পাথেয়। মানে পথখরচ। গন্তব্যে পৌঁছার অবলম্বন। গন্তব্য আত্মশুদ্ধি। ভেতর-বাহিরের অশুদ্ধিকে জলাঞ্জলি দিয়ে শুদ্ধ হয়ে ওঠা। সোজা কথায় পাপ ছেড়ে পুণ্যে ফিরে আসা। আপাদমস্তক পুণ্যবান হয়ে ওঠা। অভীষ্ট জানা হলেও পথখরচের অভাবে পৌঁছা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বন্ধুর এ পথে মানুষ দু-আনা উপার্জন করে তো, চার আনা খরচ করে বসে। ফলে কর্জ পরিশোধ করতেই জীবন পার। শুদ্ধের অভিযানের শেষ প্রান্ত—আত্মশুদ্ধিতে পৌঁছা আর সম্ভব হয়ে ওঠে না।
তাই, পাপ-পুণ্যের কাটাকাটির এ চক্রে ঘুরতে থাকা মানবজাতির জন্য পরম দয়ালু আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন সিজনে রেখেছেন স্পেশাল অফার! মুহররম থেকে জিলহজ পর্যন্ত নানান উপলক্ষে নানানভাবে আসে সেসব অফার সামগ্রী। বছরজুড়ে আসতে থাকা সব অফার যদি স্বর্ণতুল্য হয়; তবে রমজানকে ধরতে হয় খাটি হিরা হিসেবে।
শুদ্ধাভিযানের প্রথম শর্ত যদি পাপের জলাঞ্জলি হয়; তবে দেখা যাক রমজানের ব্যাপারে দরদি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী ঘোষণা দিচ্ছেন? “যে ব্যক্তি ইমানের সাথে নেকির আশায় রমজানের সিয়াম পালন করে, তার অতীতের পাপরাশি ক্ষমা করে দেওয়া হয়”।
‘রমজান’ নামটির দিকে লক্ষ করলে ব্যাপারটা আরো সহজ হয়। সহজ বাংলায় এ-নামের অর্থ ‘পুড়িয়ে ফেলা’। আগুন যেভাবে মহাবন আমাজনকেও ছাড়ে না, রমজান তেমন পাপের অট্টালিকাকেও জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয়। এ-জন্যেই রমজানের নাম রমজান। সুতরাং নামেই যার এমন তাৎপর্য, কার্যত তার ফলাফল অনুমেয়। বিশুদ্ধ চিত্তে তাওবার মাধ্যমে যদি মাওলার দরবারে দুফোঁটা অশ্রু কবুল হয় তো, কাজ হয়ে গেছে। গন্তব্যে পৌঁছতে বাকি পথখরচ রমজানের পরতে পরতে।
সাহরি খেতে ওঠবেন, ফরজ নামাজের পর যেটি থেকে উত্তম নামাজ আর নেই(২), সেই তাহাজ্জুদের সুযোগ হয়ে যাবে। খতমে তারাবি পড়ুন, কুরআন পড়া হয়ে যাবে। নফল আদায় করুন, ফরজে রূপ নেবে। ফরজ আদায় করুন, সত্তর গুণ বৃদ্ধি পাবে(৩)। অবসরের অন্ত নেই। আপনার অবসর কাটাতে কুরআন এসে হাজির। পড়ুন, প্রতি হরফে দশ নেকি(৪)। রমজানের হিসাবে দশকে এবার সত্তর দিয়ে গুণ করুন। অন্যায়, অশ্লীলতা, গালাগালি করতে যান, রোজা আপনাকে আঁটকে দেবে(৫)। সাহরি থেকে ইফতার পর্যন্ত ঠিকঠাকভাবে রোজাটা পালন করুন, জান্নাতের সুসংবাদ এসে যাবে(৬)।
শেষ দশকে কেউ একজন মসজিদে ইতিকাফ পালন করুক, সবার পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে(৭)। সেই সাথে কুরআন অবতরণের রাত—পবিত্র শবে কদর! সুপার অফার! রাতজেগে সে রাতের বন্দেগি করুন, হাজার মাসের চেয়ে নির্ভেজাল বন্দেগির মকবুলিয়্যত পাওয়া যাবে(৮)। রোজা শেষে ঈদের সকালে সদকাতুল ফিতর আদায় করুন, রোজা খোদার শাহি দরবারে বিনা-বাধায় পৌঁছে যাবে(৯)।
পুরো মাসজুড়ে এভাবে ভালো কাজ করতে থাকলে, পাপ এড়িয়ে চললে, শুদ্ধাচারী হতে আর বাধা কীসে? মাত্র এক মাসে এত বেশি সুযোগ যে, আত্মশুদ্ধির বন্ধুর পথও কদর্যমুক্ত পিচঢালা রাস্তার মতো মসৃণ হয়ে ওঠে। তাই এ লেখার শিরোনাম করেছি ‘আত্মশুদ্ধির পাথেয় মাহে রমজান’। ব্যাপারটা অনেকটা এমন—রাস্তায় নামুন, আয় করুন, খরচ করুন, এগিয়ে যান। সোজা কথায়, ‘পথেই আয় পথের পথখরচ’।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা তেমনই অমোঘ বাণী শোনাচ্ছেন আমাদের।
ইরশাদ হচ্ছে—“হে ইমানদারগণ, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনটি ফরজ করা হয়েছিল পূর্ববর্তী উম্মতদের ওপর; যাতে তোমরা পরহেজগারিতা অবলম্বন করতে পারো(১০)।” ঐ যে, পরহেজগারিতা অবলম্বন। ওটাকেই শুদ্ধ বাংলায় আমরা আত্মশুদ্ধি বলে জানি। আর মহান রবের ঘোষাণা অনুসারে রোজার মাধ্যমেই তা সম্ভব।
অতএব, চলুন ফিরে আসি। এ ফেরা আজন্মের ফেরা হোক। শুদ্ধ হতে আরেকটি রমজান না-ও পেতে পারি। নিশ্বাস বন্ধ হবার আগেই অনিঃশেষ জীবনের পাথেয় সংগ্রহ করি। ‘দিন থাকিতে দীনের সাধন’ করার চেষ্টা করি। সময় গেলে যে সাধন হবে না।
তথ্যটিকা
১. বুখারি: ৩৮।
২. মুসলিম: ১১৬৩।
৩. মুসনাদে আহমদ: ৬৬২৬।
৪. তিরমিজি: ২৯১০।
৫. বুখারি: ১৯০৪।
৬. বুখারি: ২৮৪০।
৭. বাহারে শরিয়ত।
৮. সুরা কদর: ৩
৯. কানজুল উম্মাল: ২৪১২৪।
১০. সুরা বাকারা: ১৮৩