চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিপুল বিজয়! কিসের ইঙ্গিত?

মুজিবনগর, ঐতিহাসিক মুজিবনগর। এই নামটির সঙ্গে বাংলাদেশের আবেগ ভালোবাসা জড়িত। আওয়ামী লীগের অনুভূতির সাথে এই নামটি তো আষ্টেপৃষ্ঠেই বাঁধা। চলমান স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে মুজিবনগর উপজেলায় নৌকা মার্কার চরম বিপর্যয় ঘটেছে। বলা যায় বিদ্রোহী প্রার্থীর জনপ্রিয়তায় নৌকা বিতাড়িত হয়েছে। পুরো মেহেরপুর জেলায় মাত্র দুটো ইউনিয়নের বিজয় নিয়ে আওয়ামী লীগকে ঘরে ফিরতে হয়েছে। মুন্সীগঞ্জের এক ইউপিতে নৌকার প্রার্থী পেয়েছে মাত্র ১২১ ভোট!! সারা দেশে ২য় ধাপের নির্বাচনে ১৩১টি ইউনিয়ন পরিষদে নৌকা প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই আসতে পারেনি। চলতি ধাপে প্রায় চল্লিশ শতাংশ ইউনিয়ন পরিষদে নৌকা পরাভূত হয়েছে সমআদর্শের ত্যাগী প্রার্থীদের কাছে। সবচেয়ে বড় বিস্ময়, যারা জিতেছেন তারা কেউ বিএনপি জামাতের নন, এরা আওয়ামী লীগেরই বিদ্রোহী প্রার্থী!!

বিদ্রোহী দমনে আওয়ামী লীগের কোনো কৌশলই কাজে আসছে না। দলীয় সাধারণ সম্পাদক বার বার বলছেন, এবারের বিদ্রোহীরা চিরদিনের জন্য বহিস্কৃত হবেন। যদিও দলের নেতাকর্মীরা এটিকে কৌশলের ঘোষণা বলেই বিশ্বাস করেন। সময়ে বহিষ্কার, অসময়ে প্রত্যাহার; এসব দেখে বহিষ্কারের ঘোষণা এখন যেন আর কাউকেই বিচলিত করে না। বিদ্রোহীদের বিজয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দলীয় ঘোষণা বাস্তবায়ন করতে হলে, লোম পরিস্কার করতে গিয়ে কম্বলই না আবার খালি হয়ে যায়!! এমপি শামীম ওসমানের ভাষায়, গাছের পাতায় পাতায় এখন আওয়ামী লীগ! বার বার তিনি পঁচাত্তরকে স্মরণ করেন। সুবিধাবাদী হাইব্রিডদের নিয়ে তার শংকার যেন শেষ নেই। সারাদেশে সবাই যখন আওয়ামী লীগ, এমন পরিস্থিতিতে নৌকা প্রার্থীদের করুণ চিত্র কিসের ইঙ্গিত বহন করে?

ঐতিহ্যগতভাবে এক সময় আওয়ামী রাজনীতিতে সুবিধাবাদীদের প্রাধান্য ছিল না। বিএনপি, জাতীয় পার্টির মতো ক্ষমতাকে ব্যবহার করে সেনা ছাউনিতে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়নি। তাই দলটিতে দীর্ঘদিনের ত্যাগী পরীক্ষিত নেতাকর্মীর প্রাধান্য ছিল। কালের নিষ্ঠুর নিয়তিতে দলটি যেন ক্রমেই তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। দীর্ঘ দেড় যুগ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও দলটির নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মীরা যেন নিজ গৃহেই নির্বাসনে। ক্ষমতাশীন দলের নেতা কর্মী হয়েও অনেক স্থানেই ত্যাগীরা যেনো পরগাছা! স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের প্রচলন দীর্ঘদিনের ত্যাগীদের মনে আশার সঞ্চার করলেও, এটিই এখন তাদের গলার ফাঁস। বিকল্প কোনো পথ না থাকায়, এক কালের ত্যাগী নেতাকর্মীরা আজ স্বেচ্ছায় দল ঘোষিত ফাঁসির মঞ্চে যেতেও সংশয় করছে না। এটি কিসের লক্ষন; এর অন্তর্নিহিত কারণটা ই বা কি?

