মুক্তির সুদীর্ঘ সংগ্রামের পথ ধরে যে বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সেই রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদকে মূলনীতি হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। মূলত মানুষের কল্যাণেই ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য।
একইভাবে তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিও ঠিক করেছিলেন সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে থেকে একে অন্যকে সহযোগিতা করা। অর্থাৎ ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয় এবং সব সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান’।
একজন নবীন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর শুরুটাই হয়েছিল মানুষের সুখ-সম্মৃদ্ধি-শান্তি আর কল্যাণের স্বপ্ন নিয়ে। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে যখন তিনি হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনই আসে তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও শান্তিতে অবদান রাখায় ১৯৭৩ সালে বিশ্ব শান্তি পরিষদ তাঁকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করে।
আজ ২৩ মে জাতির পিতার সেই শান্তি পদক পাওয়ার দিন। ৪৭ বছর আগে বিশ্ব শান্তি পরিষদের তৎকালীন মহাসচিব রমেশ চন্দ্র বঙ্গবন্ধুর গলায় ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক পরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে।’
রমেশ চন্দ্র সেদিন যে ভুল কিছু বলেননি, তার প্রমাণ পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান রেখেছিলন। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে নেতৃত্ব, ইসলামি সহযোগিতা সংস্থায় (ওআইসি) যোগদান ইত্যাদি ছিল তাঁর বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধুতে পরিণত হওয়ার প্রমাণ।
বিশেষ করে স্নায়ুযুদ্ধের সময় পুরো পৃথিবী যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে বিভক্ত ছিল, তখন বঙ্গবন্ধু জোট নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করে বিশ্বশান্তি ও ন্যায়ের পথে হেঁটে ছিলেন। এমন কি নির্ভয় ও দৃঢ় চিত্তে তিনি বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর বৃহত্তম শক্তি যে অর্থ ব্যয় করে মানুষ মারার অস্ত্র তৈরি করছে, সেই অর্থ গরিব দেশগুলোকে সাহায্য দিলে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে।’
আজ কয়েক যুগ পরেও বঙ্গবন্ধুর সেই ভাবনা প্রাসঙ্গিক, বাস্তব এক সত্য। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর কয়েক বছরের জন্য স্নায়ুযুদ্ধের সাময়িক অবসান হলেও নতুন রূপে তা শুরু হয়েছে আবার। এখন সেটা কখনো যুক্তরাষ্ট্র-চীনের, আবার কখনো যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার।
এই তো বছর কয়েক আগে রাশিয়া ইউক্রেনের অংশ ক্রিমিয়া দখল করে নতুন এক স্নায়ুযুদ্ধ শুরুর ঘোষণা দেয়। তারপর থেকে সিরিয়া, ভেনেজুয়েলা, ইরানেসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিজের শক্তি দেখিয়েছে। এর মধ্যে আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে জড়িয়ে চীন অন্য ধরনের এক যুদ্ধ শুরু করেছে। যে যুদ্ধের বলি হয়ে বহুদেশ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
সর্বশেষ চীনের উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পড়া মহামারী করোনাভাইরাসে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু আর আক্রান্ত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বার বার হুমকি দিচ্ছেন, এর দায় চীনকেই নিতে হবে। এই পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে বঙ্গবন্ধুর মতো একজন বিশ্বনেতার খুবই প্রয়োজন ছিল পৃথিবীর মানুষের।
সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইরান, ইয়েমেন, নাইজেরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যে যুদ্ধ-লড়াই চলছে, তার একমাত্র সমাধান; শান্তিপূর্ণ আলোচনা। আজ বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে হয়তো এসব যুদ্ধ অবসানে ভূমিকা রাখতেন।
তবে আমরা মনে করি, তিনি না থাকলেও তাঁর আদর্শ আজও বেঁচে আছে। সেই আদর্শকে কাজে লাগাতে হবে- মানব কল্যাণে, শান্তিতে।