জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের ‘প্রথম রাষ্ট্রপতি’ দাবি করে বিতর্কিত বক্তব্য দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সুবিদ আলী ভূইয়া। বর্তমান সংসদে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি সাবেক এ সামরিক কর্মকর্তা বুধবার সংসদ ভবনে সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটি নিয়ে আলোচনার সময় তিনি ওই বক্তব্য দেন বলে কমিটির একাধিক সদস্য সংবাদ মাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এক প্রকাশনায় জিয়াকে ‘প্রথম রাষ্ট্রপতি’ লেখা হলে তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা প্রসংগে কমিটির বৈঠকে আলোচনার সূত্রপাত হয়। এক পর্যায়ে সুবিদ আলী বলে ওঠেন, জিয়াই বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। এটা তিনি তার বইতে লিখেছেন বলেও উল্লেখ করেন। এ বক্তব্যের পর আওয়ামী লীগের অন্য সদস্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন বলেও খবরে প্রকাশ পায়।
সুবিদ আলীর এমন বক্তব্যের পর কমিটির অন্য সদস্যদের সঙ্গে তার উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। তখন কমিটির সভাপতি শওকত আলীর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। সমালোচনার মুখেও সুবিদ আলী তার অবস্থানে অনড় ছিলেন বলেও খবরে বলা হয়েছে। কমিটির সভাপতি শওকত আলী সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, সুবিদ আলী ভূইয়ার সঙ্গে অন্য সদস্যদের যে বিতর্ক হয়েছে, সেটা আলোচ্যসূচির মধ্যে ছিল না। তাই বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে এ আলোচনা বাদ দেওয়া হবে।
সুবিদ আলি ভূইয়ার বক্তব্যে আওয়ামী লীগের কোন কোন সাংসদ, নেতা কর্মী বা জনগণ অবাক হলেও যারা তার সম্পর্কে কিছুটা হলেও জ্ঞাত, তাদের অবাক হওয়ার কোন কারণ কি আছে?
তিনি আসলে কে?
১৯৯৫ এর ডিসেম্বরে পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ায় বিমান থেকে নিক্ষেপ করা অস্ত্র ও গোলাবারুদের আলোচিত ঘটনায় প্রথম তার নাম আসে সংবাদ মাধ্যমে। বুলগেরিয়ার সাপ্লায়ার থেকে আসা এ অস্ত্র চালানের সাথে পাওয়া ইউজার সার্টিফিকেটে সই ছিলো বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের তৎকালীন প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) আজকের আওয়ামী লীগের এই এমপি সুবিদ আলি ভূইয়ার। তার দেয়া সার্টিফিকেটে বলা হয়েছিলো, এই অস্ত্র বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ব্যবহার করবে এবং তৃতীয় কোন দেশে রপ্তানী করা হবে না। এ নিয়ে ভারতের সংবাদ মাধ্যমেও তখন অনেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে প্রবীণ নেতা আব্দুস সামাদ আজাদ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পুরুলিয়ার অস্ত্র কেলেংকারি ঘটনায় সুবিদ আলী ভূইয়ার সংশ্লিষ্টটতা বিষয়ে তদন্ত ও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে সিবিআই’র তদন্ত দল ঢাকায় আসার অনুমতি চায় ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। দেশের ভাবমূর্তির কথা বিবেচনা করে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সুবিদ আলী ভূইয়াকে ভারতীয় গোয়েন্দাদের মুখামুখি করতে রাজী হননি মন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবরে এমনটি বলা হয়েছিলো তখন।
আরেকটু পেছনে যাওয়া যেতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে সুবিদ আলী ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালে ক্যাপ্টেন হিসেবে চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি হন, যে রেজিমেন্টে জিয়াউর রহমানও ছিলেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে জিয়ার অধীনেই যুদ্ধ করেছিলেন তিনি। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তাকে প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেন এবং বিএনপির পুরো মেয়াদে তিনি এ দায়িত্বে ছিলেন। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে জিয়ার বিশ্বস্ত ছিলেন বলেই বিএনপির সকল যুগে বাহিনীতে সুবিধা ভোগ করেছেন।
তর্কের খাতিরে বলা যেতে পারে জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার সাথে কাজ করেছেন চাকরির সুবাদে। এমন অনেকেই আছেন, এ আর নতুন কি? কিন্তু, তিনি যে মনে প্রাণে জিয়াউর রহমান বা খালেদা জিয়ার অনুসারী তার আরো প্রমাণ হচ্ছে, চাকরী জীবনের পর তিনি রাজনীতিতিতে আসার আগ্রহ প্রকাশ করে ২০০১ সালে বিএনপির মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কুমিল্লা-দাউদকান্দি আসনটি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের জন্য আজীবন বরাদ্দ বলে শিকে ছিঁড়েনি। স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করে খন্দকার মোশাররফের কাছে হেরে খালেদার চক্ষুশূল হন তিনি। তা না হলে কি আওয়ামী লীগের দরোজায় পা বাড়ানোর কোন কারণ ছিলো?
