চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের রায় ও রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ

বিশ্বে আইনের শাসন ও মানবতার মর্যাদা রক্ষায় এক ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে)। নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে অবস্থিত জাতিসংঘের আওতাধীন আইসিজে গত ২৩ জানুয়ারি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সহিংসতা ও বৈষম্য অবিলম্বে বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে মিয়ানমারের প্রতি আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের ১৭ জন বিচারক সর্বসম্মতভাবে চার দফা অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাগুলো হচ্ছে: ১. গণহত্যা সনদের বিধি-২ অনুযায়ী মিয়ানমারকে তার সীমানার মধ্যে রোহিঙ্গাদের হত্যা, জখম বা মানসিকভাবে আঘাত করা, পুরো জনগোষ্ঠী বা তার অংশবিশেষকে নিশ্চিহ্ন করা এবং তাদের জন্মদান বন্ধের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ থেকে অবশ্যই নিবৃত্ত থাকতে হবে। ২. মিয়ানমারকে অবশ্যই তার সীমানার মধ্যে সেনাবাহিনী বা অন্য কোনো অনিয়মিত সশস্ত্র ইউনিট বা তাদের সমর্থনে অন্য কেউ যাতে গণহত্যা সংঘটন, গণহত্যার ষড়যন্ত্র, প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে গণহত্যার জন্য উসকানি দেওয়া, গণহত্যার চেষ্টা করা বা গণহত্যার সহযোগী হতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ৩. গণহত্যা সনদের বিধি ২–এর আলোকে গণহত্যার অভিযোগের সঙ্গে সম্পর্কিত সব সাক্ষ্যপ্রমাণ রক্ষা এবং তার ধ্বংস সাধনের চেষ্টা প্রতিরোধ করতে হবে। ৪. এই আদেশ জারির দিন থেকে চার মাসের মধ্যে আদালতের আদেশ অনুযায়ী মিয়ানমার যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে, তা আদালতকে জানাতে হবে। এরপর থেকে আদালতের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত প্রতি ছয় মাস পরপর এ বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে হবে।

রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের উপর গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধের মত নৃশংসতম অপরাধ সংঘটিত করার পরও বিশ্বজনমতকে উপেক্ষা করার ধৃষ্টতা দেখানো মিয়ানমারের জন্য এই রায় নিঃসন্দেহে এক চপেটাঘাত। আর রোহিঙ্গাদের জন্য এটা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক একটা রায়। আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতের এই আদেশ মানতে মিয়ানমার বাধ্য। যদিও আদালত এজন্য তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে পারবে না। তবে এই রায় উপেক্ষা করা মিয়ানমারের জন্য কঠিন হয়ে উঠবে।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর পূর্ব-পরিকল্পিত ও কাঠামোগত সহিংসতা চালায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী। হত্যাকাণ্ড, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগসহ রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর নির্যাতন চালায় তারা। ওই সময় জীবন বাঁচাতে নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। এ পর্যন্ত সাড়ে ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। এই নৃশংসতাকে গণহত্যা আখ্যা দিয়ে গত বছরের ১১ নভেম্বর আইসিজেতে মামলা দায়ের করে আফ্রিকার মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ গাম্বিয়া। গণহত্যার তদন্ত শুরু না হওয়া পর্যন্ত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানায় দেশটি। নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগের পিস প্যালেসে গত বছরের ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর মামলার শুনানি চলে। ১০ ডিসেম্বর গাম্বিয়ার প্রতিনিধি দল আদালতে গণহত্যার বিষয়ে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করে। শুনানিতে গাম্বিয়ার পক্ষে মামলার প্রতিনিধিত্ব করেন দেশটির বিচারমন্ত্রী আবুবাকার তাম্বাদু। পরদিন ১১ ডিসেম্বর মিয়ানমারের নেতৃত্ব দেন মিয়ানমারের সরকার প্রধান অং সান সু চি। সেখানে তিনি তার দেশের বিরুদ্ধে আনা গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেন। শুনানির সময় সু চি আইসিজের এই মামলাকে ‘অসম্পূর্ণ ও ভুল’ হিসাবে আখ্যা দিয়ে মামলাটি বাতিল করে দেয়ার আহ্বান জানান। ১২ই ডিসেম্বর মামলার শুনানি শেষ হয়। তারপর গত বৃহস্পতিবার বিচারকরা সর্বসম্মত এই রায় ঘোষণা করেন।

এই বিচার ও রায়কে প্রভাবিত করতে মিয়ানমার সব রকম চেষ্টাই করেছে। রায় ঘোষণার মাত্র দুদিন আগে মিয়ানমার সরকারের গঠিত একটি কমিশন ২০১৭ সালে রাখাইনে দেশটির সেনাবাহিনীর অপারেশন ক্লিয়ারেন্সের সময় কিছু সৈন্য সেখানে যুদ্ধাপরাধ করলেও গণহত্যার মতো ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল না বলে এক তদন্ত প্রতিবেদনে জানায়। এমনকি রায় ঘোষণার ঠিক আগে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি বলেছেন, রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মতো ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। তবে তিনি গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে লেখা এক নিবন্ধে তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গারা তাদের বিরুদ্ধে নিপীড়নের মাত্রাকে অতিরঞ্জিত হিসেবে তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে রাখাইনে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দেশীয় আইনে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলেও দাবি করেছেন তিনি। কিন্তু তারপরও আন্তর্জাতিক আদালতের রায়কে প্রভাবিত করা যায়নি।

