২১ আগস্ট, ২০০৪; ভয়াবহ বিভীষিকা নেমে এসেছিল বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে। রক্ত-লাশ আর আহাজারিতে ভারী হয়েছিল প্রতিবেশ। সেদিন নারকীয় রক্তখেলায় মেতে উঠেছিল খুনিরা, কেঁপে উঠেছিল রাজধানীর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। উদ্দেশ্য বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা করা।
সে হামলার ঘটনায় শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে যান। দলীয় নেতাকর্মীদের মানববর্ম রক্ষা করে তাকে। প্রথমে গ্রেনেড, এরপর মুহুর্মুহু গুলি। খুনিরা খুন নিশ্চিত করতে চেয়েছিল বলে গ্রেনেডের পর গুলি করে। কিন্তু চলমান ঠুনকো বাক্যের ‘প্রাণাধিক প্রিয়’ শব্দদ্বয় নয়, সত্যিকার অর্থে দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে প্রাণাধিক প্রিয় শেখ হাসিনাকে রক্ষা করে তারা; নিজেদের জীবনও বিলিয়ে দেয় তার তরে।
শেখ হাসিনার প্রতি জনমানুষের এই ভালোবাসা, এই আত্মত্যাগ যেন বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উত্তরসূরির প্রতি আবেগের প্রকাশ। এই আবেগ এতখানি প্রগাঢ় ছিল যে নিজের জীবনের পরোয়া করেনি কেউ। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও গুলির সামনে দাঁড়িয়ে গেছে মানুষ; উদ্দেশ্য একটাই শেখ হাসিনাকে রক্ষা।
বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে চলা এই তাণ্ডবলীলা কারা চালিয়েছে, কারা শেখ হাসিনাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছে সেটা অপ্রকাশ্য নয়, প্রকাশিতই; বাকি কেবল বিচারিক পর্যায়ের আনুষ্ঠানিক প্রকাশ। তবে এই ঘটনার তদন্ত, অভিযোগপত্র এবং বিচারিক প্রক্রিয়া শেষের পথে চলে আসায় সকলেই জেনে গেছে এর সঙ্গে তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামি জড়িত। তাদের দীর্ঘ পরিকল্পনার ফল ছিল এই হামলা ও নারকীয়তা। এরসঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পুত্র এবং বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। যুক্ত ছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, জামায়াতে ইসলামির সেক্রেটারি জেনারেল যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, জঙ্গি নেতা মুফতি মোহাম্মদ আবদুল হান্নান সহ সরকার ও প্রশাসনের অনেকেই।
হামলায় জড়িতদের সকলের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিচয়-পদবি প্রমাণ করে এটা ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তারা যেকোন মূল্যে শেখ হাসিনাকে হত্যা করে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান পোক্ত করতে চেয়েছিল।
২১ আগস্টের ভয়াবহ ওই ঘটনার পর তৎকালীন সরকার এর বিচার করেনি। করবে কীভাবে, নিজেরাই যেখানে জড়িত সেখানে বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদা ছাড়া আর উপায় ছিল না। সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ওই হামলাকে এতখানি গুরুত্বহীন ও নাটুকে আখ্যা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, শেখ হাসিনা ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড-বোমা নিয়ে গিয়েছিলেন। সে সময়ের মন্ত্রী ও বিএনপি নেতারা গ্রেনেড হামলার জন্যে আওয়ামী লীগকেও দায়ী করে বক্তব্য দিয়েছিলেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জজমিঞা নামের একজনকে দাঁড় করানো হয়। পরবর্তীকালে তার বক্তব্যগুলোও মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামি নামের দুইটা রাজনৈতিক দলের হত্যাকাণ্ডের এমন সরকারি সিদ্ধান্ত হাল-আমলের সভ্যতার ন্যক্কারজনক উদাহরণ। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে এত বড় একটা ঘটনার পরেও দলটি অনুশোচিত হয়নি। উল্টো দলের নেতৃত্বস্থানীয় কয়েকজনের এমন সিদ্ধান্তকে সমর্থন দিয়ে গেছে পুরো দল ও তাদের সমর্থকেরা। অপরাধীরা তাদের সময়ে নানাভাবে পুরস্কৃত হয় ক্ষমতা ও পদ-পদবিতে। অন্য অনেক ঘটনার বাইরেও এর প্রমাণ মেলে তদন্তের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের আসামির তালিকায় পরবর্তী সময় নাম অন্তর্ভুক্তিতে। অর্থাৎ বিচারের পথ রুদ্ধ করে দিতে বিএনপি-জামায়াত তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছিল তাদের এই গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা যারা আগে থেকে ওয়াকিবহাল, অথবা সঠিক তদন্তে আগ্রহী নন।
