সাভারের রানা প্লাজা ধসের সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার তিন বছর আজ। ওই ভবন ধ্বসের ঘটনায় ভবন থাকা পাঁচটি পোশাক কারখানা শ্রমিকসহ এক হাজার ১৭৫ জন শ্রমিক-কর্মচারী নিহত হন। ঘটনায় আহত হন আরও কয়েক হাজার।
রানা প্লাজা ধসে হতাহতদের তাৎক্ষণিক ঠিকানা হয়ে ওঠেছিল এনাম মেডিকেল কলেজ। মেডিকেল কলেজটির চেয়াম্যান ডা. এনাম নিজের সীমিত সাধ্য নিয়ে, ডাক্তার, স্টুডেন্টস, নার্স সহ তার সব স্টাফ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সাভার ট্র্যাজেডির শুরু থেকে দরিদ্র শ্রমিকদের সেবায়।
রানা প্লাজা ধসের তৃতীয় বছরে চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে কথা হয় এনাম মেডিকেল কলেজের চেয়ারম্যান ডাঃ মো. এনামুর রহমান এমপির সঙ্গে। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারীর নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ডা: এনামুর রহমান।
তিন বছর আগে এই দিনের প্রসঙ্গ তুলে ডা. এনাম বলেন, আমাদের এ ধরণের প্রাকটিস ছিল, সাভারের স্পেকট্রাম গার্মেন্টস ধস, হামীম গ্রুপ ও তাজরীন ফ্যাশনের আগুন লাগার ঘটনার সময় ও আমরা শ্রমিকদের সঠিক সেবা দিয়েছিলাম, এছাড়াও ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে বিভিন্ন সময়ে দুর্ঘটনায় আমরা অসহায় দুস্থ রোগীদের পাশে সঠিক চিকিৎসা দিয়েছি।
আমাদের হাসপাতালের প্রতিটি স্টাফ জানে, সেবাই আমাদের ধর্ম। অর্থের অভাবে কোন রোগী ফেরত যাবে না, আগে চিকিৎসা পরে ব্যবসা। অনেক রোগী চিকিৎসা ব্যয় দশ লক্ষ টাকা ছাড়িয়ে গেলেও অর্থের অভাব জানার পর আমরা তাদের চিকিৎসা ফুল ফ্রি করিয়েছি।
রানা প্লাজা ধসের দিন আমি খবরটি পাই আমাদের হাসপাতালের পরিচালক ডা. আনোয়ারুল কাদির নাজিম কাছ থেকে। এনামুর রহমান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘‘ঘটনা জানার সঙ্গে সঙ্গে দুর্যোগ মোকাবিলার নির্দেশ দিয়ে সাধারণ সেবা বন্ধ করে দিতে বলি হাসপাতালের কর্মরতদের। চিকিৎসক-নার্সদের প্রস্তুতি নিতে বলি। যেসব চিকিৎসক বিকেল ও রাতের ডিউটির জন্য হোস্টেলে বিশ্রামে ছিলেন তাদেরও কাজে যোগ দিতে বলি। সকল ক্লাস স্থগিত করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরও দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে বলি।”
তিনি বলেন, ‘‘ঘটনার ভয়াবহতা আঁচ করে অপারেশন থিয়েটারে নির্ধারিত সব অপারেশন স্থগিত করে ১৮টি ওটি প্রস্তুত রাখা হয় জরুরি সার্জারির জন্য। ব্লাড ব্যাংকে বলে রাখা হয়, চাওয়া মাত্র রক্ত দিতে হবে। নতুন করে রক্ত সংগ্রহ করতেও বলা হয়। সকল প্রকার ওষুধের জন্য গোডাউন খুলে দেওয়া হয়।’’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসা করে ডা. এনাম বলেন, ‘‘ঘটনা ঘটার বিশ মিনিটের মাথায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফোন পাই, প্রধানমন্ত্রী বলেন তোমার প্রতি আমাদের বিশ্বাস আছে, আজকে এই অসহায় শ্রমিক ভাই বোনদের জন্য সর্বোচ্চ সেবা দিবা, হাসপাতালে যেনো কোনো রোগীর মৃত্যু না হয়। আমি শেখ হাসিনা তোমার পেছনে আছি, তোমার যা লাগে আমি করবো। প্রধানমন্ত্রী আমায় আরো বলেন, কোনো বৈদেশিক সাহায্য নিবা না যা করার আমরা করবো।’’
