চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

আওয়ামী লীগ একটি অনুভূতির নাম

এক.
আজকাল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক ও ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে যান। কয়েক দিন আগে অস্ট্রেলিয়ার কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী ও টেকনিক্যাল এক্সপার্টদের সাথে আমার সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল। তাঁদের মধ্য থেকে একজন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন- তোমাদের দেশের মানুষ এত অদ্ভুত কেন?
এ রকম কথা দিয়ে যাঁরা কথা বলা শুরু করেন, তাঁরা সাধারণত বাংলাদেশ সম্পর্কে ভয়ংকর নেতিবাচক কথাবার্তা বলেন। কারো মুখেই আমার দেশ কিংবা দেশের মানুষ সম্পর্কে খারাপ কথা শুনতে ভালো লাগে না; বিদেশিদের মুখে তো অবশ্যই না। সম্ভব হলে এ ধরনের লোকদের এড়িয়ে চলি। কিন্তু এখান থেকে তো চলে যাওয়া সম্ভব না। তাই তাঁর প্রশ্নটির কোনো উত্তর না দিয়ে বরং তাঁকেই প্রশ্ন করলাম- তুমি কী বলতে চাও?
তোমাদের কিছু মন্ত্রী আছেন দেবতার মতো সৎ, আবার কিছু মন্ত্রী আছেন ভীষণ অসৎ।

কী উত্তর দেব বুঝতে পারলাম না; কথা তো খুব মিথ্যা না। আবার আমি যা ভেবেছিলাম, লোকটি সে রকমও না। এ ধরনের লোকেরা এক লাইন বেশি স্মার্ট; এরা শুরুতে একটু ভালো কথা বলে তারপর ‘না’ ‘কিন্তু’ ‘যদি’ ‘তবে’ এর অবতারণা করে; শেষ পর্যন্ত নেতিবাচকতার এনসাইক্লোপিডিয়া খুলে বসেন। তাই একটু ডিপ্লোম্যাটিক্যালি একই সাথে উত্তর দিলাম এবং প্রশ্ন করলাম- এ রকম তো সব দেশেই আছে, তোমাদের দেশে কি নেই?

তা হয়তো আছে, তবে বাংলাদেশের সাথে আমাদের বিজনেস প্রায় চার দশকের…অনেক রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে…আমার বাবা শুরু করেছিলেন; এখন আমি সব দেখাশোনা করি।

বোঝার চেষ্টা করছি, আলোচনা কোন দিকে টার্ন করে? কোনোভাবেই বাংলাদেশের বদনাম করতে দেয়া যাবে না, তাই ইতিবাচক দিকে আলোচনা পরিচালিত করার জন্য জিজ্ঞেস করলাম- আচ্ছা, ‘দেবতার মতো সৎ’ বলতে তুমি কী বোঝাতে চাও?
মানে…অবিশ্বাস্য রকম সৎ; যা দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা কিংবা দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে খুব বিরল।
তাই নাকি? দু-একটা উদাহরণ দাও তো দেখি।
অবশ্যই দেব। তোমাদের একজন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ছিলেন। আমি ঠিকভাবে তাঁর নাম উচ্চারণ করতে পারি না। ভুল হলে আমাকে ক্ষমা কোরো-সাইয়দ এশরাফুল ইজলাম। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম?
হ্যাঁ, হ্যাঁ। তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশে এ রকম সৎ রাজনীতিবিদ থাকতে পারেন, এটা আমার ধারণার মধ্যে ছিল না। তাই নাকি? হু। তৃতীয় বিশ্বের সব দেশেই ফাইল আটকে রেখে ঘুষ নেয়াটা একটা স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার। এরা টাকাও খায়, সময়ও নষ্ট করে। ডিজগাস্টিং। মন্ত্রী-আমলারা মুখে সারাক্ষণ দেশপ্রেমের কথা বলেন। কিন্তু কাজের সময় দেশের ভালোমন্দ নিয়ে একটুও চিন্তা করেন না। শুধু কে কত পারসেন্ট কমিশন পাবেন, সেটাই তাঁদের দেনদরবারের ইস্যু। কিন্তু ওই ভদ্রলোকের কাজকর্ম দেখে আমার ধারণাই বদলে গিয়েছে।

