রাজধানীর চকবাজারে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে এখন পর্যন্ত ৭৮-এ দাঁড়িয়েছে। দগ্ধসহ আহত অর্ধশতাধিক।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ জানিয়েছেন, চুরিহাট্রায় অগ্নিদগ্ধে নিহতদের মধ্যে যাদের মরদেহ পুরোপুরি পুড়ে গেছে তাদেরকে শুধু দেখে শনাক্ত করা সম্ভব নয়। এমন মরদেহগুলোর পরিচয় ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
আগুনে পুড়ে যাওয়া মৃতদেহগুলোর নাম-পরিচয় জানাতে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করছে সিআইডি।
নিহতদের মধ্যে পুরুষ ৬৬ জন, নারী ৭ জন ও শিশু ৫ জন বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে দগ্ধ ৯ জন ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে ভর্তি, একজন আইসিইউতে চিকিৎসাধীন।
আগুনে মৃতদের অনেকের বাড়ি নোয়াখালীর সোনাইমুড়িতে। তাদের কয়েকজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন: গোসকামতার বাজারের দুই ভাই রাজু ও রানা; নাটেরশর বাজারে বটতলীর শাহাদাত হোসেন হিরা, মির্জা নগরের আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও নাছির।
মৃতদের তালিকা করছে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি।
নতুন করে আগুন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা
টানা দশ ঘণ্টারও বেশি সময়ের চেষ্টায় নিয়ন্ত্রণে আসার পর আগুন আশপাশে ছড়ানোর আর আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার কিছুক্ষণ আগে হঠাৎ করেই পুড়ে যাওয়া একটি ভবনের দোতলায় নতুন করে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য কিছুক্ষণের চেষ্টাই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সফল হয় ফায়ার সার্ভিস।
এলাকাবাসীসহ উদ্ধারকর্মীরা বলছেন, পুড়ে যাওয়া যানবাহনগুলো সংকীর্ণ রাস্তার এখানে সেখানে পড়ে থেকে উদ্ধারকাজে বাধা সৃষ্টি করছে। এছাড়া সেগুলোসহ ঘটনাস্থলে থাকা ভারী পলিথিন জাতীয় দ্রব্য এবং অন্যান্য কেমিক্যাল সরঞ্জাম দাহ্য পদার্থের কাজ করছে। যার ফলে নতুন করে আগুন লেগে যাওয়ার আশঙ্কা থাকছে।
রাস্তায় পড়ে থাকা আগুনে পোড়া যানবাহন ও বিভিন্ন সামগ্রী রং স্তুপ সরিয়ে নিতে সিটি কর্পোরেশন এখনো কাজ শুরু না করায় নিহতদের খোঁজে তল্লাশি করতে পারছে না ফায়ার সার্ভিস।
তাই যত দ্রুত সম্ভব এগুলো ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে নিতে সিটি কর্পোরেশনের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।
যেভাবে আগুনের শুরু
বুধবার রাত ১০টা ৩৮ মিনিটে চকবাজারের নন্দ কুমার দত্ত রোডের শেষ মাথায় মসজিদের পাশে ৬৪ নম্বর হোল্ডিংয়ের ওয়াহিদ ম্যানসনে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়।
এলাকাবাসী বলছে, ওই ভবনের কারখানা থেকে আগুন ছড়িয়েছে। কেউ বলছে বৈদ্যুতিক টান্সফরমার বিস্ফোরণ আবার কেউ বলছে বিকট শব্দে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর আগুন ছড়ায়। ওয়াহিদ ম্যানসনের নিচতলায় প্লাস্টিকের গোডাউন ছিল। ওপরে ছিল পারফিউমের গোডাউন।
এ আগুন নেভাতে ঘটনাস্থলে ছুটে আসে ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি স্টেশনের ৩৭টি ইউনিট। ফায়ার সার্ভিসের কন্ট্রোল রুম সকাল ৯টার দিকে জানিয়েছে, টানা দশ ঘণ্টারও বেশি সময়ের চেষ্টায় নিয়ন্ত্রণে এসেছে আগুন। পুড়ে যাওয়া ভবন থেকে এখন উদ্ধারকাজ চলছে।
ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট এবং বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার।
সরকারের বক্তব্য
সড়ক পরিবহন ও সেতু বিষয়ক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, আগুনের ঘটনা খতিয়ে দেখে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে সরকার। আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার আশ্বাসও দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা ও পূনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে সরকার।
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘নিমতলীর ট্র্যাজেডির পরেও যে ঘটনা ঘটলো তা আমাদের জন্য শিক্ষা। এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে সেই পদক্ষেপ নেয়া হবে। তদন্ত রিপোর্ট পাওয়া সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
প্রধানমন্ত্রী সারাক্ষণ এ ব্যাপারে খবরাখবর নিচ্ছেন বলে জানান কাদের।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, যদি সিটি কর্পোরেশন চায় তবে চকবাজার এলাকা থেকে কেমিক্যালের সব গুদাম সরিয়ে নেয়া হবে। ‘এসব কেমিক্যাল কারখানা সরানোর জন্য আমরা সব ধরনের সহায়তা দেবো, যদি মেয়র সহায়তা চান। সরকার সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে।’
নিহতদের এক লাখ ও আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে অর্থ সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে শ্রম মন্ত্রণালয়।
ঘটনা তদন্তে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের সাঈদ খোকনের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকার উপ-পরিচালক দেবাশীষ বর্ধনকে প্রধান করে আরেকটি তদন্ত কমিটি করেছে ফায়ার সার্ভিস।
আহতদের সর্বোচ্চ সেবা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
আগুনে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, বিরোধী দলীয় নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।