কেউ বলতে পারেন চিত্রনাট্যকার, সংলাপকার বলতে পারেন কেউ, কেউবা আবার বলতে পারেন গল্পকার কিংবা অন্য কোন ভূমিকার মানুষ। যে যেই কথা বলুক না কেন সবকথাই সত্য। তিনি এমনই। জাত অভিনেতা তিনি। যেখানে তার পদস্পর্শ পেয়েছে সেখানেই সোনা ফলেছে। যে চরিত্রেই তিনি নিজেকে উপস্থাপন করেছেন সে চরিত্রই দর্শকের হৃদয়ে দাগ কেটেছে। তিনি স্মরণকালের বড় শিল্পী, বড় অভিনেতা। তার নামটাই একটা স্মারক। তিনি এটিএম শামসুজ্জামান।

আমাদের সৌভাগ্য সেই ছোটবেলায় দেখেছি তার অভিনয়। ছোটবেলা থেকে কৈশোর থেকে যৌবন; সকল পর্যায়েই তাকে দেখে আসছি। বলা যায়, তার অভিনয় দেখে দেখে আমরা বড় হয়েছি। আমাদের সময়ের পরিবর্তন হয়েছে, রুচির পরিবর্তন হয়েছে, জানাশোনার কালের পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু তার অভিনয় সকল পর্যায়েই ছিল চিরায়ত সুন্দর, হৃদয়স্পর্শী। আমাদের পরিবর্তন হয়েছে ঠিক, কিন্তু তার পরিবর্তন হয়নি। মনে হয় জন্ম থেকেই অভিনেতা তিনি; তা না হলে সকল বয়সে, সকল সময়ে একটা মানুষ এত প্রিয় চরিত্রের অংশ হয় কী করে?

সেই এটিএম শামসুজ্জামানকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায়ই মাতামাতি হয়। এই মাতামাতি শব্দটা হয়ত প্রাসঙ্গিক হতো যদি এই আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকত তার পেশাগত জীবন নিয়ে। প্রাসঙ্গিক হতো এই আলোচনা যদি সীমাবদ্ধ থাকত তার অভিনয়শৈলী নিয়ে, প্রাসঙ্গিক হতো যদি এই আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকত তার সৃষ্টিকর্ম, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে। কিন্তু সেটা থাকে না, থাকছে না। বারবার তিনি আলোচনায় আসছেন অনাকাঙ্ক্ষিত এক গুজবের মধ্য দিয়ে। এবং এই গুজবটা দুঃখজনকভাবে তার মৃত্যু নিয়েই গুজব।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একশ্রেণির বিকৃত মানসিকতার লোক প্রায়ই তার মৃত্যুর সংবাদ প্রচার করে। এই প্রচারকারীরা একবার নয় বারবার এই মৃত্যুর গুজব প্রচার করেছে। এবং প্রতিবারই বিব্রত এই শিল্পী ও তার পরিবার বলছে- এটা গুজব। ভাবা যায়, একটা জলজ্যান্ত মানুষকে এভাবে বারবার মৃত বানিয়ে দেয় কিছু লোক। এটা একবার নয়, বারবার; হিসাব করে বলা কঠিন কতবার। তবে এবার এটিএম শামসুজ্জামান নিজেই বলছেন সংখ্যা অন্তত ১০-১২। কে জানে এই সংখ্যা আরও বেশিও হতে পারে!

এবার যখন সর্বশেষ তার মৃত্যুর গুজব ছড়াল একদল লোক তখন বিব্রত ও ব্যথিত এটিএম শামসুজ্জামান বলছেন- ‘মরিনি এখনও। এর আগেও ১০–১২ বার আমার মৃত্যুর খবর ছড়িয়েছে। কেন যে এ রকম করে বুঝি না। আমার সঙ্গে কীসের শক্রতা, বুঝি না।’ জানা যাচ্ছে, এটিএম শামসুজ্জামান সুস্থ আছেন। তার মৃত্যুর খবর যখন রটে যায়, তখন তিনি সূত্রাপুরের বাসায় ছিলেন। নিজের মৃত্যুর খবর শোনার পর এটিএম শামসুজ্জামান বিরক্তি আর ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তার স্ত্রী রুনি জামান বলেন, ‘সন্ধ্যার পর হঠাৎ চারদিক থেকে ফোন আসা শুরু হয়। সবাই জানতে চাইছে, এ টি এম শামসুজ্জামান সাহেব কখন মারা গেছেন। আমরা রীতিমতো অবাক, দেশের এই দুর্যোগের সময় একটা জলজ্যান্ত মানুষকে এভাবে মেরে ফেলতে পারে!’ তিনি আরও বলেন, ‘এটা সত্য যে মাঝে দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন এটিএম শামসুজ্জামান। মাঝে নানা দফায় পুরান ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। গেল বছরের এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহের এক রাতে বাসায় অসুস্থ হয়ে পড়েন এটিএম শামসুজ্জামান। সেদিনও খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। সেই রাতে তাকে রাজধানীর গেণ্ডারিয়ার আজগর আলী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এটিএম শামসুজ্জামানের অন্ত্রে প্যাঁচ লেগেছিল। সেখান থেকে আন্ত্রিক প্রতিবন্ধকতা। এর ফলে খাবার, তরল, পাকস্থলির অ্যাসিড বা গ্যাস বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং অন্ত্রের ওপর চাপ বেড়ে যায়। ফলে বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দেয়। তার দেহে অস্ত্রোপচার করা হয়। এরপর কিছু শারীরিক জটিলতা হয়। টানা ৫০ দিন এই হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে ১৫ জুন তাকে শাহবাগের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নেওয়া হয়। কিছুদিন সেখানে ছিলেন। গেল বছর ঈদও কেটেছে হাসপাতালের কেবিনে। অবস্থার উন্নতি হওয়ায় তাকে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে আবারও কয়েকবার তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে অবস্থার উন্নতি হলে তারা আবার সূত্রাপুরের নিজের বাড়ি ফিরে যান। আপাতত সেখানেই আছেন। আজও (শুক্রবার) তিনি বাড়িতে সুস্থ, স্বাভাবিক আছেন। [প্রথম আলো, মে ১৫, ২০২০]

