বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কথাশিল্পী, চলচ্চিত্র ও নাটক নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০১২ সালের এই দিনে সৃষ্টিশীল ও জনপ্রিয় এই লেখক যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে ইন্তেকাল করেন।
নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়ি ইউনিয়নের কুতুবপুর গ্রামে হুমায়ূন আহমেদের নিজ হাতে প্রতিষ্ঠিত শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠের উদ্যোগে নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাজ ধারণ, লেখকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, শোক শোভাযাত্রা, স্মৃতিচারণা, আলোচনা সভা, কোরআনখানি, মিলাদ ও দোয়া ইত্যাদি। এ ছাড়া বিনা মূল্যে চক্ষুবিষয়ক রোগের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সকাল থেকে চক্ষুশিবির বসানো হবে। নেত্রকোনা উপজেলা সদরে হুমায়ূন আহমেদ স্মৃতি সংসদ ও চর্চা সাহিত্য আড্ডার যৌথ উদ্যোগে শোক শোভাযাত্রা, স্মৃতিচারণা ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হবে।
এদিকে গাজীপুর সদর উপজেলার পিরুজালী গ্রামে হুমায়ূন আহমেদের নিজ হাতে গড়া প্রিয় নুহাশপল্লীতে কোরআনখানি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। নুহাশপল্লীর আশপাশের মাদ্রাসা ও এতিমখানার ছাত্র, পরিবারের সদস্য এবং হুমায়ূন আহমেদের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন লেখকসহ প্রায় ৬০০ জনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে এই আয়োজনে।
নুহাশপল্লীর ব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম জানান, দিনের কর্মসূচিতে অংশ নিতে হুমায়ূন আহমেদের দুই সন্তান নিষাদ, নিনিতসহ স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন নুহাশপল্লীতে যাবেন।
হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ফয়েজুর রহমান। একাত্তরে পাকাবাহিনী তাকে হত্যা করে। মা আয়েশা ফয়েজ। স্কুল জীবনে হুমায়ূন আহমেদকে পিতার চাকরিস্থল কুমিল্লা, সিলেট, বগুড়া ও পঞ্চঘরসহ বিভিন্ন জেলায় বসবাস করতে হয়। তিনি ১৯৬৭ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা (রাজশাহী বিভাগে মেধাতালিকায় দ্বিতীয়), ১৯৬৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
ছাত্র জীবনেই তার লেখালেখি শুরু। ১৯৭২ সালে তার প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশ পায়। তখন তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় উপন্যাস ‘শংখনীল কারাগার’। এই দুটি বই প্রকাশের পর হুমায়ূন আহমেদ একজন শক্তিশালী কথাশিল্পী হিসেবে পাঠকমহলে সমাদৃত হন। সেই থেকে জীবিতকালে তার দুই শতাধিক বই প্রকাশিত হয়।
দীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশক ধরে তিনি লেখালেখির সাথে যুক্ত ছিলেন। তার লেখায় বাঙালি সমাজ ও জীবনধারার গল্পমালা ভিন্ন আঙ্গিকে এবং রসাত্বক ও বিজ্ঞানস্মতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। গল্প বলায় ভাষার ব্যবহারে নিজস্ব একটা কৌশল এবং বর্ণনায় লোকজধারাকে প্রাধান্য দেন। বাস্তবতা থেকেই উঠে এসেছে তার প্রতিটি সৃষ্টিকর্ম। মানুষের মানচিত্রও উঠে এসেছে। বাংলা সাহিত্যের কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যে তাকে পথিকৃৎ বলেছেন সমোলোচকেরা।
তিনি উপন্যাস, গল্প, জীবনী, নাটক ও চলচ্চিত্র নিয়ে করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার লেখা কয়েকটি উপন্যাস, নাটক আর চলচ্চিত্র কালজয়ী কর্ম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। দীর্ঘদিন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন এবং লেখালেখিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে শিক্ষকতা থেকে তিনি অবসর নেন।
শিল্প-সংস্কৃতির প্রসারে হুমায়ূন আহমেদ গাজিপুরে প্রতিষ্ঠা করেন ‘নুহাশ পল্লী’। এই প্রতিষ্ঠানই ছিল তার সকল কাজের আঙ্গিনা। ২০১০ সালে সরকার হুমায়ুন আহমেদকে জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ করে।
হুমায়ূন আহমেদের ১১৮টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছে অন্য প্রকাশ। এই সংস্থার স্বত্তাধিকারী মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ গত শতকের অন্যমত জনপ্রিয় লেখক। তার সৃষ্টিশীলতার জন্যই তিনি এই জনপ্রিয়তা পান। মৃত্যুর পরও পাঠকরা তার বই ক্রয় করছেন। তরুণ সমাজ ও নতুন পাঠকরা এখনো তার বইগুলা কিনছেন। তার বই বিক্রয় খুব বেশি কমেনি। পুরোনো বইগুলো এখন বিভিন্ন বয়সের পাঠক সংগ্রহ করছেন। বাংলাসাহিত্যে এই লেখকের সৃষ্টি অনাদিকাল ধরে অক্ষয় থাকবে।
তার প্রকাশিত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বই হচ্ছে ‘জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প’, ‘মধ্যাহ্ন’, ‘হিমুর আছে জল’, ‘লীলাবতী’, ‘হরতন ইস্কাপন’, ‘হিমুর বাবার কথামালা’, ‘আমিও মিসির আলী’, ‘হিমু রিমান্ডে’, ‘মিসির আলীর চশমা’, ‘দিঘির জলে কার ছায়া গো’, ‘আজ হিমুর বিয়ে’, ‘লিলুয়া বাতাস’, ‘কিছু শৈশব’, ‘হুমায়ুন আহমেদের ভৌতিক অমনানিবাস’, ‘আগুনের পরশমনি’, ‘পাপ ৭১’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’। তার নির্মিত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘শংখনীল কারাগার’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘চন্দ্রকথা’, ‘শ্যামল ছায়া’ প্রভৃতি।
সাহিত্যে অবদানের জন্য হুমায়ূন আহমেদ একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, লেখক শিবির পুরস্কার, মাইকেল মধুসূদন পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেন।