নিকট আগামীতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন হতে যেন আদর্শবাদের নাম নিশানা বিলুপ্ত হতে চলেছে। নীতি নৈতিকতা, দেশপ্রেম ও দলপ্রেম বুঝি আর এতটুকু মূল্যায়িত হবেনা কোথাও। বাম, ডান, মধ্যপন্থা সর্বত্রই চলছে ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও সুবিধাবাদের জয় জয়কার। বামরা বক্তৃতায় বলে শোষন মুক্তি ও বৈষম্য মুক্তির কথা। নির্বাচনে জেতার জন্য নিজেদের সত্তা বিকিয়ে দিয়ে যাদেরকে তারা শোষক ও বুর্জোয়া বলে তাদের প্রতীককেই ব্যবহার করে।অামরা দেখেছি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) তাদের কাস্তে হাতুড়ি প্রতীক বাদ দিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে নৌকা মার্কা নিয়ে। তাদের এই নৌকা প্রতীক গ্রহণের একসময় ব্যাপক সমালোচনা করত বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। সিপিবিকে তখন তারা আখ্যায়িত করত আওয়ামী লীগের বিটিম হিসেবে। কিছুদিন যেতে না যেতেই নৌকার গলুই হতে সিপিবি নেমে গেল। তখন উঠে গেল ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ।
নৌকায় উঠার সুযোগ খুঁজতে চলল সাম্যবাদী দল (এম, এল), গণতন্ত্রী পার্টি সহ আরও কিছু বামদল। সাম্যবাদী দলের নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা সাম্যবাদী তত্ত্বে পাকবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী উভয়ের সাথেই যুদ্ধ করেছে। তখন তারা হাজির করে ‘কুকুর তত্ত্ব’। তারা পাকিস্তানীদের বলে বিদেশী কুকুর ও এদেশীয় বুর্জোয়াদের বলে দেশী কুকুর। বিদেশী কুকুরটা হটলে তখন দেশী কুকুরটাও মানুষকে কামড়াবে। তাই রুখতে হবে দুই কুকুরকেই। এই তত্ত্বে খালি হয়েছে কত মায়ের কোল! প্রাণ দিয়েছে কত শত তরতাজা যুবক। বাংলাদেশের অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনও সাম্যবাদী ও মুজিববাদীদের খুনোখুনি আতঙ্কের স্মৃতি জাগায়। সেদিনের সেই বিপ্লবীরা আজ কোথায়? বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে তারা জেল থেকে বেরিয়ে আসে। মোহাম্মদ তোয়াহা নিজেও জিয়ার নির্বাচনকে বৈধতা দিতে রাষ্ট্রপতি পদে দাঁড়িয়ে যায়। তখন কোথায় গেল শ্রেনী সংগ্রাম? এই তত্ত্বে যেসব তরতাজা প্রাণ ঝরলো তার দায় কার? বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে যাদের মুক্তি ঘটে। যারা জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধুর গোষ্ঠী উদ্ধার করতো তাদের অনেককেও এখন দেখা যায় বঙ্গবন্ধু বন্দনায় মেতে যেতে!
