আজ পহেলা বৈশাখ। ১৪২২ বঙ্গাব্দের প্রথম দিন। বাঙালির চিরন্তন ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় বর্ষবরণের আনন্দে, হালখাতার নবায়নে আজ জীবনে নতুন স্বপ্ন সাজানোর দিন। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক এ সর্বজনীন উৎসবের দিনটি সরকারি ছুটির দিন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে একাকার আজ নববর্ষে আমাদেরও প্রত্যাশা –
‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে…
মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক…
মুছে যাক গ্লানি,ঘুচে যাক জরা
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’
শাশ্বত সেই শুচিশুভ্রতার স্বপ্নে বিগত বছরের জীর্ণ মালিন্যকে পেছনে ফেলে আজ নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার দিন।সব অপ্রাপ্তি ভুলে গিয়ে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের লগ্নে একটি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়েই বাঙালি পালন করবে বৈশাখী উৎসব।
নববর্ষ উৎসব প্রায় চার হাজার বছরের পুরনো। বিশ্বনিখিলে সৃষ্টি ও সংহারে যে অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তন দেখা দেয়, তাকে গ্রহণ করে সৃষ্টির যে বার্ষিকী পালন করা হয়, তাকে ঘিরেই নববর্ষের উৎসব।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষণশীল নয়।এখন আর নববর্ষ পালনে প্রাচীন রক্ষণশীল মুসলমানদের বিরক্তিভাজন হতে কারও তেমন কোনো ইতস্তত ভাব নেই। বর্তমানে ধর্ম নির্বিশেষে বড় পরিসরেই নববর্ষ উৎসব পালিত হচ্ছে। দেশের জনগোষ্ঠীর স্বকীয়তায় সেই উৎসবের নাম বিচিত্র। যেমন চাকমাদের বিজু, মারমাদের সাংগ্রাইং, ত্রিপুরাদের বৈসু, রাখাইনদের সাংগ্রেং, পাংখোদের ডাইমাজের, খুমীদের সাংক্রাই, মুরংদের চাংক্রান, সাঁওতালদের বাহা পরব বা পুল উৎসব, ওঁরা ওদের ফাগুয়া ইত্যাদি।
চার হাজার বছরের প্রাচীন এই উৎসব পৃথিবীর অন্যত্র নানাভাবে অনুষ্ঠিত হয়। মেসোপটেমিয়ায় এই নববর্ষ বা আকিতু শুরু হতো নতুন চাঁদের সঙ্গে। ‘এনুমা এলিস’ মহাকাব্যের উপাখ্যানে অভিনয় করে জানান দেওয়া হতো কেমন করে সূর্যদেবতা মারদুপ বিশৃঙ্খল শক্তিকে পরাভূত করে নতুন নিখিল বিশ্বের জন্ম দেন। পারসিক রাজা নববর্ষের দিনে নিজেকে ড্রাগন হন্তারক হিসেবে জাহির করতেন।
ব্যাবিলনীয় নববর্ষ হতো মহাবিষুবের দিনে ২০ শে মার্চ এবং আসিরিয়ায় শুরু হতো জলবিষুবের দিনে ১১ই সেপ্টেম্বর। ওই দিনেই মিসর, তিউনিশিয়া ও পারসিকদের নতুন বছর শুরু হতো। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত গ্রিকদের নববর্ষ শুরু হতো ২১শে ডিসেম্বর।
রোমান প্রজাতন্ত্রে নববর্ষ শুরু হতো ১লা মার্চ এবং পরে তা শুরু হতো ১লা জানুয়ারিতে। ইহুদিদের নববর্ষ বা রোমা হাসানা শুরু হয় তৃতীয় মাসের প্রথম দিনে। অন্যদিকে ইউরোপে বেশিরভাগ দেশে নববর্ষ শুরু হতো পঁচিশ মার্চ। ১লা জানুয়ারি পাকাপোক্তভাবে নববর্ষের দিন হিসেবে নির্দিষ্ট হয় গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের পর। উত্তর গোলার্ধে, দক্ষিণ গোলার্ধে আবহাওয়াজনিত কারণে নববর্ষের মেজাজ বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে।
বাংলা নববর্ষ সম্রাট আকবর চালু করেছিলেন রাজস্ব আদায়ের জন্য। এর সঙ্গে যতই উৎসব আনুষ্ঠানিকতা থাক, মূলে ছিল অর্থনীতি। দেশে দাপ্তরিক কাজে এখন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার এবং বাংলা পঞ্জিকা দুটোই ব্যবহৃত হচ্ছে। নববর্ষের অর্থনৈতিক সম্পর্ক সূত্রেই জানা গেছে, জমিদারি প্রথা যতদিন চালু ছিল, ততোদিন বাংলা নববর্ষ পুণ্যাহ হিসেবে পালিত হতো। জমিদারি প্রথা বিলোপ হয়ে গেলেও এখনও পয়লা বৈশাখ থেকেই সরকারি জমিজমা ইজারার পত্তন শুরু হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যে ওই দিনেই নতুন বছরের জন্য হালখাতা খোলা হয়।
আমাদের দেশে ১০মার্চ ১৫৮৫ খ্রি. মোঘল সম্রাট বাদশাহ আকবরের ফরমান অনুযায়ী আমির ফতেউল্লাহ সিরাজী উদ্ভাবিত বাংলা ফসলি সাল নববর্ষ চালু হয়। ১০ মার্চ থেকেই তখন (১ বৈশাখ ছিল) নতুন সাল গণনা হতো। বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশের বাইরে এখন পয়লা বৈশাখই বাঙালির নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়। কিন্তু উদযাপনের দিন বাংলাদেশে বাংলা একাডেমীর সুপারিশকৃত পঞ্জিকাই অনুসরণ করা হয়।
নববর্ষের উৎসবে মেলাটাই বড়। তবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও কম আকর্ষণীয় নয়। রমনার অশ্বত্থতলে যা ‘রমনার বটমূলনামে পরিচিত’ নববর্ষের সঙ্গীতানুষ্ঠান শুরু হয় ১৯৬৮ সালের পয়লা বৈশাখ থেকে। এ উৎসব এখন এক বড় উৎসব। পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক শাসকরা রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে প্রগতিশীল সংস্কৃতিকর্মীরা এর বিরোধিতা করতেই পয়লা বৈশাখে সঙ্গীতানুষ্ঠান শুরু করে।
দিনে দিনে এ সঙ্গীতানুষ্ঠানের আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়। এবং শান্তিনিকেতনী ধাঁচে পয়লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠান সোৎসাহে উদযাপিত হতে থাকে। নব্বইয়ের দশক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে নববর্ষের জুলুস বা র্যালি বের হচ্ছে। তাদের মঙ্গল শোভাযাত্রায় জীবজন্তুর প্রতিকৃতি ও মুখোশের মিছিল শোভা পায়, যা নানা প্রতীকী অর্থে তারা উপস্থাপন করে থাকে। জয়তু বৈশাখ !