বিএনপি-জামায়াত তাদের শাসনামলে এত বড় এক অপরাধের পরেও এর বিচার করেনি। বিচারের দৃশ্যমান কাজ শুরু হয়েছিল তাদের ক্ষমতা ছাড়ার পর। এরপর আওয়ামী লীগ পুনর্বার ক্ষমতায় আসার পর বিচারিক পর্যায়ে গেছে এই মামলা।
এই হামলার ঘটনার ১৪ বছর অতিক্রান্ত হলেও এখনও সর্বশেষ শুনানি হয়নি। বর্তমানে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর শুনানি চলছে। রাষ্ট্রপক্ষের আশা সেপ্টেম্বরেই এই শুনানি শেষ হবে; যদিও গত বছরও এমনটা জানিয়েছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিরা। এখানে দীর্ঘ অপেক্ষা আছে তবু এরপরেও আশাবাদী হতে হচ্ছে কারণ এর সঙ্গে আইনমন্ত্রীও শোনাচ্ছেন আশাবাদের কথা; তিনি বলছেন এই সেপ্টেম্বরে রায়ের কথা।
কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বলে বিরোধী রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাকে হত্যার জন্যে গ্রেনেড হামলার মত এমন ঘটনা বাংলাদেশে দিনে দুপুরে আগে হয়নি। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছিল রাতের অন্ধকারে, তাঁর বাড়িতে। দেশের বাইরে থাকার কারণে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। পঁচাত্তরের বঙ্গবন্ধুর খুনির রক্তের সেই উত্তরাধিকার ও রাজনৈতিক সুবিধাভোগী সম্প্রদায়ের সেই রক্ত পিপাসা শেখ হাসিনাকে প্রাণে মেরে ফেলার মাধ্যমে পূর্ণতা পাওয়ার যে দুরভিসন্ধি ছিল সেটা একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে, খুনিদের রক্তের উত্তরাধিকার ও তাদের সমর্থকদের কাছে এখনও একুশে আগস্টের নারকীয়তা স্রেফ একটা ঘটনাই। এই বীভৎসতা এক শ্রেণির মানুষকে নাড়া দিতে পারেনি তখনও, এখনও। তাই কেউ কেউ এখনও এমন নারকীয়তার বিচারের দাবি করে না। কতখানি লজ্জাহীন ও অমানবিক হলে মানুষ এমন ভয়াবহ ঘটনার কুশীলবদের প্রতি দুর্বল থাকে, রাজনৈতিকভাবে সমর্থন জানায়?
সেই দিন শেখ হাসিনা অল্পের জন্যে প্রাণে বেঁচে যান। এতকিছুর পরও তিনি খুনি ও তাদের দোসরদের প্রতি তেমনভাবে কঠিন নন। চৌদ্দ বছরের দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করছেন বিচারের। এই বিচারের জন্যে আদালতকে চাপ প্রয়োগ করেননি; এটাকে নিশ্চিতভাবেই মহানুভবতা বলা যায়, এই ক্ষেত্রে বিচার ব্যবস্থার প্রতি তার আস্থা প্রকাশ পায়; এবং প্রশংসা করা যায় তার ধৈর্যক্ষমতার।
কেবল এই হামলা নয় এরআগে থেকে শেখ হাসিনা একের পর এক প্রাণনাশের অপচেষ্টার মুখোমুখি হয়েছেন। বার বার তিনি ফিরে এসেছেন সব হামলা থেকে। বাইরের মানুষজন তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল আর দলীয় নেতাকর্মীরা জীবন দিয়ে তাকে রক্ষা করেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনো রাজনৈতিক নেতাকে এতবার এমন কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছিল কিনা কে জানে! সেই দিন হামলার প্রধান লক্ষ্য শেখ হাসিনা প্রাণে বাঁচলেও বাঁচতে পারেননি আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমান, ল্যান্স করপোরাল অব. মাহবুবুর রহমানসহ ২৪ জন; এছাড়াও সেদিন আহত হন কয়েকশ লোক।
এই ঘটনা শেখ হাসিনাকে তার দৃশ্যমান শত্রুকে চেনাতে সাহায্য করেছে কিনা জানি না, কিন্তু করা উচিত। শত্রুর প্রতি তিনি কঠোর নন ঠিক, তবে একেবারে ভাবলেশহীন থাকা ঠিক হবে না। এর বাইরে অচেনা শত্রুদের নিয়েও সতর্ক থাকা দরকার তার।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী সরকার টানা দশ বছরের শাসনামলের শেষ সময়ে। এই মুহূর্তে শেখ হাসিনার চাইতেও বড় আওয়ামী লীগার ও বঙ্গবন্ধুপ্রেমির অভাব নাই দেশে, কিন্তু তাদের প্রকৃত চেহারা কী সেটা কেউ জানে না। এরা কোনো একটা সময়ে ভয়ঙ্কর হয়েও উঠতে পারে, সুযোগে। এদেরকে কে চিনবে? এনিয়েও প্রশ্ন আছে!
