চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

আদিবাসীদের সমাধিকার প্রতিষ্ঠা সময়ের দাবি

আজ বিশ্ব আদিবাসী দিবস। আদিবাসী জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও বিভিন্ন সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে আর্ন্তজাতিক সহযোগিতা সুদৃঢ় করা ও গণসচেতনতা সৃষ্টি করাই বিশ্ব আদিবাসী দশক, বর্ষ ও দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আদিবাসীদের প্রতি অন্যায়, নিপীড়ন, উৎপীড়ন ও বিভিন্নভাবে অত্যাচারে তাদের অস্তিত্ব আজ অনেকাংশে হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় আদিবাসী জনগণের সংহতি ও তাদের অধিকারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করাই বিশ্ব আদিবাসী দিবসের লক্ষ্য।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ প্রথম ১৯৯০ সালে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, ১৯৯৩ সাল বিশ্ব আদিবাসী বর্ষ হিসেবে পালিত হবে (সিদ্ধান্ত ৫৪/১৬৪)। ১৯৯৩ সালে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে (সিদ্ধান্ত ৪৮/১৬৩) যে, ১৯৯৪ এর ১০ ডিসেম্বর থেকে পালিত হবে বিশ্ব আদিবাসী দশক। সাধারণ পরিষদ ১৯৯৩ সালের ওই সভায় ঘোষিত বিশ্ব আদিবাসী দশকের আবরণে ১৯৯৫ এর জন্য কর্ম পরিকল্পনাও গ্রহণ করে (সিদ্ধান্ত ৫০/১৫৭)। বর্ষ এবং দশক ঘোষণার পর ১৯৯৪ এর ২৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এ মর্মে সিদ্ধান্ত (৯সিদ্ধান্ত ৪৯/২১৪) গ্রহণ করা হয় যে, আদিবাসী দশকের প্রতিটি বছরেই ৯ আগষ্ট পালিত হবে ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ হিসেবে। মানবাধিকার কমিশনের উন্নয়ন ও সংরক্ষণ সাব কমিশনের আদিবাসী জনগণ সম্পর্কিত কর্মদল তাদের প্রথম সভায় ১৯৯২ সালে আদিবাসী দিবস পালনের জন্য ৯ আগষ্টকে বেছে নেয়।  

সারা বিশ্বের ৭০টি দেশে প্রায় ৩০ কোটি আদিবাসী জনগণ রয়েছে। তারমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ও কানাডার, ইন্ডিয়ান, অষ্ট্রেলিয়ার ইনুইট বা এস্কিমোস, উত্তর ইউরোপের সামী, নিউজিল্যান্ডের মাওরি অন্যতম। বলিভিয়ার মোট জনসংখ্যার শতকরা ৬০ শতাংশ জনসংখ্যা আদিবাসী। পেরু ও গুয়াতেমালার মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক আদিবাসী।

তাছাড়া চীন, ভারত, মায়ানমারেও বিরাট সংখ্যক আদিবাসী জাতি বাস করে।

বাংলাদেশে ১৯৯১ সালে আদমশুমারি অনুযায়ী আদিবাসী জনসংখ্যা প্রায় ১২ লাখ ৫ হাজার ৯ শত ৭৮ জন। বেসরকারি হালনাগাদ হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে ৪৫টি আদিবাসী জাতিসত্তা মিলে অদিবাসী জনসংখ্যা আনুমানিক ১৬ লাখেরও বেশি।

জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণ মতে, কিছু কিছু ভিন্নতা ছাড়া সকল অাদিবাসীর মধ্যে অনেকক্ষেত্রে সামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয়। এই মিলগুলোর মধ্যে রয়েছে, তারা গরীব, দূরবর্তী ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করে, অনেকেই লিখতে ও পড়তে জানে না, সীমাহীন নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার, তারা নিজ দেশে বাস করে অনাহুত পরবাসীর মতো। অথচ এই আদিবাসীগণ-ই বিশ্ব মানব পরিবারের অংশীদার এবং নিজ নিজ দেশ গঠনে, দেশের উন্নয়নে, সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিকাশে তাদেরও অবদান রয়েছে। বাংলাদেশেও আদিবাসী জনগণ স্বাধীনতা যুদ্ধে ও দেশ গঠনে তাদের অগ্রণী ভূমিকা ও কার্যক্রম রেখেছে। জাতিসংঘের মৌলিক নীতি হচ্ছে জাতি, বর্ণ, ভাষা ,লৈঙ্গিক ভিন্নতার কারণে কারো প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না। তাই বিশ্বের আদিবাসীকে শ্রদ্ধা করা, তাদের অংশীদার করা, তাদের মৌলিক অধিকার ও মুক্তির সংগ্রামে সংহতি প্রকাশ করার আহ্বান জানায় বর্তমান বিশ্ব মানবসমাজ।

বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালনে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ দেশে কমপক্ষে ৪৫টি সংখ্যালঘু জাতিসত্তা বা আদিবাসী গোষ্ঠী দু’টি পৃথক ভৌগলিক পরিবেশে বাস করে। এ দু’টি ভৌগলিক পরিবেশের একটি পার্বত্য চট্রগ্রাম (রাঙ্গামাটি, বান্দরবান এবং খাগড়াছড়ি) এবং আরেকটি উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্ত্তী জেলাসমূহ। এর মধ্যে মধুপুরের গড়াঞ্চল বিশেষ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। ৪৫টি সংখ্যালঘু আদিবাসীদের তালিকায় রয়েছে, গারো, খিয়াং, ম্রো, বন, চাকমা, চাক, পাংখু, লুসাই, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গা, রাখাইন, খাশিয়া, মনিপুরী, ঘুনী, হাজং, বানাই, কোচ, ডালু, সাঁওতাল, মুন্ডা, পাহাড়িয়া, মাহাতো, সিং খারিয়া, খন্ড, আসাম (বহমিয়া) গোর্সা, কর্মকার, পাহান, রুজুয়াড, মুসহর, রাই, বেদিয়া, কন্দি কোল, কাজবশী, পাত্র, মুরিয়ার তুরি মাহাসী, মালো, উরাঁও, ক্ষত্রিয় চমনি, রাজবংশী। বাংলাদেশের আদিবাসীদের মূল দাবি হচ্ছে সাংবিধানিক স্বীকৃতি।

বাংলাদেশে আদিবাসী বর্ষ, দশক, দিবসে তাদের এই একটি দাবিই বারবার প্রাধাণ্য পায়। জীবনের ওপর তাদের অধিকার নিশ্চিত এবং ভূমি ও সম্পদ রক্ষর্থে তাদের অধিকারের পূর্নতা প্রাপ্তি তাদের দাবি। এসব দাবির আলোকে দিবসের মূল চেতনায় আদিবাসীগণ সংহত হচ্ছে।

১৯৯৯ সালে বাংলাদেশে বিশ্ব আদিবাসী উদযাপন কমিটি দিবসটি প্রথমবারের মতো যথাযথভাবে পালনের উদ্যোগ নেয়। ঐ বছর দিবসের মূল লক্ষ্য ছিলো ‘সংহতি প্রত্যাশায় বাংলাদেশের আদিবাসী…!’

প্রকৃত অর্থে আদিবাসীরা এদেশেরই সন্তান, এ দেশেরই মানুষ। সুতরাং প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের প্রতি সকল বৈষম্য দূর করে সম অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই সময়ের অন্যতম প্রধান দাবি।