রোববার দিনটি খুব ব্যস্ততায় কাটিয়েছেন সাকিব আল হাসান। বিকেল-সন্ধ্যা কাটিয়েছেন ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব মোহামেডানের জার্সি উন্মোচন অনুষ্ঠানে। রাতে টাইগার অলরাউন্ডার যান দুবাই। বিমানবন্দরে মিডিয়ার মুখোমুখি হয়ে জানান, সামনের সাউথ আফ্রিকা সিরিজ খেলতে প্রস্তুত নন তিনি।
শারীরিক ও মানসিক অবস্থা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার মতো উপযুক্ত মনে করছেন না সাকিব। অবসাদ কাটাতে চান বিরতি। দেন সে কথার ব্যাখ্যাও।
আফগানিস্তান সিরিজ আসলে কেমন কাটল? নিজের মূল্যায়ন যদি করেন…
সাকিব: স্বাভাবিকভাবে আমার ব্যক্তিগত দিক থেকে চিন্তা করলে অবশ্যই হতাশাজনক। আমার নিজের প্রতি নিজের যে প্রত্যাশা, মানুষ যেভাবে প্রত্যাশা করে, বিসিবি যেভাবে প্রত্যাশা করে, অবশ্যই ওভাবে করতে পারেনি। এজন্য অবশ্যই আমি হতাশ।
সাউথ আফ্রিকা সিরিজ নিয়ে যেটা বলতে হয়, মানসিক ও শারীরিক যে অবস্থায় আছি, আমার কাছে মনে হয় না আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা সম্ভব খুব একটা। এই কারণে আমার মনে হয়, যদি একটা বিরতি পাই, যদি ওই আগ্রহটা ফিরে পাই, তাহলে আমার খেলাটা সহজ হবে। কারণ আফগানিস্তান সিরিজে আমার কাছে মনে হয়েছে আমি একজন যাত্রী, যেটা হয়ে আমি কখনোই থাকতে চাই না। খেলাটা একদমই উপভোগ করতে পারিনি। পুরো সিরিজটাই, টি-টুয়েন্টি ও ওয়ানডে। চেষ্টা করেছি, কিন্তু হয়নি। আমার মনে হয় না এরকম মন-মানসিকতা নিয়ে সাউথ আফ্রিকায় সিরিজ খেলাটা ঠিক হবে। এই কথা জালাল ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করেছি। জালাল ভাই বলেছেন, দুদিন উনিও চিন্তা করবেন।
আমাকে চিন্তা করার সময় দিয়েছে। তারপর একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বা উচিত বলে মনে করি। যেটা বললাম, এখন পর্যন্ত যেটা আমার কাছে মনে হচ্ছে এরকম যদি আমার মন-মানসিকতা থাকে, ফিজিক্যাল কন্ডিশন থাকে, মেন্টাল কন্ডিশন থাকে, এটা দলের জন্যই ক্ষতি হবে। যেটা আগেও বললাম, যেটা নিজে মনে করি, আমার নিজের প্রতি নিজের যে সম্মান, মানুষ যেটা প্রত্যাশা করে, যে ধরনের পারফরম্যান্স, সেটা যদি করতে না পারি সেখানে আসলে যাত্রী হয়ে থাকাটা খুবই দুঃখজনক হবে। সতীর্থদের সঙ্গে প্রতারণা করার মতোই একটা ব্যাপার হবে বলে মনে করি।
তাহলে কি সাউথ আফ্রিকা সিরিজ খেলতে চাচ্ছেন না?
সাকিব: এটা আসলে সিদ্ধান্তের ব্যাপার। পাপন ভাইয়ের (বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান) সঙ্গে কথা বলার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম পুরো সিরিজটাই খেলতে যাব। এজন্যই আমার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু আমার মেন্টাল ও ফিজিক্যাল কন্ডিশন যেভাবে দেখছি বা আমার কিছু সময় দরকার বলে মনে করি। সেটা এমন হতে পারে ওয়ানডে সিরিজটা বিরতি নিয়ে যদি টেস্ট সিরিজটা খেলতে পারি, তাহলে ভালো মানসিক ও শারীরিক কন্ডিশনে থাকতে পারব। এগুলো আসলে সবকিছুর আলোচনার উপর নির্ভর করবে কী করলে ভালো হয়। আমার বর্তমান পরিস্থিতি এটা।
যদি এই পরিস্থিতিতে খেলতে যাই, সতীর্থ ও দেশের সঙ্গে প্রতারণা করার মতো বিষয় হবে। যেই জিনিসটা অবশ্যই চাই না। চাই যে, যখন খেলব, মানুষ যেভাবে প্রত্যাশা করে, আমার নিজের প্রতি নিজের যে প্রত্যাশা, দল আমাকে যেভাবে চিন্তা করে, সেভাবে যেন পারফর্ম করতে পারি, সেই অবস্থায় গিয়ে। হ্যাঁ, কোনো গ্যারান্টি নেই যে যখন খেলতে নামব তখন পারফর্ম করতে পারব ভালো পরিস্থিতিতে থাকলেও। অন্তত জানতে পারব যে আমার সেরা সময়ে আছি দেশের হয়ে পারফর্ম করতে। কিন্তু যদি জানিই যে, আমার কোনো সম্ভাবনা নেই, সেখানে সময় নষ্ট করা, অন্য একটা জায়গা নষ্ট করা এবং দেশের ক্রিকেটের সঙ্গে গাদ্দারি করার মতো বিষয় বলে মনে করি।
আসলে কি টানা খেলার কারণে এটা হচ্ছে?
