মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, সিপিবি, বাসদসহ নানা বাম প্রগতিশীল সংগঠন ক্রিয়াশীল রয়েছে। বামদের মধ্যে কিছু দল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪দলীয় জোটের অন্তর্ভূক্ত হিসেবে সরকারের শরীক হয়েছে। আর কিছু বাম বিকল্প ও সব সাপের একই বিষ বলে তফাতে রয়েছে।
তফাতে থাকলেও স্বাধীনতা বিরোধী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান দৃশ্যমান রয়েছে। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গড়া দলটি এখন তারই কন্যার নেতৃত্বে রাষ্ট্রক্ষমতায়। আওয়ামী লীগ দলটির শুরু হতেই ভেতর বিরোধ শুরু। যখন আওয়ামী মুসলিম লীগ ছিল তখন আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িকতা ও মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িকতার মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের অস্তিত্ব ছিল।
কিন্তু দুপক্ষই আবার পরিস্থিতিগত বাস্তবতায় একই দলের পতাকাতলে রাজনীতি করে যাচ্ছিল। কিন্তু পরস্পর বিরোধী ভাবনার এই মৈত্রী দীর্ঘস্থায়ী হলো না। সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ধ্যানধারণার প্রভাবদায়ী ভূমিকায় একসময় এই মৈত্রী ভেঙ্গে গেল। দলের নামকরন হতে মুসলিম শব্দটা বাদ গেল।
পাকিস্তানের বর্বর জুলুম শাহীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াই হতে সশস্ত্র লড়াই পর্যন্ত এই আওয়ামী লীগ নামক দলটিই নেতৃত্ব প্রদান করেছে। শুরু হলো ১৯৭১ সালের সশস্ত্র স্বাধীনতার লড়াই। এই লড়াইয়ের ভেতরই শুরু হল আবার ভেতর বিরোধ।
গঠিত হল মুজিব বাহিনী। কিন্তু কেন এই আলাদা বাহিনী। আওয়ামী লীগের পুরো দলীয় নেতৃত্ব ও স্বাধীনতার সংগ্রামইতো পরিচালিত হচ্ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে। তবে কেন এই অখন্ড বিশ্বাসের জায়গাকে ক্ষুন্ন করে মুজিব বাহিনী গঠন করা হল। যারা মুজিব বাহিনীর সদস্য ছিল না তবে তারা কার বাহিনী ছিল। মুজিব বাহিনীর নেতা ছিলেন সিরাজুল আলম খান দাদা ভাই, আসম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ, হাসানুল হক ইনু গং। কিন্তু পরবর্তীতে তারা কোথায় গেলেন। একটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের যেখানে দেশগঠনে প্রয়োজন ছিল ঐক্যমত।
সেটি না করে মুজিব বাহিনীর নেতারা আওয়ামী লীগ হতে বেরিয়ে গিয়ে জাসদ নামের একটি আলাদা দল গঠন করল। গঠন করল গণবাহিনী। আবার প্রকাশ্য হল আওয়ামী লীগের ভেতর বিরোধের আলাদা মুখোমুখি অবস্থান। সারা দেশের আওয়ামী লীগের অনেক বড় বড় নেতা যোগ দেয়া শুরু করল জাসদে। এক সময়ের মুজিব বাহিনীর লোকেরাই হয়ে উঠল মুজিবের প্রতিপক্ষ।
দেশ পুনর্গঠনের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুকে মোকাবেলা করতে হল জাসদকে। কিন্তু কেন এই জাসদের সৃষ্টি। এর নেপথ্যে কোন শক্তির ইন্ধন ছিল? এটা প্রজন্মের কাছে পরিস্কার করা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের ভেতর বিরোধের এখানেই শেষ নয়। চলমান থাকলো আরও একটি ধারা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মন্ত্রিসভার যেসব মন্ত্রী তোয়াজ তোষামোদে সবার থেকে এগিয়ে তারাই ভেতরে ভেতরে মুজিবের প্রাণহরনকারী দুশমনীতে লিপ্ত থাকলো।
তৎপর হয়ে উঠল দেশী বিদেশী চক্রান্তকারীরা। শুনেছি এমনই একসময়ে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র কর্মকর্তা কাও পান বিক্রেতার বেশে ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে বলেছিল, আপনাকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। জিয়াউর রহমানের বাসায় কর্নেল ফারুক, মেজর ডালিম, কর্নেল রশিদ চক্র বৈঠকে মিলিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বললেন, আপনি পান বিক্রেতা নন, আপনাকে আমি চিনি। এরা আমাকে হত্যা করবে কেন। এরা আমার সন্তানের মত। কিন্তু বাস্তবে কী দাঁড়ালো। বঙ্গবন্ধুর এই ধারনা ও বিশ্বাস মিথ্যা বলে প্রমাণিত হল। মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস ছিল এই বাঙালী ও তার দলের কেউ তাকে হত্যা করতে পারে না।
