ধুনুকা খানম। সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ। অভিমানী এ কিশোরী অল্প বয়সেই চলে গেল পৃথিবী ছেড়ে। গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর থানার তাঁতিহাটি গ্রামের দরিদ্র পরিবারে জন্ম এ কিশোরীর। ধুনুকার দিনমজুর বাবার পক্ষে দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের যোগান দেয়া সম্ভব হতো না। দিতে পারতেন না প্রয়োজনীয় পোশাকও। যৌতুকের টাকার যোগান দিতে না পারায় বারবার বিয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছিল ধুনুকার। সবকিছুকে বিদায় জানিয়ে চলে যায় অভিমানী এ কিশোরি। এ বিষয়ে গোপালগঞ্জ থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি আত্মহত্যার ঘটনা দেশের মানুষকে নাড়া দিয়েছে। বিষণ্ণ করে তুলেছে। প্রতিদিনই তালিকায় যুক্ত হচ্ছে নতুন নাম। গত ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মোমিনের আত্নহত্যার ঘটনা আবার সবাইকে থমকে দেয়। তারও আগে তারেক আজিজ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ২০০৬-২০০৭ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ছিল তারেক। ২০১৬ সালের ১৬ মার্চ আজিজ পাড়ি জমায় পরপারে। তারেককে নিয়ে তার দরিদ্র কৃষক বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল। দেশের সর্বেোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়ে ছেলে একটি ভাল চাকরি করবে। তাদের কষ্টের অবসান হবে। অভাবের সংসারে আসবে স্বচ্ছলতা। কিন্তু হঠাৎ একদিন মা-বাবাকে ফাঁকি দিয়ে তারেক চলে গেল। সহপাঠীদের ভাষায় চুপচাপ, শান্ত স্বভাবের, নিপাট ভদ্র এই ছেলেটি সবসময় আনমনে কি যেন ভাবত। কারো সঙ্গে তেমন একটা কথা বলতো না। তারেকের মৃত্যু রহস্য সকলের কাছে এখনও অজানা।
এমনই এক যুবক ঝিনাইদহের পঁচিশ বছরের সোহেল। মা-বাবা বিয়ের পর ভেবেছিলেন নাতি-নাতনীর মুখ দেখবেন। মা-বাবার পছন্দে সোহেল ২০১৫ সালের ১০ অক্টোবর পাশের গ্রামের এক মেয়েকে বিয়ে করেন সোহেল। কিন্তু বউ পছন্দ হয়নি তার। বিয়ের রাতেই আত্মহত্যা করেন তিনি।
বাংলাদেশে প্রতিদিনই এরকম তুচ্ছ ঘটনায় আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও আত্নহত্যার হার অনেক বেশি। আইনী ঝামেলা ও সামাজিক লজ্জা এড়ানোর জন্য অনেকেই পুলিশ কিংবা গণমাধ্যমকে আত্নহত্যার সব ঘটনা জানাতে চায় না।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশে যুবক-যুবতীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। শিক্ষাজীবন শেষ করার পর চাকুরি না পাওয়া, জীবনের প্রতি হতাশা, প্রেমে ব্যর্থতা, নারীদের ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার হওয়ায় সামাজিক লজ্জা, স্বামী-স্ত্রীর বিশ্বাসঘাতকতা, বিয়ের পর যৌতুকের টাকার যোগান দিতে না পারা, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, চরম দারিদ্র্য– এরকম নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে।
পুলিশ হেডকোয়ার্টারের তথ্যমতে, বাংলাদেশে গত ৭ বছরে ১ লাখ ১৪ হাজার ৪শ ৪৯ জন আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে ২০১৫ সালে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটেছে। ওই বছর আত্মহত্যা করেছেন ১৭ হাজার ৬শ ২৩ জন।
পুলিশের তথ্যমতে, বাংলাদেশের সবচেয়ে আত্মহত্যাপ্রবণ অঞ্চল ঝিনাইদহ জেলা। ২০১০ সালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের একটি জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রায় ৬৫ লাখ মানুষ আত্মহত্যাপ্রবণ। প্রতিবছর এক লাখে প্রায় ১২৯ জন আত্মহত্যা করেন। এদের মধ্যে প্রায় ৮৯ শতাংশই নারী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নেহাল করিম চ্যানেল অাই অনলাইনকে বলেন, বাংলাদেশে নারীদের আত্মহত্যার প্রবণতা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, একবিংশ শতাব্দীতে এসে নারীরা পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চললেও বাংলাদেশে নারীদের একটি বড় অংশ এখনও শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। পুরুষের ওপর বেশি নির্ভরশীল। আবার অনেক পুরুষ মেয়েদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক মনে করছে, মেয়েদের নানাভাবে হয়রানি করছে। অনেকে আবার হেরে যাচ্ছে জীবনযুদ্ধে।
‘কিন্তু, আত্মহত্যা কোন সমাধান নয়।’
আত্মহত্যার মতো ঘটনা প্রতিরোধের উপায় হিসেবে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি নজরুল ইসলাম বলেন, ছোট থেকেই শিশুদের যৌক্তিক চিন্তার বিষয়টি শেখাতে হবে। পরিবার থেকে শুরু করে স্কুল কলেজ সব জায়গায়ই আবেগ নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা দিতে হবে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, আত্মহত্যা একটি মানসিক রোগ। বিষয়টি থেকে সমাজকে দুরে রাখার জন্য তারা স্কুল-কলেজ প্রতিটি পর্যায়ে পর্যাপ্ত কাউন্সেলিং এবং প্রচারণার আহ্বান জানান।