আমার মেয়েকে আমি সরকারি প্রাথমিক স্কুলে পড়াব—এই সিদ্ধান্তে স্থির ছিলাম। কিন্তু পরিবারের অন্য সদস্যদের চাপে সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে তাকে একটি বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করতে বাধ্য হই। তবে সেটি অবশ্যই বাংলা মাধ্যম।
মেয়েকে সরকারি স্কুলে পড়ানোর ক্ষেত্রে প্রথম বাধা বা আপত্তিটি আসে স্ত্রীর তরফেই। তার যুক্তি, ঢাকা শহরের সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলোর পরিবেশ ভালো না। তো পরিবেশ খারাপ করলো কে? বলা হচ্ছে, ওখানে নাকি কাজের লোকের ছেলেমেয়েরা পড়ে। তখন বুঝলাম, এখানে পরিবেশের চেয়েও বড় ইস্যু এই আভিজাত্যের দ্বন্দ্ব বা ক্ল্যাশ অব স্ট্যাটাস।
‘তুমি-আমিও তো সরকারি প্রাথমিকে পড়েছি, অসুবিধা কী? আমরা কি মূর্খ হয়েছি?’ তার জবাব, মফস্বল শহরের সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলোর সাথে ঢাকার তুলনা করা চলে না। তার সাথে এইসব যুক্তিতে সায় দেন আমার প্রতিবেশীরাও। তারা আরেকটু এগিয়ে বলেন, যখন কেউ আপনাকে জিজ্ঞেস করবে আপনার মেয়ে কোন স্কুলে পড়ে, আপনি কী বলবেন? ‘আমি বলব, অমুক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, তাতে কী সমস্যা?’ তারা মনে করেন, এটিই সমস্যা। ওই স্কুলে আপনার সন্তান উপযুক্ত শিক্ষা, সংস্কৃতি ও চিন্তায় বেড়ে উঠবে না।
‘কেন বেড়ে উঠবে না? সরকারি প্রাথামিক স্কুলের কারিকুলাম খারাপ? দেশের পণ্ডিত লোকেরাই তো সরকারি স্কুলের কারিকুলাম তৈরি করেন ও বই লেখেন। সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের তো অনেকগুলো পরীক্ষা দিয়ে তারপর চাকরি হয়। তারা কি অশিক্ষিত?’
আমার সাথে পরিবার ও প্রতিবেশীদের এই বাহাস বাড়তে থাকে এবং তারা একটি জায়গায় বারবার স্থির থাকেন যে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কারিকুলাম বা শিক্ষকদের যোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু সমস্যাটা এর পরিবেশে, শিক্ষকদের আন্তরিকতায় এবং সর্বোপরি ঢাকা শহরের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর ব্যাপারে মানুষের পারসেপশন বা ধারণা। তার মানে এই পারসেপশন থেকেই আভিজাত্যের দ্বন্দ্বের সূচনা এবং ঢাকা শহরের তুলনামূলক স্বচ্ছল মানুষেরা তাদের সন্তানদের এসব স্কুলে দিতে চান না। অথচ তারা নিজেরা সরকারি স্কুলে পড়েই শিক্ষিত হয়েছেন।এরকম বাস্তবতায় নতুন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেনের একটি বক্তব্য নিয়ে গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ তোলপাড় হচ্ছে। তিনি সরকারি প্রাথমিক স্কুলের (সারা দেশের) শিক্ষকদের বলেছেন, তাদের সন্তানদের যেন তারা কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি না করেন; যাতে তারা নিজেদের স্কুলের প্রতি আন্তরিক হন।
১৫ জানুয়ারি ঢাকা জেলার সাভার, দোহার, ধামরাই ও নবাবগঞ্জ উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে মতবিনিময়কালে তিনি বলেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সন্তানরা কিন্ডারগার্টেন (কেজি) স্কুলে ভর্তি হতে পারবে না। এ বিষয়ে দ্রুত নির্দেশনা জারি করা হবে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে শিক্ষকদের হালালভাবে দায়িত্ব পালনেরও আহ্বান জানান তিনি। কেজি স্কুলে শিক্ষার্থীরা কেন ভর্তি হচ্ছে—এমন প্রশ্ন তুলে মন্ত্রী বলেন, আপনারা (শিক্ষকরা) সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে অভিভাবকরা তাদের সন্তানকে কেজি স্কুলে ভর্তি করাবে না। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের সন্তানদের কেজি স্কুলে ভর্তি করাতে পারবেন না।