এটিএম শামসুজ্জামানের মেয়ে কোয়েল আহমেদ বলেছেন, ‘বাবার মৃত্যু নিয়ে গুজব নতুন নয়। আজকে (শুক্রবার) সন্ধ্যা থেকেই বেশকিছু ফোন পেয়েছি! বাবার মৃত্যুর গুজব শুনে আবারও চমকে গিয়েছি! নিজের বাবার মৃত্যু নিয়ে গুজব আর কতো সহ্য করা যায়! এমনিতেই রোজা রমজানের দিন, তারউপর বর্তমানে দেশ ও মানুষের যা অবস্থা এমন পরিস্থিতিতেও যারা একজন জীবিত মানুষকে নিয়ে গুজব ছড়ায়, তারা কারা? তাদের মানসিকতাই বা কেমন? এরকম খবর শুনলে আমাদের পরিবারে যে কী ধরনের সিচুয়েশন তৈরি হয়, এটা যদি যারা গুজব ছড়ায় তারা একটি বার বুঝতো!’ [চ্যানেলআইঅনলাইন, মে ১৫, ২০২০] ভাবা যায়- একজন জীবিত মানুষকে নিয়ম করে কিছুদিন পর পর একশ্রেণির মানুষ অনলাইনে মেরেই ফেলে? দুঃখজনক।

শেষ করি এটিএম শামসুজ্জামানের একটি মন্তব্য দিয়ে। তিনি বলেছিলেন, ‘মন্দির, প্যাগোডা, গির্জায় কখনো জুতা চুরি হয় না। মসজিদ থেকে জুতা চুরি হয়। এই জুতা চোরেরা হলো জামায়াত। কাজেই তাদের ভালোভাবে নির্মূল করতে হবে।’ মন্তব্যটি করেছিলেন তিনি ২০১৪ সালের ১৪ জানুয়ারি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত ‘সাম্প্রদায়িক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও’ শীর্ষক এক আলোচনায়। তিনি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সবসময় উচ্চকণ্ঠ এক ব্যক্তিত্ব। খেয়াল করলে দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তার বিরুদ্ধে যারা গুজব ছড়ায় তাদের বেশিরভাগই ওই শ্রেণির সাম্প্রদায়িক মানসিকতার। তিনি বলেছিলেন, ওদেরকে (জামায়াত) নির্মূল করতে হবে। ওই মানসিকতা এবং আদর্শিক কাছাকাছি থাকা মানুষেরা তাকে হয়ত তাই টার্গেট করেছে। মৃত্যুর আগে বারবার মারছে, আর তাদের এই গুজব ও অপপ্রচারের ফাঁদে পা দিচ্ছে অনেকেই। এবং প্রতিবারই তাকে ভাঙা হৃদয়ে এসে বারবার বলতে হচ্ছে ‘আমি মরিনি এখনও।’

শক্তিমান এই অভিনেতার মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে যারা বিকৃত আনন্দ উপভোগ করেন তাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করছি। যারা গুজবে বিভ্রান্ত হচ্ছেন তাদেরকে যেকোনো সংবেদনশীল তথ্য শেয়ারের আগে সুস্থচিন্তায় যাচাইবাছাই শেষে তবেই শেয়ারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুরোধ করছি।

‘উনআশির তরুণ’ এটিএম শামসুজ্জামান আপনি শতায়ু হোন। আপনার জন্যে শতত প্রার্থনা।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)