চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

আকাশ থাকুক অক্ষত, পৃথিবী হোক মানুষ বসবাসের সমুন্নত

পরিবেশ বিপর্যয়ের ক্রান্তিলগ্নে বর্তমান পৃথিবীর অবস্থান। মনুষ্য সৃষ্ট প্রাকৃতিক অবক্ষয়ের খেসারতে আজ পৃথিবীর অস্তিত্বই হুমকির সম্মুখীন। বাংলাদেশে ব্যবহৃত ওজোনস্তর ক্ষতিকারক বস্তু সামগ্রীর মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে সিএফসি-১১, সিএফসি-১২, এইচসিএফসি-২২, মিথাইল ক্লোরোফর্ম এবং কার্বনটেট্রাক্লোরাইড। এই বৈজ্ঞানিক সংকেত গুলোর সাথে দেশের সাধারণ মানুষের পরিচয় খুব কম। আর তাই প্রতি বছর ওজোন স্তর রক্ষা দিবসে ওজোনস্তর ক্ষতিকারক বস্তু সামগ্রী সর্ম্পকে সর্বস্তরে গনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে।

‘মন্ট্রিল প্রটোকলে’ নির্দিষ্ট করা সময়ের মধ্যে এই সকল ধ্বংসাত্মক বস্তু সামগ্রী বর্জন প্রক্রিয়া সফল করার অঙ্গীকার প্রতিস্থাপন করাই আন্তর্জাতিক ওজোনস্তর রক্ষা দিবসের মূল উপাত্ত। একটি কথা অনস্বীকার্য যে, পরিবেশ অবক্ষয় ও ব্যাপক দূষণের ফলে বিশ্ব আজ ভীষণভাবে বিপর্যস্ত। গ্রীণ হাউজ গ্যাসের প্রভাব, আবহাওয়া পরিবর্তন, ভূ-মন্ডলীয় তাপ বৃদ্ধি, সমুদ্রপুষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ওজোনস্তর ক্ষয়, মরুময়তাসহ বিবিধ কারণে পৃথিবীর পরিবেশের ভারসাম্য মারাত্মকভাবে হুমকির সম্মুখীন।

প্রশ্ন হতে পারে, ওজোনস্তর আসলে কি? প্রকৃত অর্থে ‘ওজোনস্তর’ হচ্ছে বায়ুমন্ডলের উচ্চস্তরে অবস্থিত ‘ওজোন’ নামক বিষাক্ত গ্যাসের একটি পাতলা আবরণ যা পৃথিবীর সমগ্র প্রাণি জগৎ কে ধ্বংসের হাত থেকে প্রতি নিয়ত রক্ষা করছে। ওজোনস্তর সূর্য থেকে আগত ক্ষতিকারক আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি কে শোষণ করে এবং ক্ষতিকারক রশ্মি থেকে উদ্ভিদ ও প্রাণীজগৎ অর্থাৎ হিউম্যান হেলথ ইকোসিস্টেম নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। একই সাথে ওজনস্তর বায়ুমন্ডলের আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণগুলোর সাথে সংশ্লিষ্টতা বজায় রাখে।

কিন্তু নানাবিধ রাসায়নিক ক্রিয়া কলাপে ওজোন স্তর বর্তমানে ভীষণ ভাবে বিপর্যস্ত। এই অপূরণীয় ক্রমান্বয়িক ক্ষতির কবল থেকে অবিলম্বে ওজোন স্তরকে রক্ষার উদ্যোগ নেয়া না হলে, অদূর ভবিষ্যতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে নিদারুণ করুণ পরিনতি। যার ফলশ্রোতে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কাও করছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা।

ওজোনস্তরকে রক্ষার জন্য বিশ্বব্যাপী আজ যার পর নাই তৎপরতার দৃষ্টান্ত পরিলক্ষিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই বিষয়টি নিয়ে উদ্যোগ শুরু হয় আশির দশকের শেষের দিকে। এসময় যুক্তরাষ্ট্র এবং সুইডেন এরোসলপ্রোতে সিএফসি (ক্লোরোফ্লোরোকার্বণ) গ্যাসের ব্যবহার বর্জনের মাধ্যমে প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করে। প্রায় একই সাথে জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (টঘঊচ) উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রথমে ওজোন স্তরকে রক্ষার উদেশ্যে অনুষ্ঠিত হয় ভিয়েনা কনভেনশন ১৯৮৫ সালে এবং পরে ১৯৮৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বরে স্বাক্ষরিত হয় মন্ট্রিল প্রটোকল চুক্তি।

১৯৯৪ সালে মন্ট্রিল প্রটোকল স্বাক্ষরের দিন স্মরণে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৬ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক ওজোন দিবস ঘোষণা করে ( সিদ্ধান্ত ৪৯/১১৪,১৯ ডিসেম্বর/৯৪)। অধিবেশনে ওজোনস্তর রক্ষার্থে মন্ট্রিল প্রটোকলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুসারে কর্মে নিয়োজিত হতে রাষ্ট্র সমূহকে আহ্বান জানানো হয়।

প্রতি বছর আন্তর্জাতিক ওজোন স্তর রক্ষা দিবসের জন্য একটি নির্দিষ্ট প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়, যার আলোকে ‘ওজোন দিবস’ পালনের গুরুত্ব ফলপ্রসু হয়। মন্ট্রিল প্রটোকল চুক্তিতে ওজোন ক্ষয়কারী বস্তুসমূহ অর্থাৎ ওডিএস এর উৎপাদন ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। বিভিন্ন প্রকার ওডিএস এর পর্যায়ক্রমিক হ্রাসের সুনিদিষ্ট সময় এ চুক্তির অ্যার্টিক্যাল-২ এ নিরূপণ করা হয়েছে।