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে প্রতিমন্ত্রীর এই বক্তব্যের নানারকম প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কেউ কেউ লিখেছেন, শুধু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই নয়, মন্ত্রী ও সচিব এবং সরকারি কর্মকর্তা- কর্মচারিদের সন্তানদেরও কেজিতে না পড়ানোর নির্দেশনা জারি করা উচিত। প্রসঙ্গত কেউ কেউ লিখেছেন, মন্ত্রী, এমপি, সচিবসহ সরকারি কর্মকর্তারা সরকারি হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোনো হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারবেন না, বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে পারবেন না, এমন নির্দেশনাও আসা উচিত।
বাস্তবতা হলো, প্রত্যেক নাগরিক তার পছন্দের স্কুলে সন্তানকে পড়াবেন, প্রত্যেকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী দেশে কিংবা বিদেশে চিকিৎসা করাবেন, এখানে সরকারের বাধা দেয়া বা নির্দেশনা জারির এখতিয়ার নেই। কিন্তু গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যটি নিয়ে এত আলোচনা হচ্ছে কারণ, যেসব কারণে আমাদের সরকারি প্রাথমিক স্কুলের, বিশেষ করে ঢাকা শহরের স্কুলগুলোর পরিবেশ ও পড়ালেখার মান নিয়ে অভিভাবকদের মনে সংশয় ও সন্দেহ, তা দূর করার ক্ষেত্রে একটি উদ্যোগ হতে পারে, শিক্ষকদের সন্তানদের এসব স্কুলে পড়ানো। তখন তারা নিজেদের স্বার্থেই ক্লাসে অধিকতর মনোযোগী হবেন এবং স্কুলের পরিবেশ উন্নত করতে ভূমিকা রাখবেন। কিন্তু তারপরও যেসব অভিভাবক মনে করেন যে, ঢাকা শহরের সরকারি প্রাথমিক স্কুলে ‘কাজের লোকেরা ছেলেমেয়েরা পড়ে’—সেইসব অভিভাবক কি কোনোদিনই সরকারি প্রাথমিকে তাদের সন্তানদের পড়াবেন? কারণ এই সংকটটা সমাজ বা রাষ্ট্রের নয়। এই সংকট মনস্তাত্ত্বিক। নাগরিকের মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার সমাধান খোদ রাষ্ট্রযন্ত্রের পক্ষেও কঠিন।
বাস্তবতা হলো, শুধু প্রাথমিক নয়, আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই একটা বিশাল গোঁজামিলের মধ্যে চলছে। প্রথম শ্রেণি থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত সব ক্লাসেই কম-বেশি ইংরেজি পড়তে হয়। অথচ ১৫-১৬ বছর ইংরেজি পড়ার পরেও আমরা নির্ভুলভাবে একটি পূর্ণাঙ্গ অধ্যায় লিখতে হিমশিম খাই। নানারকম ভুল-ভ্রান্তি সেখানে থাকে। অথচ পৃথিবীর কোনো ভাষা শিখতেই ১৫-১৬ বছর লাগার কথা নয়। প্রশ্ন হলো ক্লাসে আমাদের শিক্ষকরা কী পড়িয়েছেন বা তারা নিজেরাই বা ইংরেজি কতটুকু জানেন? আমাদের শেখানো হয়েছে কান্ধে বাড়ি ‘ধ’, পেট কাটা মূর্ধণ্য ‘ষ’। মানে শিক্ষকরাও বাংলা বর্ণের সঠিক উচ্চারণ জানেন না।
শুধু সরকারি-বেসরকারি কিংবা শিশুশিক্ষাই নয়—আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই এক বিরাট ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’। ফলে শুধু সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের কিন্ডারগার্টেনে ভর্তিতে নিষেধাজ্ঞা, কোচিং বাণিজ্য বন্ধ কিংবা ভর্তিতে অতিরিক্ত ফি আদায়ের বিরুদ্ধে সরকারের হুঁশিয়ারি দিয়ে সেই ধূসরতার অবসান হবে, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। বরং পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় বছরের পর বছর, দশকের পর দশক ধরে যে গলদ, বিশৃঙ্খলা আর অব্যবস্থাপনার পাহাড় গড়ে উঠেছে, সেই অবস্থা থেকে শিক্ষাকে মানবিক, চিন্তাশীল ও রুচিবান মানুষ তৈরির উপযোগী করে গড়ে তুলতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হবে এবং সেই কাজটি শুরু করা দরকার আজ থেকেই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)