তিনি কী করেছেন?
তিনি প্রতিটি ফাইল খুব ভালোভাবে পড়ে ঠিকই আমাদের ফাঁকিগুলো ধরে ফেলেছেন। মাত্র এক দিনের মধ্যে মন্তব্যসহ ফাইল ফেরত পাঠিয়েছেন।
তারপর?
আমি তো অবাক। বাংলাদেশে আমি নতুন না। কত মন্ত্রীর সাথে কত রকম ডিল করেছি। সিঙ্গাপু্‌র, দুবাইতে গিয়ে সব ঠিক। এ লোক আবার ক্যামন? সচিবের সাথে কথা বলে ঘুষের ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলাম।  হঠাৎ করে সচিব সাহেব দপ করে উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন- আপনি কি আমার চাকরিটা খেতে চান? এক্ষুনি আমার অফিস থেকে বের হন।
কেন?
মন্ত্রী সাহেব সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে, বুঝে কথা বলবেন।
ভুল স্বীকার করে দ্রুত ক্ষমা চাইলাম।
আচ্ছা শুনুন, আপনার ফাইলগুলো রিভাইজ করতে হবে। স্যার যা যা সংযোজন-বিয়োজন করতে বলেছেন, তা করে আবার জমা দিন।
আচ্ছা।
সব ফাইল রিভাইজ করতে কয়েক দিন লেগে গেল। তারপর জমা দিলাম।
তারপর?


পরদিন ঘুম ভাঙল আমার বিজনেস পার্টনারের মোবাইল কলের শব্দে। জানতে পারলাম, ফাইল এক্সেপ্টেড। এ রকম একটি কাজ মাত্র এক দিনের মধ্যে বহু উন্নত দেশেও হয় না। ভেবেছি, তৃতীয় বিশ্বে কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা বই লিখব, তাতে তোমাদের ওই রাজনীতিবিদের কথা আমি অবশ্যই শ্রদ্ধার সাথে উল্লেখ করব।

আমি তাঁর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। বুঝতে পারছিলাম না, ঠিক কীভাবে বলা যায়, ‘তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে’। সাথে সাথে এটাও মনে মনে ভাবলাম, আমাদের দেশে যদি এরকম দশজন মন্ত্রী পাওয়া যেত!

দুই.
প্রায় সব জাতির ইতিহাসেই দেখা যায়, তাদের মধ্যে কোনো কোনো মহামানবের, সূর্যসন্তানের জন্ম হয়; যারা কেউ তার জাতিকে মুক্ত করে, কেউ তার জাতিকে রক্ষা করে, আবার কেউ কেউ তাঁর জাতিকে গৌরবান্বিত করে। বাঙালি জাতির ইতিহাসে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা। একটি স্বাধীন দেশ, যা এনে দিয়েছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের সেই অগ্নিঝরা দিনে বঙ্গবন্ধুর চারজন অকুতোভয় বীর সেনানী ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান। এই চারজন জাতীয় নেতার যুগান্তকারী ঐতিহাসিক ভূমিকা ছাড়া আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে পারতাম কি না আমার জানা নেই।

একইভাবে উল্লেখ করতে হয়, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার এবং জাতীয় চার নেতাকে কারাভ্যন্তরে হত্যা করার পর যখন বাংলাদেশের মাটিতে কেউ আওয়ামী লীগের নাম উচ্চারণ করতে সাহস পায়নি, তখন আওয়ামী লীগের নেতারা অনেকেই কারাবন্দি, অনেকে পলাতক এবং কেউ কেউ দলছুট। সেই ভয়াল দিনে ১৯৭৭ সালের ৩ ও ৪ এপ্রিল ঢাকার হোটেল ইডেনে আওয়ামী লীগের দুদিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অধিবেশনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন বেগম মনসুর আলী।  কাউন্সিল অধিবেশনে পরবর্তী সম্মেলন না হওয়া পর্যন্ত সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে অন্তর্বর্তীকালীন আহবায়ক নির্বাচিত করা হয়। মাত্র ১১ দিনের মধ্যে (১৫ এপ্রিল, ১৯৭৭) তিনি ৪৪ সদস্য বিশিষ্ট আহবায়ক কমিটির নাম ঘোষণা করেন। এই মহীয়সী নারী আওয়ামী লীগকে পুনরায় সংগঠিত করার কাজে অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিলেন।