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ, মহান আল্লাহ ইচ্ছায় আমাদের সকলের সহযোগিতায় হাসপাতালে আহত কোনো রোগীর মৃত্যু হয়নি। প্রথম দিনেই আমরা এক হাজার রোগীর সেবা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছি, তারা বেশি আহত ছিলেন না। প্রথম চার দিনে আমরা দুই হাজার সাতশ’ ৭৬ জন আহত শ্রমিকের সঠিক সেবা নিশ্চিত করেছি। আমাদের আইসিইউতে তিন মাস ৩২ জন রোগীকে রেখে সঠিক চিকিৎসা প্রদান করেছি।
ডা. এনাম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময় ওই দিনগুলোতে আহত রোগীদের খবর নিতেন, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে ওষুধ খাবার সহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করা হতো। এছাড়াও স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য সচিব নিয়মিত খোঁজখবর রাখতেন।’’
মানুষের সেবা করার ব্রত নিয়েই চিকিৎসা পেশায় এসেছিলেন ডা. এনামুল রহমান। যার মূলে ছিলো সেবাই ধর্ম, তবে এক সঙ্গে এতো মানুষের সেবা দিতে পারবেন কখনোই ভাবেননি তিনি।
ডা.এনাম বলেন, ‘‘মানুষকে সেবা দেওয়ার স্বপ্ন নিয়ে হাসপাতাল করেছি। সেই চাওয়াটা এভাবে পূরণ হবে, তা ভাবিনি। সাভার সহ দেশ বিদেশের মানুষের যে স্বীকৃতি ও ভালোবাসা পেয়েছি তাও কল্পনা করতে পারিনি। সাভারে আমার প্রথম পোস্টিং ১৯৮৫ সালে সাভার উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে। ১৯৮৮ সালে সাভার থেকে আমাকে বদলী করা হয় সাটুরিয়ায়। সাভারের মানুষ তখন আমাকে যেতে দেয়নি। তারা আমাকে বলেন আপনি এখানেই থাকবেন, প্রয়োজন হলে এখান থেকে অফিস করবেন। পরে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত আমি সাটুরিয়ায় চাকরি করি এবং সাভারে ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখি।
কিন্তু ১৯৯২ সালে যখন আমকে গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় বদলী করা হয় তখন কিন্তু আমি আর গোপালগঞ্জ থেকে সাভারে রোগী দেখতে পারিনি। সাভারের ও আশপাশের এলাকার মানুষের ভালবাসায় আমি চাকুর ছেড়ে দেই এবং ছয় শয্যা বিশিষ্ট এনাম ক্লিনিক নামে একটি ক্লিনিক চালু করি। সেখান থেকে এক হাজার রোগীর চিকিৎসা সেবা দিতে পারি এখন আমরা।’’
এলাকার এমপি নির্বাচিত হবার পর আমার দ্বায়িত্ব আরও বেড়ে গেছে। চ্যানেল আই অনলাইনকে ডা. এনাম বলেন, ‘‘এনাম মেডিকেলে গত তিন বছরে চারটা বিশেষজ্ঞ মানের অপারেশন থিয়েটার, আলাদা কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগ, রেডিয়াক অনকোলজি বিভাগ, হাই টেক ট্রান্সপ্লাট বিভাগ চালু করেছি। আরও পাঁচ’শ বেড বাড়ানো হয়েছে। এছাড়াও হাসপাতালে উন্নত মানের অডিটেরিয়াম, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও ফ্যাকাল্টি রয়েছে।’’
ডা.এনাম বলেন, ‘‘সাভারের সাধারণ গণমানুষের সাহসে ভালোবাসায় এনাম মেডিকেলকে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিকমানের একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল হিসেবে রূপ দিতে চাই।’’