সাকিব: টানা খেলাটা বলব না, বর্তমানে আমার ক্যারিয়ার যেখানে দাঁড়িয়ে সেখানে আমার লম্বা একটা পরিকল্পনা দরকার।
সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্টও খেলতে চান না…
সাকিব: এটা নিয়ে আরেকটা বিষয় আছে, মিডিয়া থেকেই জেনেছি, বোর্ডে আমি যে চিঠিটা দিয়েছি ছয় মাসের জন্য, এটা কখনোই ছয় মাসের ছিল না। এটা এই বছর টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ পর্যন্ত। মাঝ নভেম্বর পর্যন্ত। আমি এই সময়ে কোনো টেস্ট খেলব না। ওয়ানডে ও টি-টুয়েন্টি ফরম্যাটে মনোযোগ দেব। কারণ পরপর দুইটা বিশ্বকাপ আছে। ওই জায়গায় মনোযোগ দিতে চাচ্ছিলাম। আমার কাছে বিশ্বাস ছিল এই দুইটা বিশ্বকাপে বড় কিছু করা সম্ভব। এই কারণে পুরোটা মনোযোগ সেদিকে দিতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু এটার মানে এই না যে টেস্ট ক্রিকেট একবারেই ছেড়ে দিতে চাচ্ছিলাম। যেহেতু টেস্ট ক্রিকেটে দলের একটা ভারসাম্য তৈরি হয়ে যাচ্ছে, এখন আমার কাছে মনে হয়েছে যদি এই মুহূর্তে সাদা বলে মনোযোগ দেই, সবকিছু চিন্তা করে আমার বয়স, ক্যারিয়ার, কিছু ফিজিক্যাল ফিটনেস নিয়ে, তাহলে হয়তো বেটার করতে পারতাম।
একটা সমস্যা হচ্ছে, জানি না যে আমার সামনে কী আছে। সিরিজ বাই সিরিজ আমার জন্য পরিকল্পনা করা কঠিন। যদি পুরো বছরের পরিকল্পনা জেনে যেতে পারতাম বা জেনে যেতে পারি, আমার জন্য অবশ্যই সেটা ভালো হবে। আমার মতো করে পরিকল্পনা করতে পারব। আমার নিজস্ব পরিকল্পনা, পারিবারিক পরিকল্পনা, অন্য যেকোনো কিছু, আমার ব্যক্তিগত জীবন কিংবা ক্রিকেট ক্যারিয়ার, দুইটা দিক থেকেই ভালো হতো। এই বিষয়গুলো পরিষ্কার থাকাটা খুব জরুরি। আবারো বলছি ওইটা ছয় মাসের কখনোই ছিল না। যদি চিঠিটা আপনাদের কাছে আসে, অবশ্যই দেখতে পারবেন। খুব সম্ভবত ২২ নভেম্বর বা বিশ্বকাপ শেষ হওয়া পর্যন্ত টেস্ট খেলব না এমন কিছু।
আপনি বললেন চিঠি দিয়েছেন, তারপরও যোগাযোগে ঘাটতি, ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা হতে পারত। কথা হতে পারত…
সাকিব: কথা হয়েছে। নিয়মিতই কথা হয়েছে। কোনটা খেলব বা না খেলব। আসলে এই সাউথ আফ্রিকা সফর নিয়েই বেশি কথা হয়েছে। বাকিগুলো নিয়ে এতবেশি কথা হয়নি। আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, জানা জরুরি সামনের একমাস বা ছয় মাস কী করছি। সবসময় এরকম ক্যালেন্ডারই তো তৈরি হয়। সেটা জানতে পারলে আমার জন্য পরিকল্পনা করতে সহজ হতো।
সাউথ আফ্রিকায় আপনি টেস্ট খেলতে যাবেন, সেটা কি আপনার ইচ্ছের বিরুদ্ধে?
