সাত দশকের আওয়ামী লীগ- ১৯৪৯-২০১৯। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দলটি গত ৪৮ বছরের মধ্যে ক্ষমতায় ছিল ২০ বছরেরও কম সময়। এর মধ্যে ২০০৯ এর জানুয়ারি থেকে একটানা প্রায় ১১ বছর ক্ষমতায়। দলের সভাপতি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী। ১৯৯৬ সালের মাঝামাঝি থেকে পরের পাঁচ বছরেও তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৭৫ সালেল ১৫ আগস্টের চরম বিপর্যয়ের ২১ বছর পর তিনি দলকে ক্ষমতায় নিয়ে আসার কৃতিত্ব দেখাতে পারেন। এ বছরের ডিসেম্বরেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন। নতুন বছর শুরু হতেই মার্চ মাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বর্ষ পূরণ হবে। তার পরের বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। ৭০ বছরের ঐতিহ্যবাহী দলটির জন্য এ দুটি বছর বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, সন্দেহ নেই।
এটাও মনে রাখতে হবে যে গত ১১ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। এক দশক আগেও দেশি-বিদেশি যে সকল অর্থনীতির পণ্ডিত-বোদ্ধা একান্ত আলোচনায় বলেছেন- ‘বাংলাদেশের পক্ষে ৭ শতাংশ বা তার বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন আকাশকুসুম কল্পনা বৈ কিছু নয়’- তারা এখন মত বদলেছেন। তারা বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ-এর অভিমতকে বেদবাক্য মনে করতেন এবং এখনও সম্ভবত করেন। এসব সংস্থাও বলছে- বাংলাদেশ জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে নিয়ে যেতে পেরেছে এবং এটা হঠাৎ আলোর ঝলকানি নয়, বরং টেকসই। সদা সন্দিগ্ধবাদী এ মহল এখন বলছে- উন্নয়ন টেকসই হবে তো? সুুশাসন আসবে তো।
আওয়ামী লীগের এবারের সম্মেলনে পটভূমিও মনে রাখা চাই। জাতীয় সম্মেলনের আগে দলের জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায়ে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনেরও সম্মেলন হচ্ছে। কিন্তু আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখতে পাই, দলের প্রাণ বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অনিয়ম-দুর্নীতির দায়ে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। যুবলীগ চেয়ারম্যান এবং স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতিও হঠাৎ করেই দায়িত্ব থেকে বিদায়। প্রবল পরাক্রমশালী, ধরাকে সরা জ্ঞান করে চলতে থাকা এসব নেতা নিজেদের দেখতে পান বয়া ছাড়া অথৈ সাগরে। এ যেন কূল নাই কিনার নাই… অবস্থা।
শুদ্ধি অভিযানের ধাক্কায় কুপোকাৎ যুবলীগের কিছু নেতা। নানা পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের আরও কিছু নেতার ভয়- বিপদ নেমে আসবে না তো! দলের সাধারণ সম্পাদক বছর খানেক ধরেই ‘হাইব্রিড’, ‘কাউয়া’- এসব শব্দ বলছিলেন। কিন্তু তাতে খুব একটা কর্ণপাত কেউ করছে বলে মনে হয় না। সেদিক বিবেচনায় ‘শুদ্ধি অভিযান’ অনেকের কাছে একেবারেই আকস্মিক। শেখ হাসিনা যা বলেন, তা আন্তরিকভাবেই বলেন এবং সেটা করেন- এ নিয়ে যাদের সংশয় ছিল, তারা নতুন করে ভাবতে বসতে পারেন। তবে কেউ কেউ ভাবেন, অন্যায়-অনিয়ম করেও তারা দিব্যি থেকে যাবেন।
