বসন্তের নরম বাতাস ধীরে ধীরে গরম লুতে পরিণত হচ্ছে। তার মানে বৈশাখ এসে গেছে। বৈশাখ মানে বাঙালি জীবনে নতুন একটি বছর। আর এই বছরকে বরণ করতে আয়োজনের শেষ নেই বাঙালিদের। বছরের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখে ঘরে ঘরে যেমন থাকে নতুন আয়োজন তেমনি হাটে মাঠে ঘাটেও চলে নানা মেলা আর উৎসব। আর এই উৎসবে প্রাণ দোলে উঠে সবার। যুগে যুগে এই বৈশাখী আয়োজন বদলেছে। বদলেছে মানুষের মনের ধরণও। সেদিন আর এদিনের আয়োজন আর মননেরও হয়েছে পরিবর্তন। তারকাদের শৈশব-কৈশোরের সেই বৈশাখী আয়োজন কেমন ছিল তাদের জবানীতে জানা যাক-
মেলাতে গুড় দিয়ে বানানো কটকটি খুব পছন্দ করতাম : আলী যাকের
আমার শৈশব কেটেছে খুলনা ও কুষ্টিয়ায়। যদিও আমার জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে। বাবার সঙ্গে বৈশাখী মেলায় যেতাম। অনেক খেলনার মধ্যে মাটির দুই চাকা লাগানো টমটম পাওয়া যেত, যেটা সুতা দিয়ে বেঁধে টেনে নিলে ডামডাম আওয়াজ হতো। আমার খুব প্রিয় ছিল খেলনাটি। মেলায় পাওয়া যেত মজার মজার খাবার। মেলাতে গুড় দিয়ে বানানো এক ধরণের কটকটি পাওয়া যেত। আমি কটকটি খেতে খুব পছন্দ করতাম।
আমার কৈশোর ও যৌবন কেটেছে ঢাকার গেন্ডেরিয়ায়। স্কুল ও কলেজের সময়টায় বন্ধুদের সঙ্গে বৈশাখী মেলায় গিয়ে কি আনন্দটাই না করতাম তা আমরা।
পহেলা বৈশাখ ভোরে রমনা বটমূলে যাওয়া আমার দীর্ঘদিনের রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। কারণ আমি ছায়ানটের সঙ্গে যুক্ত। তাই বর্ষবরণের দিনটি ওখান থেকেই শুরু করি। এরপর এখানে-সেখানে নানা জায়গায় যাই। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করি। বৈশাখের উপহার হিসেবে তাদেরকে আমি গাছ দিই। এটি আমার অনেক দিনের পুরনো রীতি।
পাকিস্তানিদের দমন-পীড়নের প্রতিবাদেই পহেলা বৈশাখের প্রচলন হয় : আবুল হায়াত
পহেলা বৈশাখের স্মৃতি আমার অন্য সবার মতোই। বৈশাখী মেলায় গিয়ে মোয়া-মুড়কি, মন্ডা-মিঠাই খাওয়া। ষাট দশকের শুরুতে আমি ঢাকায় আসি। সে সময় পাকিস্তানিরা নানাভাবে বাংলা সংস্কৃতির উপর দমন-পীড়ন শুরু করে। তারই প্রতিবাদে রমনা বটমূলে ছায়ানট জোরেশোরে বর্ষবরণ শুরু হয়। এই আয়োজনের আশে পাশে তখন ছোট ছোট বেশ কয়েকটি মেলা বসতো। মেলায় ঘুরে বেড়াতে খুব ভালো লাগতো। এরপরে বহুবার গিয়েছি রমনায় গান শোনার জন্য। এখন বয়স হয়েছে, তাই এতো ভীড়ের মধ্যে রমনায় যাওয়ার সাহস পাই না। বাড়িতে পরিবার পরিজন নিয়েই সময়টা কেটে যায়।