মার্কসবাদ, লেনিনবাদ ও মাওবাদের তত্ত্বকথায় জীবন যৌবনের কত মূল্যবান সময় বিসর্জন দিয়ে চলেছে কত শত দেশ দরদী মানবিক যুবক। এসব যুবকদের জীবন নষ্ট করা ছাড়া জীবন মানের কি কোন উন্নতি ঘটাতে পেরেছে তারা? অথচ পরিণত বয়সে সে সব যুবকদের দেখানো পথ বাদ দিয়ে তারা অবলীলায় মিশে যাচ্ছে তাদের কন্ঠেই বলা শ্রেণি শত্রুদের দলে। অথচ যৌবনে তাদের দিয়ে দ্বন্দ্ব করিয়েছে বুর্জোয়াদের সাথে, দ্বন্দ্ব করিয়েছে বিরুদ্ধ মতের বাম তাত্ত্বিকদের সাথে। তরতাজা যুবকদের তত্ত্বকথায় উদ্বুদ্ধ করে তারা জড়িয়েছে সংঘাতে। তাদের কর্মকাণ্ডে নিগৃহীত হয়েছে জড়িতদের নিরীহ পরিবার। পিতা তার সন্তানের লাশ চিনেও সনাক্ত করেনি ভয়ে।
এই যে এত এত আত্মদান এর কি কোন সুফল পেল জাতি ও সংশ্লিষ্ট বাম বিপ্লবী দল? যৌবনের তুখোড় বিপ্লবী পরিণত বয়সে হয়ে উঠছে তুখোড় সুবিধাবাদী। পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট গেরিলা বাহিনীর নেতা আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া পরিণত বয়সে হয়ে যান কমিউনিস্টবিরোধী দলের নেতা। তিনি হয়ে যান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি’র) মহাসচিব। যে দলটি দলীয় নীতি হতে সমাজতন্ত্র কথাটাই উঠিয়ে দেয়। নিজের যদি এই পরিণতি হয় তবে কেন যৌবনে আদর্শের বুলি আওড়িয়ে যৌবনে শত যুবকের যৌবন ক্ষয়ের কারন হয়ে ওঠা?
একসময়ের অগ্নিকন্যা খ্যাত বেগম মতিয়া চৌধুরী আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতা ঝাড়তেন।পরবর্তীতে পরিণত বয়সে এসে তিনিই বনে যান আওয়ামী লীগের নেতা। যৌবনে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী বিপ্লবী পরিণত বয়সে এসে হয়ে যান স্বৈরাচারের দোসর। আ স ম আব্দুর রব কে বলা হতো স্বৈরাচার এরশাদের গৃহপালিত বিরোধী দলীয় নেতা। আরেক বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী বিপ্লবী শাহজাহান সিরাজ যোগ দেন বিএনপিতে। যৌবনের অনেক তুখোড় বামবিপ্লবীকে পরিণত বয়সে দেখা যায় ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিতে বিলীন হয়ে যেতে। স্বয়ং আব্দুল হামিদ খান ভাসানীও সমাজতন্ত্রের আগে ‘ইসলামী’ শব্দটা জুড়ে ইসলামী সমাজতন্ত্রের কথা বলেছিলেন। কিন্তু কেন? তবে কি বিপ্লব কেবলই যৌবনের উন্মাদনা? না হয় পরিণত বয়সে সকলের চিন্তায় কেন আসে এই বিশাল পরিবর্তন?
যুগে যুগে যারা দেশপ্রেম ও আদর্শের নজীর হয়েছে তারা বেশির ভাগই যৌবনের। যেমন সূর্য সেন, প্রীতিলতা, ক্ষুদিরাম অনন্য আত্মদানের নজীর হয়ে আছে। প্রজন্ম হতে প্রজন্মান্তরে আদর্শের দ্যুতি ছড়িয়ে যাচ্ছে তারা। পরিণত বয়সে এমন আদর্শিকতার নজীর কয়টা আছে পৃথিবীতে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে কারা মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করে অংশ নিয়েছে? ভাষা আন্দোলন, আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে কারা জীবন দিল? একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধ ও পঁচাত্তরে মুজিব হত্যার প্রতিবাদে কারা অংশ নিয়েছিল? এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে কারা জীবন দিল? দেশপ্রেম, মানবপ্রেম ও জাতিসত্তার চেতনায় আত্মদান করেছিল কেবলই যৌবন বয়সীরা নয় কি? পরিণত বয়সের কতজনের আত্ম উৎসর্গের নজীর আছে পৃথিবীতে? যৌবনে আদর্শের উপমা হয়ে পরিণত বয়সে কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে সকলের। যৌবনের সিরাজুল আলম খান দাদা ভাই, আ স ম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ, কাদের সিদ্দীকী, আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া, কাজী জাফর আহমদ প্রমুখদের পরিণত বয়সে কত পার্থক্য! কেন পরিণত বয়সে বদলে যায় সবাই?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)