শুদ্ধি অভিযানের পটভূমিতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা আরও কিছু বিষয় বিবেচনায় নিতে পারেন। ২০০৯ সালের জুন মাসে আওয়ামী লীগের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিভিন্ন জেলা-উপজেলার প্রায় তিন হাজার নেতা-কর্মীর সাক্ষাতকারের ভিত্তিতে একটি লেখা তৈরি করেছিলাম। তখন একটি অভিন্ন উদ্বেগ ছিল এভাবে- ‘সাত বছর পর ক্ষমতায় আসার পর দলের কার্যালয় নয়, বরং এলজিইডি, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, ওয়াসা-পিডিবিসহ বিভিন্ন সরকারি-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের অফিস হয়ে উঠেছে কাজের কেন্দ্র। কে কোন কাজের টেন্ডার পাবে- সেটা নিয়েই সর্বত্র আলোচনা।’ অথচ দলটি ওয়ান ইলেভেনের দুঃসময় অতিক্রম করেছিল প্রবল সাহসে।
এখন চিত্রটি কেমন? সম্রাট কীভাবে ‘শ্রেষ্ঠ কর্মী’ হয়? জিকে শামিম কীভাবে নিজেকে যুবলীগের গঠনতন্ত্রে না থাকা পদেও সম্পাদক ঘোষণা করে বছরের পর বছর সদর্পে চলতে পারে? এ সব উৎপাত নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের সম্মেলনে আলোচনা হতে পারে। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অভাবনীয়, সন্দেহ নেই। এ অর্জনের পেছনে ব্যবসায়ীদের অবদান প্রভূত। বেসরকারি খাত উন্নয়নের চাবিকাঠি। কিন্তু অর্থ-শিল্প-বাণিজ্য-খাদ্য-ভূমিসহ আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় বড় শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। এসব পদক্ষেপ ইতিবাচক-নেতিবাচক, কেমন ফল দিচ্ছে সেটা নিয়ে পর্যালোচনা হতেই পারে। আওয়ামী লীগ এবং তার সরকারের সামনে এখন কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। এক্ষেত্রে কৃষি ও কৃষককে বড় ধরনের আর্থিক প্রণোদনা দেওয়ার পাশাপাশি চাল-ডাল-মাছ-তেল-লবণের মতো পণ্যের বাজার সহনশীল মাত্রায় রাখার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে- এটা সত্য। কিন্তু কৃষক ফসলের ন্যায্য মূল্য পেল না, অথচ বাজারে কৃষি পণ্যের মূল্য আকাশছোঁয়াÑ-এটা কি গ্রহণযোগ্য?
শিক্ষার প্রসার ঘটেছে। পাঁচ কোটিরও বেশি ছাত্রছাত্রী। কিন্তু উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের চাকরির ব্যবস্থা কীভাবে হবে? মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ায় শ্রমের বাজার ঠিক থাকবে তো? রেমিট্যান্স প্রবাহ ধরে রাখা যাবে তো? প্রবাসে কাজের সুযোগ আকস্মিকভাবে কমে গেলে উপযুক্ত বিকল্প আছে কি?
সত্তরের বছরের পোড়খাওয়া রাজনৈতিক দলের জন্য এ সব বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা এবং তা থেকে উত্তরণের উপায় সময়ের দাবি। ধর্মান্ধতার হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার পথ অনুসন্ধানও গুরুত্বপূর্ণ। জঙ্গিবাদ দমনে সরকারের সাফল্য দেশ-বিদেশের সুধী মহলে প্রশংসিত। কিন্তু সমাজের ভেতরে যে অসহিষ্ণুতা বাসা বাঁধছে সেটা নিয়ে আওয়ামী লীগের র্যাঙ্কস কতটা ভাবে?