কাছের মানুষদের বৈশাখী উপহার দিতে ভালোবাসি : ফেরদৌস ওয়াহিদ
ছোটবেলায় গ্রামের বড় মাঠের মেলা আর সবার সাথে কুশলাদি বিনিময়েই বৈশাখের মজাটা সীমিত ছিল। বাড়িতে অন্য দিনগুলোর চেয়ে একটু ভালো খাবার- দাবারের আয়োজন থাকতো। সে সময় আমাদেও পরিবারের বড়রা বলতেন, বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন যদি ভালো খাওয়া-দাওয়া না করা হয়, তাহলে সারা বছর কপালে ভালো খাবার জুটবে না। পহেলা বৈশাখে এখন একটা ব্যাপার ঘটে, সেটি হলো ‘উপহার’। আমি নিজে প্রচুর প্রচুর উপহার পাই, তেমনি কাছের মানুষদেরও বৈশাখী উপহার দিতে ভালোবাসি।
মেলার বারো ভাজার দোকানে সবচেয়ে ভিড় থাকত : জুয়েল আইচ
মাঠে ময়দানে তো হতোই, তাছাড়া গ্রামের সব বড় বাড়ির সামনেও বৈশাখী মেলা বসত। সকাল হতেই ঢোল-বাদ্যি নিয়ে বাজনা শুরু হতো, তাল-লয়ের ঠিক নেই, শুধুই উচ্চকিত সে বাজনাতেই আমরা ছুটে যেতাম, দেখতাম কত কিছুর পসরা বসতে শুরু করেছে। সেদিন বাড়িতেও বিশেষ খানাপিনা থাকত। বাড়ির রোজগার করা মানুষদের কাছ থেকে পয়সা নিয়েই ছুটতাম মেলাতে। মেলার বারোভাজার দোকানে সবচেয়ে ভিড় থাকত। খেলনা বাসন মিলত, মিলত কাঠের আসবাবও। এসবের মাঝে হটাৎ হয়তো দেখা মিলত বায়োস্কোপওয়ালার। সুন্দর সেজে আসত তারা, ঘুঙুর বাজিয়ে নেচে গেয়ে তারা দেখাত সেই বায়োস্কোপ। এরপর পুতুল নাচও দেখা যেত। একটু বড় মেলা হলেই সার্কাস পার্টি চলে আসত, নতুবা দেখা যেত নাগরদোলা।
আমাদের সময় এতটা লোক দেখানো অনুষ্ঠান হতো না : ইলিয়াস কাঞ্চন
আমার শৈশব- কৈশোরের পহেলা বৈশাখের সঙ্গে এখনকার বৈশাখ উদযাপনের বিস্তর ফারাক। আমাদের সময়ে এতটা লোক দেখানো অনুষ্ঠান হতো না। শহরে এবং গ্রামের বড় বড় মাঠে মেলা বসত। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ঢাকাতে সবচেয়ে বড় মেলা হতো পুরান ঢাকায়। আমরা বন্ধুরা দলবলে ঘুরতে যেতাম। তখন রমনায় এখনকার মতো বৈশাখ বরণ উৎসব হতো না।
এখনকার বর্ষবরণে আগের মতো প্রাণ পাই না : আফসানা মিমি
আমার শৈশবে নিরেট বাঙালি সংস্কৃতিটাই প্রচলিত ছিল। বন্ধুদের সঙ্গে দলবেঁধে বৈশাখী মেলা দেখতে যেতাম। নাগরদোলায় উঠতাম। দেখা হতো বায়োস্কোপ, আরও কত কী। কিন্তু এখন বাংলা বর্ষবরণে মানুষের অংশগ্রহণ বেড়েছে ঠিকই কিন্তু তা পান্তা-ইলিশ আর ছবি তোলা পর্যন্তই। তাই এখনকার বর্ষবরণ আগের মতো আর প্রাণ পাই না আনন্দও করতে পারি না।
ছবি : সংগৃহীত