এই সকল সময়সূচী লন্ডন (১৯৯০), কোপেন হোগেন (১৯৯৯) এবং ভিয়েনায় সম্পাদিত চুক্তির মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়। ওজোনস্তর ক্ষয়জনিত সমস্যা সৃষ্টিতে মুলত শিল্পোন্নত দেশ সমূহ-ই বেশি জড়িত বলে ধারণা করা হয়। ফলে এ সকল দেশেই ওজোনস্তর ক্ষয়কারী বস্তু সামগ্রীর উৎপাদন ও ব্যবহার হ্রাস করার লক্ষ্যে সর্বপ্রথম ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, এ মর্মে সম্মত সুপারিশ রয়েছে।

উক্ত সুপারিশ অনুযায়ী মূল প্রটোকল সনাক্তকৃত ওডিএস বস্তুসমূহের বেশিরভাগ উন্নত দেশগুলোতে ১৯৯৫ সালের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে পর্যায়ক্রমিক হ্রাসের সময় নির্ধারণ করা হয়েছিলো। অবশিষ্ট গুলোর মধ্যে মিথাইল ব্রোমাইড এবং এইচসিএপসি ২০৩০ এর মধ্যে পর্যায়ক্রমিক হ্রাসের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। একই ভাবে সিএফসি হ্যালন ও কার্বনটেট্রাক্লোরাইড, মিথাইল ক্লোরোফর্ম ২০১৫ এর মধ্যে সম্পূর্ণরূপে পর্যায়ক্রমিক হ্রাসের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ১৯৯০ সালের ২ আগষ্ট ওজোন ক্ষয়কারী বস্তু সমূহের মন্ট্রিল প্রটোকল স্বাক্ষর করে এবং ১৯৯৪ সালের ১৮ মার্চ প্রটোকলের লন্ডন সংশোধনী অনুমোদন করে। মন্ট্রিল প্রটোকল এবং এর প্রতিশ্রতি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ওজোন ক্ষয়কারী বস্তুসমুহের পর্যায়ক্রমিক হ্রাস কল্পে বাংলাদেশ সরকার দেশে ওডিএস এর ব্যবহারের উপর ১৯৯৩ থেকে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ জরিপ পরিচালনা করে।

এই প্রাথমিক পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে ১৯৯৪ সালে একটি কান্ট্রি প্রোগ্রাম প্রস্তুত করা হয়। ওডিএস এর পর্যায়ক্রমিক হ্রাস করণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের প্রতিশ্রতি যথাসময়ে বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরে ওজোন সেল গঠন করা হয়েছে।

সম্প্রতি জাতিসংঘের জলবায়ূ গবেষণা প্যানেল আইপিসিসি বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবী এখন পরিবেশ বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে। এ বিপর্যয় থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি এ পদক্ষেপ কার্যকর করতে রাজনীতিক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে গণসচেতনতা সৃষ্টি আবশ্যক।

জাতিসংঘের উদ্যোগে স্পেনের ভেলেনসিয়া নগরে ইন্টারগর্ভনমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জর (আইপিসিসি) এক সম্মেলন শেষে বিশ্বের জলবায়ু সংক্রান্ত খসড়া প্রতিবেদন প্রকাশের প্রাক্কালে গত বছরের ১৭ নভেম্বর এ কথা বলা হয়।

ওই সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী হোয়াইট হাউজের পরিবেশ উপদেষ্টা আবহাওয়াবিদ জিম কনাফটন অবশ্য বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আবহাওয়া বা পরিবেশ বিপর্যয়ের বৈজ্ঞানিক সংঙ্গাটি এখনো পরিস্কার নয়।

তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের কারণে বিশ্বব্যাপী যে পরিবেশ দূষণ বাড়ছে তা কমানোর জন্য এখনই সঠিক পদক্ষেপ নেয়া দরকার। স্পেনে এ প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিক ভাবে  উম্মোচন করেন জাতিসংঘের মহা সচিব বান কি মুন।

আইপিসিসির ওই খসড়া প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ২১২১ সালের মধ্যে অঞ্চল ভেদে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বর্তমানের চেয়ে ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৬ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়ার আশংঙ্কা রয়েছে। তখন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১৮ থেকে ৫৯ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এ অবস্থার সৃষ্টি হলে পৃথিবীর অনেক উপকূলীয় দেশের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখিন হয়ে পড়বে।

চলতি শতাব্দির মাঝামাঝি ও শেষ দিকে যে আবহাওয়া বিপর্যয় ঘটবে তাতে এশিয়ার উপকূলীয় গরিব দেশের মানুষই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পরিবেশ বিষয়ক কর্মশালার ষ্ট্যাভরস ডিমাস এই প্রতিবেদন কে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, এটি একটি যুগান্তকারী প্রতিবেদন। যা বিশ্ব দুর্যোগ মোকাবিলায় দারুন ভুমিকা রাখতে পারবে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে সংগতি রেখে বাংলাদেশও প্রতিবছর আন্তর্জাতিক ওজোন স্তর রক্ষা দিবস পালন করে আসছে। আজকের দিনে আমাদের অঙ্গীকার হতে হবে, আকাশ থাকুক অক্ষত, পৃথিবী হোক মানুষ বসবাসের সমুন্নত।