স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ক্রমেই সন্দেহ সংশয় বাড়ছে। তৃণমূল আওয়ামী লীগ যাকে জনপ্রিয় ভাবছে, চূড়ান্ত মনোনয়নে তার প্রতিফলন ঘটছে না। আওয়ামী লীগের ঘাঁটি বলে পরিচিত এক পৌরসভা নির্বাচনে জামানত হারানো নৌকার প্রার্থী যখন বলেন, ৯৯% নেতাকর্মী তার বিপক্ষে ছিল, তখন প্রশ্ন জাগে কোন যাদুবলে বঙ্গবন্ধুর নৌকা এমন প্রার্থীর হাতে তুলে দেয়া হলো? চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী বিদ্রোহীদের বিজয় এ প্রশ্নটিকে আরও জোরালো ভাবেই দেশবাসীর সামনে তুলে এনেছে!!

দীর্ঘদিনের ত্যাগ তিতিক্ষা স্বীকার করা আওয়ামী নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি তাদের সমর্থন ও আনুগত্যে কোন ফাঁক নেই। এরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আমলনামা দেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনাও বার বার বলেন, কোথায় কে কি করছে, সবই তিনি জানেন। আর এটি তো জানারই কথা। যদি তাই না হয়, তিনি একটি জাতীর কাণ্ডারী হতে পারতেন না। দলের সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় তিনি যেমন তথ্য পান, পাশাপাশি নানা রকম গোয়েন্দা প্রতিবেদনও তার সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহযোগিতা করে বলেই আমজনতা বিশ্বাস করে।

চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী বিদ্রোহীদের বিজয় প্রমাণ করে, দলটি অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক প্রার্থী নির্বাচনে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এর দায়ভার কার? সত্যিকার অর্থে কোন প্রক্রিয়ায় এসব নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন করা হয়েছে, জনগণ সেটি না জানলেও দলীয় নীতি নির্ধারকরা নিশ্চয়ই সেটি জানেন। বিদ্রোহীদের জয় জয়কার কে আমলে নিলে প্রশ্ন জাগে, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা কি কোন ভ্রান্ত তথ্যে বিভ্রান্ত হচ্ছেন? মাঠের চিত্রকে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তুলে ধরার জন্য যারা দায়িত্ব পালন করছেন, তারা কি তৃতীয় কোন পক্ষের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছেন? নাকি হাইব্রিডরাই এখন নীতি নির্ধারকদের বিশ্বস্ত হয়ে উঠছেন?

সারাজীবন বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে হৃদয়ে ধারণ করে নৌকার বিরুদ্ধে নির্বাচনী যুদ্ধ- এটি মোটেও কোনো সহজ কাজ নয়। তবুও এ যুদ্ধ চলছেই। কোনো হাইব্রিড সুবিধাবাদী নয়, আদর্শবান ত্যাগী নেতাকর্মীরা যখন এমন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, তখন এটি রাজনীতির মাঠে অশনি সংকেত বহন করে। উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা দলটির প্রাণশক্তি। শেখ হাসিনার মনোনীত প্রার্থী যখন তারই অনুসারী নেতাদের কাছে পরাজিত হন, তখন সেটি শুধু উদ্বেগের নয় আশংকারও বটে। এই শংকা আর উদ্বেগ নিরসনে, ফটোবাজ, সুবিধাবাদী আর হাইব্রিডদের সুপারিশ নয়; মাঠ জরিপের ভিত্তিতে তৃণমূলের সৎ, নিষ্ঠাবান আর ত্যাগীদের মূল্যায়নই সংকট নিরসনের উত্তম পাথেয়।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)