তারপর অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়েছে, পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় অনেক জল গড়িয়েছে; কিন্তু আওয়ামী লীগকে শেষ করে দেয়ার জন্য ষড়যন্ত্রের অবসান হয়নি। ১/১১-এর সময়ে শেখ হাসিনাকে ‘মাইনাস’ করার পরিকল্পনা নিয়ে বন্দি করা হলো। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকেও গ্রেপ্তার করা হলো। দেশের তথাকথিত সিভিল সোসাইটি ইভিল সোসাইটির ভূমিকায় ব্যস্ত। আওয়ামী লীগের কিছু বড় বড় ডাকসাইটে ‘সংস্কারপন্থী’ নেতারা সেই মাইনাস পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ষড়যন্ত্রে যোগ দিলেন। কিন্তু সেই দুঃসময়ে দলের জন্য, দেশের জন্য এবং শেখ হাসিনাকে মুক্ত করার জন্য প্রয়োজন ছিল কমপক্ষে দুজন বিশ্বস্ত ও সাহসী নেতার। শেখ হাসিনার তথা আওয়ামী লীগের সেই বিশ্বাসের মর্যাদা দিলেন জিল্লুর রহমান ও সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, ১/১১ সংকট থেকে আওয়ামী লীগ মুক্তি পেয়েছিল দুই ভাবে (১) সংগঠনকে চাঙ্গা করার মাধ্যমে (২) কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে।  তৎকালীন সময়ে পশ্চিমা কূটনীতিকদের সাথে যোগাযোগের নর্ম, ম্যানার, দক্ষতা এবং বিশ্বস্ততার দিক থেকে সৈয়দ আশরাফের বিকল্প কেউ ছিলেন না। তারপর বাকিটা ইতিহাস। লক্ষ্য করুন, ১৯৭৭ সালে এগিয়ে এসেছিলেন তাজউদ্দীনের স্ত্রী, ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর স্ত্রী, ২০০৮ সালে এগিয়ে এলেন সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে। শেখ হাসিনা যেমন তাঁর সাহসী, মেধাবী ও প্রজ্ঞাবান নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্ববাসীর কাছে গৌরবান্বিত করছেন, অন্যদিকে জোহরা তাজউদ্দীন, জিল্লুর রহমান ও সৈয়দ আশরাফুল ইসলামরা দেশ, জাতি ও দলকে রক্ষা করেছেন। সকলের মূলমন্ত্র একটাই, আওয়ামী লীগ হেরে গেলে বাংলাদেশ হেরে যাবে। তাই দেশের ক্রান্তিকালে কান্ডারির ভূমিকা পালন করেছেন।

তিন.
২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন হলো। কত নেতার কত রকম দৌড়-ঝাঁপ! নানা রকম কায়দা-কৌশলে বিভিন্ন মিডিয়ায় সৈয়দ আশরাফকে দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অযোগ্য প্রমাণিত করার জন্য প্রচারণা চালানো হলো। কিন্তু যাঁকে সরানোর জন্য এত কিছু, সেই মানুষটি নির্বিকার।  বরাবরের মতোই নির্বিকার। কাউকে কিছু বলেননি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কাউন্সিল অধিবেশনে বক্তৃতার জন্য যখন তাঁর নাম ঘোষিত হলো, মিতভাষী এই জ্ঞানতাপস, মুক্তিযোদ্ধা এবং আধুনিক বাংলাদেশের রাজনীতির ঋষিপুরুষ ধীরস্থির পায়ে মাইকের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর পক্ষে-বিপক্ষের লাখো জনতা পিনপতন নীরবতায় অপেক্ষমাণ। সবার চোখেমুখে একটাই প্রশ্ন-তিনি কী বলবেন? তিনি অত্যন্ত আবেগ জড়ানো কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি অনুভূতির নাম’।

এমন গভীরতর মর্মস্পর্শী শব্দাবলি বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কোনো নেতার মুখে বাঙালি জাতি কখনো শোনেনি।  সেই কাউন্সিল অধিবেশনের ফলাফল আমরা সবাই জানি। দুদিন পর অভিমানে অথবা স্ত্রী-কন্যার কাছে যাওয়ার জন্য লন্ডনের উদ্দেশে তিনি এয়ারপোর্টে, তাঁকে বিদায় জানাতে গিয়েছিলেন কবি ও রাজনীতিবিদ মাহবুবুল হক শাকিল। আজ তাঁরা দুজনই আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু এয়ারপোর্টের করিডোরে তোলা সেই ছবিটি এখনো চোখে ভাসে আর মনে মনে বলি, ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী…নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান…’

পরিশেষে শুধু বলব, বিরল হলেও বাংলাদেশে এখনো এমন রাজনীতিবিদ আছেন, যিনি কেবিনেট মিনিস্টার হওয়া সত্ত্বেও স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য বাড়ি বিক্রি করে টাকা জোগাড় করেন। যাঁর গ্রামের বাড়িতে এখনো ভাঙা টিনের ঘর। যিনি ইংল্যান্ডের রাজনীতি ছেড়ে মা-মাটির প্রয়োজনে বাংলাদেশে সাদামাটা জীবন যাপন করেন। যিনি দৃঢ় বিশ্বাসে বলতে পারেন, ‘বাংলাদেশের প্রতিটি বাড়িই আমার ঠিকানা’।

পুনশ্চঃ এমন মহাত্মার অধিকারী অগণিত মানুষের মেধায়-শ্রমে-প্রজ্ঞায় আওয়ামী লীগের জন্ম; আর তাই এখনও আওয়ামী লীগ একটি অনুভূতিরই নাম।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)