এই রায়ের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে একজন চীনা বিচারকও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণায় একমত হয়েছেন। এমনকি মিয়ানমারের নিয়োগ করা অ্যাডহক বিচারকও গাম্বিয়ার পক্ষেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আইসিজের এই রায়টি নানা দিক থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ। এটা খুবই স্পষ্ট যে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি আদালতে নিজের পক্ষে যেসব যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছিলেন, আদালত তাতে কোনোভাবেই সন্তুষ্ট হননি। এটি সর্বসম্মত একটি রায়। এমনকি মিয়ানমারের এবং শক্তিশালী রাষ্ট্রের বিচারকেরাও একমত হয়েছেন। বিচারকেরা মেরিটে না গিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা একটা স্ট্র্যাটেজি। মিয়ানমারের যুক্তিতর্কে তারা কোনোভাবেই নিজেদের চালিত করেননি। গাম্বিয়ার যুক্তিতর্ক সম্পূর্ণরূপে সফল হয়েছে। এতটা সাফল্য নজিরবিহীন। এই আদেশ মানা মিয়ানমারের জন্য বাধ্যতামূলক। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটা এখন জাতিসংঘের গণহত্যা কনভেনশনের ৪১ অনুচ্ছেদের আওতায় নিরাপত্তা পরিষদে আপনাআপনি চলে যাবে। এখন আইসিজের আদেশ কার্যকর করার দায়িত্ব জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের। মিয়ানমার আগামী চার মাস পরে প্রথম প্রতিবেদন এবং এরপর ছয় মাস অন্তর রিপোর্ট দিল কি না, সেটা তদারকির আইনি দায়ও নিরাপত্তা পরিষদের। আদালতের আদেশ তামিলে মিয়ানমারকে তাই অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন আদেশের বিষয়ে আপিলের সুযোগ নেই। মিয়ানমারকে কিছু একটা পদক্ষেপ নিতে হবে। তাকে অবশ্যই কিছু করে দেখাতে হবে।

এই রায়ে অনেক কিছুই বদলাবে না ঠিক, কিন্তু নৈতিকভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং তাদের আশ্রয়প্রদানকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ নতুন করে ভরসা খুঁজে পাবে। রোহিঙ্গাদের জাতিগত নির্মূলকরণ ও গণহত্যার বিপদ থেকে সুরক্ষার দাবিতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) দ্বারস্থ হওয়া গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু আদালতের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশকে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ নিপীড়ন ও বঞ্চনার অবসানের পথে একটি ছোট পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা জানি, এই আদেশ এক দিনে রোহিঙ্গাদের জীবন বদলে দেবে না। তবে এটি একটি প্রক্রিয়ার সূচনা, যার মাধ্যমে আমরা আশা করি, একদিন তারা নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে রাখাইনে ফিরে যেতে পারবেন।’

এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অংশ হিসেবে মিয়ানমারের দায়িত্ব হচ্ছে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে দেশে ফেরার ব্যবস্থা নেওয়া এবং রাখাইনে উপযুক্ত ও সহায়ক পরিবেশ তৈরির দিকে নজর দেওয়া। এজন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব হচ্ছে মিয়ানমারকে জবাবদিহির আওতায় আনা। পাশাপাশি সংকট নিরসনে মিয়ানমার যাতে দায়িত্বে অবহেলা না করে, তা নিশ্চিত করা।

আইসিজের আদেশটি মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি করেছে। সামনের দিনগুলোতে নিরাপত্তা পরিষদ যদি এ বিষয়ে নির্বিকার থাকে, তাহলে সেটা কার্যত সমগ্র জাতিসংঘ ব্যবস্থা এবং সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা হবে। আইসিজের আদেশ অমান্য করতে পারে, এমন অন্য কোনো শ্রেয়তর সংস্থার অস্তিত্ব জাতিসংঘ ব্যবস্থায় নেই। আদালতের এই আদেশ যদি মিয়ানমার না মেনে চলে, তাহলে সেটা মিয়ানমারই শুধু নয়, নিরাপত্তা পরিষদ এবং জাতিসংঘ সদস্যরাষ্ট্রগুলো যারা মিয়ানমারের সঙ্গে নানাভাবে সম্পর্ক রক্ষা করে চলবে, তাদের সবার ওপরই দায় বর্তাবে। এটা জাতিসংঘের সনদ এবং একটা সাধারণ ও আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন হিসেবে দেখা দেবে।
কাজেই আন্তর্জাতিক আদালতের রায়কে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে একটি নতুন সূচনা হিসেবে দেখতে হবে। আগামী দিনে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে চীন-রাশিয়ার ভূমিকা যেন পরিবর্তিত হয়, এই লক্ষ্যে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)