১৯৯৬ এ সরকার গঠনের জন্য একজন সদস্যের অভাবে এরশাদের গৃহপালিত বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে খ্যাতি পাওয়া আ স ম আব্দুর রবের সমর্থন আওয়ামী লীগের প্রয়োজন হয়। সে শিক্ষা থেকে একটি সংসদীয় আসনকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার সিঁড়ি ভেবেছিলো বলেই কি জেনেশুনে বিষ পান করেছিলো? ২০০৮ এ আওয়ামী লীগের জোয়ারের মধ্যে দলের যে কাউকে মনোনয়ন দিলে এ আসন কি পাওয়া যেতো না সারা দেশের মতো? এ প্রশ্ন তখনো দলের অনেকেই করেছিলেন বলে আলোচনা আছে।
পুরুলিয়ার ঘটনা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সুবিদ আলি ভূইয়ার একটি শক্ত রাজনৈতিক অবস্থান প্রয়োজন ছিলো এক সময়। বিশেষ করে সংসদ সদস্য হওয়া যাতে করে ভারতের সিবিআই এর মুখামুখি তার হতে না হয় মামলা চলাকালীন সময়ে। চাকরি জীবন শেষে তাই তার একমাত্র লক্ষ্য হয়ে যায় রাজনীতি। এক্ষেত্রে বিএনপির মনোনয়ন না পেয়ে আওয়ামী লীগের আশ্রয় তার জন্য শাপেবর হয়েছে বলে সামরিক বাহিনিতে তার সাবেক সহকর্মীদের মধ্যে আলোচনা আছে।
সংসদীয় গণতন্ত্রে একটি আসন অর্জনকারী থানা পর্যায়ের নেতাও দলের কাছে অনেক গুরুত্ব বহন করেন, যা বার বার হেরে যাওয়া প্রেসিডিয়াম সদস্যের চেয়েও অনেক বেশী। সরকার গঠনে ৯৬ সালে যে কারণে আমির হোসেন আমুর মতো প্রভাবশালী নেতার চেয়েও কুমিল্লা’র আব্দুল মতিন খসরু গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। তাই বলে কি এমন চরিত্র ও আদর্শহীন কাউকে মনোনয়ন দিতে হবে শুধু একটি আসনের জন্য?
গণ সংগঠনে কিছু ছিদ্র থাকে যা ভেজাল অনুপ্রবেশের পথ। তা না হলে ২০১৬ তে এসে যখন অন্য দলের লোক ভেড়ানোর কোন প্রয়োজন নেই তখন আওয়ামী লীগের নৌকা কেন বোঝাই হবে বিএনপি-জামায়াতের ধান্দাবাজ লোকজনের ভারে। আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা কি জানেন না এদের নৌকায় পা রাখার উদ্দেশ্য কী? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সম্প্রতি বলেছেন, ছাত্রলীগে যেমন শিবিরের অনুপ্রবেশ হয়েছে তেমনি আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনে জামায়াত-বিএনপি ঢুকেছে। এদের শনাক্ত করা উচিৎ।
অনুপ্রবেশের পর শনাক্ত করার মতো কঠিন কাজের দায়িত্ব কেনো নিতে চান সৈয়দ আশরাফ তা কারো বোধগম্য নয়। অনুপ্রবেশের ছিদ্র বন্ধ করে দিলেইতো হয়। অন্যথায় জিয়াপুত্র তারেক রহমানের পাশাপাশি তার বাবাকে প্রথম রাষ্ট্রপতি দাবিদার সুবিদ আলীর মত আরো অনেক জিয়াপুত্র দুধ কলায় বেড়ে উঠবে আওয়ামী লীগের আঙ্গিনায় যার প্রমাণ সুবিদ আলী দিয়েছেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)