সাকিব: এটা আসলে সিদ্ধান্তের ব্যাপার। পাপন ভাইয়ের (বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন) সঙ্গে কথা বলার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম পুরো সিরিজটাই খেলতে যাব। এজন্যই আমার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু এখন যে পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে, গতকাল সিরিজ শেষ হওয়ার পর অনেক চিন্তা করেছি, এর আগেও তো পারফরম্যান্স খারাপ হয়েছে সেটা অন্য বিষয়। আমি যখন ক্রিকেটটা উপভোগ করতে না পারি, সেটা আমার জন্য দুঃখজনক। সেটা কখনোই চাই না। এটা আমার সতীর্থদের ঠকানো। সেটা কখনোই চাই না।
চিঠি দিয়েছেন বললেন, আনুষ্ঠানিক কোনো কথা কি হয়েছে?
সাকিব: চিঠি দিয়েছি, কিন্তু বলিনি যে ওয়ানডে সিরিজ খেলবে না বা টেস্ট খেলব না। আপনাকে যেভাবে পরিস্থিতিটা বললাম সেটাই নিজের অবস্থান আসলে জানিয়েছি জালাল ভাইকে (ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের চেয়ারম্যান)। উনি বলেছেন, ‘তুমিও দুদিন চিন্তা করো।’ উনারাও করুক। তারপর হয়তো আলোচনা করে কোনো একটা সিদ্ধান্ত আসবে।
আপনি কি তাহলে ওয়ানডে খেলতে চাচ্ছেন না?
সাকিব: আসলে যেটা বললাম, আমি খুব খোলা মনে আছি। এখন ক্রিকেট খেলার পরিস্থিতিতে নেই। ওই পরিস্থিতিতে যখন আসব, তখন অবশ্যই চাইব, ক্রিকেট খেলব। সবকিছুই নির্ভর করছে বিসিবি ও আমার দুই জায়গা থেকে আলোচনার মাধ্যমে সুন্দর পরিস্থিতি তৈরি করা, যেখানে গেলে বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য ভালো হবে। আমার জন্যও ভালো হবে।
একটু পরিষ্কার হওয়ার জন্য জানতে চাওয়া, আপনি বললেন যে প্রস্তুত হওয়ার জন্য সময়ের প্রয়োজন। এটা তো সাউথ আফ্রিকা সিরিজে। এটা কি শ্রীলঙ্কা সিরিজেও হতে পারে?
সাকিব: শ্রীলঙ্কা সিরিজ, আসলে আমার জন্য বলা কঠিন। আসলে দুই মাস পর কী চিন্তা হবে সেটা এখন বলাটা কঠিন। এমনও হতে পারে ওয়ানডে সিরিজটা বিরতি দিয়ে টেস্ট সিরিজটাও খেলতে পারি। ১৫-২০ দিনের বিরতি আমার জন্য অনেক বড় পরিবর্তন আনতে পারে। দুই মাস পরেরটা আমার বলা কঠিন, যে কোন মানসিকতায় থাকব বা ফিটনেসে কোন অবস্থায় থাকব। কিন্তু এটা গুরুত্বপূর্ণ যে বোর্ডকে জানানো আমি কোন অবস্থায় আছি।
আপনার মতো অনেকেই ফেস করছে, লম্বা সময় খেলা, বায়ো-বাবল থাকছে। এখন সবার সঙ্গে কথা বলা জরুরি কিনা যে কে কোনটা খেলবে?
সাকিব: অনেকেরই হতে পারে। আমাদেরকে দিয়ে দিতো যে কার কোনো ফরম্যাটে খেলার ইচ্ছা আছে, ইচ্ছা নেই। যেমন দেখেন, মোস্তাফিজ বলেছে টেস্ট খেলবে না, বিরতিতে আছে যতদিন বায়ো-বাবল থাকছে। ওরটা ও আরও ভালো বলতে পারবে। এরকম যদি সবার কাছে অপশনটা দিয়ে দেয়া যায়, সবার মতামত নেয়া হয় কিংবা বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, আমার মনে হয় এটা সবার জন্য ভালো।
কবে নাগাদ আপনার সিদ্ধান্তটা আসতে পারে?
সাকিব: জালাল ভাই বলেছেন যে, তুমি দুদিন চিন্তা করো। উনিও চিন্তা করবেন। উনিও হয়তো কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলবেন। তারপর হয়তো আলোচনার মাধ্যমে একটা সিদ্ধান্ত আসতে পারে।