গুজব রটিয়ে লবণের বাজার অস্থিও করা যায়। আবার গুজব রটিয়ে হিন্দু-বৌদ্ধদের সর্বনাশও করা যায়। সুচতুরভাবে যারা বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারা থেকে সরিয়ে ফেলতে চাইছে, তাদের মুখে কিন্তু এ কথাও শোনা যায়- ‘বঙ্গবন্ধু ভাল ছিলেন, স্বাধীনচেতা ছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিচ্ছেন।’ অথচ এরাই এক সময়ে বলতো- ‘ভারতের সঙ্গে ২৫ বছরের গোলামি চুক্তি মানি না’। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে বিপুল সমুদ্র এলাকার ওপর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা কিংবা ভারতের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধীর ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত স্থল সীমান্ত চুক্তি
বাস্তবায়নের মাধ্যমে কয়েক হাজার একর জমি উদ্ধার জমি তাদের আলোচনায় নেই। আওয়ামী লীগের আলোচনাতেই কি বিষয়টি আছে? সম্প্রতি এ দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা হাসতে হাসতে বলেছেন, কেন্দ্র থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে দলের কয়েক হাজার নেতা-কর্মী এখন ‘ভাল আছে’। দল বা অঙ্গ সংগঠনের কমিটি হলে পদ-পদবী পেতে তারা তৎপর। কিন্তু তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বলে না। জানেও না।
কেবল দলের পদ নয়, জাতীয় সংসদ বা স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের মেয়র-কাউন্সিলর-চেয়ারম্যান-সদস্য পদ পেতেও তারা ব্যাকুল। এখন জাতীয় সংসদ, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ- সর্বত্র আওয়ামী লীগের জয়জয়কার। পাকিস্তান আমলে বা জিয়াউর রহমান-এইচ এম এরশাদের নিষ্ঠুর সামরিক শাসনের আমলে সেনাছাউনির প্রেরণায় গঠিত ভূঁইফোর দলও এমন সাফল্য দেখাতে পারেনি। এটা বিশাল শক্তি, সন্দেহ নেই। প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে মিলে এই শক্তি ১৯ নভেম্বর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ‘লবণ-চক্রান্ত’ ব্যর্থ করে দিতে পেরেছে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে এই শক্তির অমিত সম্ভাবনা আরও ভালভাবে কাজে লাগানোর বিষয়ে চুলচেড়া আলোচনা হতেই পারে। এই শক্তির শক্তির অপচয় হচ্ছে কী-না, অপব্যবহার হচ্ছে কী-না, কেউ ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থে এ ক্ষমতার কাজে লাগায় কী-না, সেটাও পর্যালোচনার দাবি রাখে।
জাতীয় সম্মেলনে কিন্তু এমন প্রশস্তি গাওয়া লোকের অভাব হবে না, যারা বলে উঠবেন- ‘আমরা কেবল নেত্রীর কথা শুনতে চাই। অন্য কোনো নেতা-কর্মী একটি কথাও বলবে না।’ এসব বক্তব্যের আড়ালে কিন্তু একটিই মতলব- যারা শুদ্ধি অভিযানের আওতায় আসার শঙ্কায়, তারা চাইছেন কর্মীরা যা জানে সেটা যেন প্রকাশ না পায়। কমিটি গঠন নিয়ে একটি ঘটনা বলি। ছাত্রলীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার জেলা সফরের অভিজ্ঞতা নিুরূপ। তারা জেলায় গেছেন, বড় সমাবেশে বক্তব্য রেখেছেন। কিন্তু বেশিরভাগ বক্তা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা। তাদের বক্তব্যে ছাত্রছাত্রীদের প্রসঙ্গ নেই। শিক্ষার কথা নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কীভাবে আরও বেশি করে বঙ্গবন্ধুর দর্শন, শেখ হাসিনার উন্নত বাংলাদেশ গঠনের পরিকল্পনা ছড়িয়ে দেওয়া যায়- সেসব নেই। কমিটি গঠনের প্রশ্ন এলে বলা হয়- এসব নিয়ে তোমাদের ভাবার দরকার নেই। ‘বড় ভাই’ সব ঠিক দেবেন।
ছাত্রলীগ এ অবস্থা থেকে কবে বের হতে পারবে, তার হদিস ওই সব ছাত্রনেতা দিতে পারেননি। অন্য কেউ পারবে কী? আওয়ামী লীগের জেলা-উপজেলা কমিটি গঠনের চিত্রও ভিন্ন কিছু নয় কিন্তু। ‘ত্যাগী এবং রাজপথের সাহসী’ নেতা-কর্মীদের মূল্যায়নের দাবি সর্বত্র ধ্বনিত হয়। কিন্তু ৭০ বছরের অভিজ্ঞ দলটির সামনে এখন এক সময়ে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে উপহাস করা দেশটিকে উন্নত বিশ্বের সাড়িতে নিয়ে যাওয়ার যে চ্যালেঞ্জ, তাতে জয়ী হতে হলে চাই যে আরও বেশি কিছু। আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে এর নির্দেশনা মিলবে, এটাই প্রত্যাশা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)