ইতিহাস বলে বঙ্গবন্ধু খন্দকার মোশতাককে পছন্দ করতেন, মোশতাক তার চাতুর্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। এদিকে শেখ হাসিনা হালের খন্দকার এবং মোশতাকদের আসল রূপ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কতখানি সে নিয়েও প্রশ্ন আছে। বলা হয়ে থাকে শেখ হাসিনার পাশেও অনেক মোশতাক, অনেক খন্দকার। কতজনকে সামাল দেবেন তিনি, অথবা তিনি তার কতখানি খবর রাখেন-জানি না।
পঁচাত্তরের পর খন্দকার মোশতাকদের ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কিন্তু মোশতাকদের সে প্রেতাত্মারা খন্দকার এবং মোশতাক নাম ধারণ করে হয়ত পৌঁছে গেছে শেখ হাসিনার কাছাকাছি। তেমন কিছু হলে তারা যে কোন সময়ে আঘাত হানতেও পারে। এমন কোন কিছু হলে বর্ণচোরা গোত্রের খন্দকার এবং মোশতাকদের বিতাড়ণের দরকার, সম্ভব না হলে দরকার ক্ষমতা হ্রাস করার। কে বা কারা তারা এটা বের করার দায়িত্বও দলের।
২১ আগস্ট পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ধারাবাহিকতা। বাসায় ঢুকে জাতির জনককে রাতের অন্ধকারে সপরিবারে হত্যার পর প্রকাশ্য দিবালোকে তাঁর মেয়েকে দলশুদ্ধ হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল খুনিরা। এটা খুনিদের আদর্শিক উত্তরাধিকারদের কাজ। ১৫ আগস্টের খুনি ও পরিকল্পনাকারীদের সঙ্গে এর সম্পর্ক নিবিড়, রক্ত-সম্পর্কীয় হয়তো।
নারকীয়তার সে দিনের পর এখনও বাংলাদেশে কতিপয় লোক এই ঘটনা ভুলে যাওয়ার সবক দেয়। তারাও খুনিদের উত্তরাধিকার, সমর্থক। সমভাবে ঘৃণা তাদের প্রতিও। খুনিরা এই দেশে রাজনীতি করছে, তাদের অনেক সমর্থকও আছে দেশে- এটা আমাদের লজ্জাও। আমরা লজ্জিত খুনি ও তাদের সমর্থকদের দেখে, অথচ এমন ঘটনার পর দায়ি দলটির অস্তিত্বই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কথা ছিল দেশ থেকে। তা হয়নি। এই হামলার অব্যবহিত পর থেকে এখন পর্যন্ত বিএনপির অনুশোচনা নাই এ নিয়ে, তারা এখনও এ নিয়ে নানা কথা বলে; খুব সাদামাটা ব্যাপার বলেও দাবি করে। দলটির শীর্ষ নেতা তারেক রহমান সহ নানা পর্যায়ের নেতারা এই হামলার ঘটনায় জড়িত থাকায় দল হিসেবে তাদেরকেও এর দায় নিতে হবে। এখানে অস্বীকারে পার পাওয়ার সুযোগ সামান্যই।
২১ আগস্টের খুনিদের প্রতি কোনরূপ অনুকম্পা নয়, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হলে মানবিকতার জয় হবে। এই শাস্তি আগামীর সকল অপরাধের পথ রুদ্ধ করবে। তা না হলে আমরা হেরে যাব, মানবিকতা হেরে যাবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)