১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন। বঙ্গবন্ধুর ক্ষমতায় থাকাকালীন ভেতর বিরোধ পুনরায় দৃশ্যমান হলো নতুন মাত্রায়। বঙ্গবন্ধুর লাশ সিঁড়িতে রেখেই খন্দকার মোশতাকের নতুন মন্ত্রিসভায় আব্দুল মমিন, তাহের উদ্দীন ঠাকুর ও দেওয়ান ফরিদ গাজী গং মন্ত্রীত্বের শপথ নিল। ভীত সন্ত্রস্থ আর্মিরা বঙ্গবন্ধুর লাশ নিয়ে টুঙ্গীপাড়ায় গেল। তাদের ভয় ছিল, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও জনগণ তাদের আক্রমণ করতে পারে।
লাশ ছিনিয়ে নিতে পারে। জানা যায় বঙ্গবন্ধুর দাফন ও জানাজা নিয়ে প্রথম চিন্তা করেন মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ। তিনি বঙ্গভবনে বন্দি অবস্থায় ছিলেন। তিনি খন্দকার মোশতাককে বঙ্গবন্ধুর দাফন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, রাস্তাঘাটে তো কত মানুষ মারা যায়। তাদের সবার দিকে কি আমার খেয়াল রাখতে হবে।
‘গ্রেভ হিম এনি হোয়ার বাট নট ইন ঢাকা।’ (সূত্র-বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড প্রসঙ্গ/কেএম শফিউল্লাহ/) জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর লাশ টুঙ্গিপাড়ায় এলে কফিন খোলা নিয়ে ফ্যাসাদ দেখা দেয়। এমন ভাবে কফিনটা লাগানো হয়েছিল যে সেটা খুলতে মিস্ত্রী পর্যন্ত আনতে হয়েছিল। এত ঝামেলায় না গিয়ে সেনারা কফিনসহ কবর দিতে চাইলে তাড়াতাড়ি মিস্ত্রী ডেকে কফিন খোলা হয়। এরপর হালিম মৌলবীকে ডেকে বলা হয়, তাড়াতাড়ি কবর দেয়ার জন্য। কিন্তু তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু একজন মুসলমান উনাকে গোসল করাতে হবে, কাফন পরাতে হবে ও জানাজাও পরাতে হবে। আর যদি আপনারা বলেন যে বঙ্গবন্ধু শহীদ হয়েছে তাহলে এসবের দরকার নেই। তখন মাত্র ২০ মিনিট সময় দেয়া হয় গোসল, কাফন ও জানাজার জন্য।
শেখ সাহেরা খাতুন রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালের রিলিফের জন্য রাখা শাড়ি দিয়ে কাফন বানানো হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর আর গোসল করানো হয়েছিল ৫৭০ কাপড় কাচা সাবান দিয়ে। আনুমানিক ৩০/৩৫ জন লোক উপস্থিত ছিল বঙ্গবন্ধুর জানাজায়। বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের মধ্য হতে একজন মানুষও কি তখন একটি নতুন কাপড় ও একটি গায়ে মাখার সাবানও নিয়ে আসতে পারলো না? আর্মিরা সন্ত্রস্থ ছিল কখন জনতা ধাওয়া করে তাদের। বঙ্গবন্ধুর লাশ টুঙ্গীপাড়ায় নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বে থাকা কর্নেল কাজী হায়দার আলীর বক্তব্য ছিল, হেলিকপ্টারের মধ্যে কারও মুখে কোন কথা নেই সবাই হয়তো আমার মতই ভাবছিল এই কঠিন দায়িত্বে আল্লাহ কেন আমাদের সোপর্দ করলেন।
দায়িত্ব পালন করে নিজেরা ফিরতে পারব কি? তার সঙ্গে মাত্র ১৪ জন সঙ্গী ছিল। কিন্তু না কোথাও কোন বিক্ষোভ, প্রতিবাদ হল না। তারা বঙ্গবন্ধুকে কবর দিয়ে নিরাপদে ফিরে গেল। আজকে যারা এক মুজিব লোকান্তরে লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে/বলে গলা ফাটান সেদিন কোথায় ছিলেন তারা। জামাত নেতা কুখ্যাত রাজাকারের ফাঁসি কার্যকর হলে জামাতীরা দেশব্যাপী গায়েবানা জানাজা পড়ে। আর জাতির পিতার মৃত্যুতে কিছুই হয় না এটা সারা জাতির কলঙ্ক নয় কি?
আওয়ামী লীগের ভেতর বিরোধের এই চরম পরিণতির পরেও আজও তা থেমে নেই। ভেতর বিরোধ নিয়ে সবাই আওয়ামী লীগ করে যাচ্ছে। সভানেত্রীর নিষেধ অমান্য করে দেশের বিভিন্ন জায়গাতে বিএনপি জামাতের লোকদের আওয়ামী লীগে যোগদান করিয়েছে নিজ নিজ গ্রুপকে শক্তিশালী করতে। ভেতর বিরোধ নিয়েই তারা দল করে থাকে। বিরোধের জেরে বামদলগুলোর মত ব্র্যাকেট লাগিয়ে এখানে আলাদা দল করার হিড়িক নেই। বামদের মধ্যে ভেতর বিরোধ সৃষ্টি হলেই তারা পৃথক দল গঠন করে ফেলে।
যেমন কমিউনিষ্ট পার্টির বিভাজন হতে শুরু করে ছাত্র ইউনিয়নের দুই ভাগ হয়ে যাওয়া। এক অংশে রাশেদ খান মেনন ও অন্য অংশে মতিয়া চৌধুরী। ২০০৪ সালে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের সাথে মতবিরোধে সাইফুল হকের নেতৃত্বাধীন একটি গ্রুপ বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি নাম দিয়ে নতুন দল গঠন করে ফেলল। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিতে আবার সাইফুল হকের সাথে ভেতর বিরোধ হওয়ায় আবার কয়েকজন বেরিয়ে গেল। হাসানুল হক ইনুর সাথে ভেতর বিরোধে আম্বিয়া-বাদল-প্রধান বেরিয়ে গিয়ে নতুন জাসদ গঠন করে ফেলল।
ভেতর বিরোধ সৃষ্টি হলে অন্যান্য বামদল গুলোও ভাঙ্গে। সিপিবি ও বাসদেরও ভাঙ্গনের নজীর রয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগে ভেতর বিরোধও থাকে একসাথে দল করাও থাকে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যারা গা ঢাকা দিয়েছিল কিংবা খুনী মোশতাকের সাথে লবিং করেছিল আজকে বঙ্গবন্ধুর সামান্য সমালোচনাতেই তারা তেড়ে আসবে সমালোচকের দিকে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক ভাবে বিএনপি-জামায়াত হেরে গেছে। এরা আর রাজপথ উত্তপ্ত করে গণআন্দোলন করার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারবে বলে মনে হয় না। এজন্যই আইনশৃংখলা, সরকার ও রাষ্ট্রের ব্যর্থতা প্রমাণের জন্য গুপ্ত হত্যা চালানো হচ্ছে।
এই সরকারের মিত্র রাষ্ট্র ভারতকে ক্ষেপিয়ে তুলতে নিরীহ হিন্দু দর্জি হতে শুরু করে পুরোহিতদের হত্যা করা হচ্ছে। জঙ্গি দমনের সাঁড়াশি অভিযানের পাশাপাশি যদি দলীয় ভেতর বিরোধের প্রতি দলীয় গঠনতান্ত্রিক চালানো না হয়। তাহলে অতীতের পুনরাবৃত্তি হওয়ার সম্ভাবনা অবান্তর কি? এটা প্রমাণিত যে দুঃসময়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা চুপসে যায়। আর সুসময়ে জেগে ওঠে। যেমন ওয়ান ইলেভেনে কিছু নেতার ভূমিকাও তার নজির। এখানে ভেতর বিরোধও থাকে আবার একসাথে দল করাও থাকে। এটা কিন্তু বিপজ্জনকই বটে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)