নানা জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনতে যাচ্ছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা ও অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান।
রোববার সকাল ১০টায় রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে গিয়ে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করবেন তারা।
গণমাধ্যমে এ সংবাদ প্রচারের পর থেকেই বিভিন্ন মহলে উঠেছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। কেউ কেউ এটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও একটি বড় অংশ হয়ে উঠেছে সমালোচনামুখর।
বিষয়টির নানা ইতিবাচক দিক তুলে ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন আমিনুল ইসলাম।
মাশরাফী ও সাকিবের নির্বাচনে অংশ নেয়ার পেছনের কারণ হিসেবে তিনি এ দুই জনপ্রিয় খেলোয়াড়, দেশ কিংবা সমাজকে কিছু দিতে চাইছে অথবা নিজ এলাকাকে আরও সমৃদ্ধ করতে চাইছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
একইভাবে এ দু’জনকে যারা সমালেচনা করে ‘আই হেট পলিটিক্স’ বলে ফ্যাশন দেখায় বা দেখাচ্ছেন তারা নিজেরাও জানে না- তারা কতোটা হিপক্রেট! বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আমিনুল ইসলামের ফেসবুক স্ট্যাটাসটি তুলে ধরা হলো:
বাংলাদেশের সকল টেলিভিশনে এই মুহূর্তে ব্রেকিং নিউজ হচ্ছে- মাশরাফী এবং সাকিব আওয়ামী লীগের ফরম কিনবেন কাল।
এই নিয়ে ফেইসবুক জুড়ে দেখছি নানান আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। সমালোচনাই অবশ্য বেশি হচ্ছে।
সব গেল গেল ব্যাপার!
ছেলেটা আমার আমার এখানে অর্থাৎ বিদেশের ইউনিভার্সিটিতে পড়তে এসছে বছর দুয়েক আগে। বাংলাদেশে থেকে এসছে। বয়েস ২০-২২ হবে।
গীটার-টিটার বাজাতে পারে। আমি ভাবলাম বেশ সংস্কৃতি মনা হবে।
একদিন সব বাংলাদেশি ছাত্র মিলে আমার বাসায় এসছে। আমরা নানান বিষয় নিয়ে আলাপ করছি। এর মাঝে হঠাৎ করে “প্রভাত ফেরি” নিয়ে আলোচনা শুরু হলো, এই আলোচনা চলা অবস্থায় এই ছেলে বলে বসেছে
-১৬ই ডিসেম্বর প্রভাত ফেরি হয়, তাই না?
আমার তো চোখ কপালে উঠার যোগাড়! এই ছেলে জানেই না ‘প্রভাত ফেরি’ শব্দটা কোন দিবসের সঙ্গে সম্পৃক্ত!
‘প্রভাত ফেরির’ এবং ২১ ফেব্রুয়ারির যে একটা আলাদা ইতিহাস আছে, সে তার ২০-২২ বছরের জীবনে সেটা জানতে এবং বুঝতে পারেনি।
না সে তার পরিবারের কাছ থেকে এই নিয়ে কিছু জেনেছে বা শুনেছে; না সে কোন বই পড়েছে কিংবা পত্রিকা!
অথচ এই ছেলে কিন্তু আমাদের চোখে শিক্ষিত হিসেবেই ধরা দিবে। কারণ সে বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছে।
সেবার আমি নিউজিল্যান্ডে যাবো কনফারেন্সে। এই ছেলের সঙ্গে কথা হচ্ছে, আমি তাকে জানালাম
-আমি নিউজিল্যান্ডে যাচ্ছি।
এই ছেলে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে
-নিউজিল্যান্ড তো ইউরোপে’ই, তাই না?
আমার চোখ আবার কপালে যোগাড়!
একটা দেশ কোন মহাদেশে অবস্থিত, সেটা জানতেই হবে এমন কোন কথা নেই। আমরা অনেকেই হয়ত সেটা জানি না। কিন্তু তাই বলে নিউজিল্যান্ড?
যেই দেশের সঙ্গে আমরা প্রতিনিয়তই ক্রিকেট খেলে বেড়াই, এমনকি একবার বাংলা-ওয়াশও দিয়েছি, সেই দেশ কোথায়, এটা বোধকরি ক্লাস ফাইভের বাচ্চারও জানার কথা। অথচ এই ছেলে জানে না!
আমার এই লেখা অতি অবশ্যই এই ছেলেকে ছোট করার জন্য নয়। বরং পুরো ব্যাপারটা বুঝানোর জন্য এই ঘটনা গুলোর অবতারনা।
তো এই ছেলে কেন নিউজিল্যান্ড কোথায় জানে না?
কারণ হচ্ছে সে জীবনে সেই অর্থে খেলাধুলার খোঁজ খবরই রাখেনি। ক্রিকেট খেলা সে হয়ত দেখেও না। পত্রিকাও সে পড়ে না! সুতরাং তার কাছে তো নিউজিল্যান্ড অপরিচিত দেশই মনে হবে।
বলছিলাম এই একই ছেলে গীটার বাজায়। এর মানে এই না- তার মন মানসিকতা সংস্কৃতি কেন্দ্রিক!
সে যে খুব ভালো গীটার বাজাতে পারে তাও না। হয়ত যারা মিউজিক বুঝে না, তাদের কাছে ঠিক আছে; কিন্তু আমি যেহেতু মিউজিকের কিছু হলেও জানি, তাই আমার পক্ষে খুব সহজেই বুঝা সম্ভব- স্রেফ ফ্যাশন কিংবা লোক দেখানর জন্য আমরা যেমন অনেকেই গীটার শিখতে চাই বা বাজাতে চাই; তার অবস্থাও আসলে তেমন’ই!
এটাও আসলে খারাপের কিছু না। যার যা ইচ্ছে।
এখন এই ছেলেই ধরুন আমি দেশ কিংবা রাজনীতি নিয়ে যদি কোন একটা লেখা লিখি, সে হয়ত পড়বেই না কিংবা পড়লেও ওই পোস্টে’র ধারে কাছেও থাকবে না।
লাইক দেয়া তো দূরে থাক, পড়েই হয়ত অন্য দিকে মনোযোগ দিবে কিংবা ভাববে-এই সব কি লিখে; ক্ষেত টাইপ!
বিশ্বাস করুন, এদের অবস্থা এমনই!
এরাই হচ্ছে- ‘আই হেট পলিটিক্স’ প্রজন্ম!
কিছু না জেনে, না পড়ে, না বুঝে’ই এরা অনেক কিছু হয়ে যেতে চায়, হাতে পেতে চায়!
এরা দেশে থাকতেও দেশের রাজনীতিকে ঘৃণা করত।
আর বিদেশে এসে বলে বেড়াবে- ‘দেশের সব কিছু শেষ। দুর্নীতি দেশের সব জায়গায়। রাজনীতিবিদরা দেশ’টা শেষ করে দিল। দেশে আর থাকতে পারলাম না। ওই দেশে মানুষ থাকে!’
সেই সঙ্গে যুক্ত হবে- দেশে খাবারে ভেজাল, ট্র্যাফিক জ্যাম, ডাক্তাররা ভালো না, ঘুষ ইত্যাদি ইত্যাদি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- আপনি এই সব জিনিস সব ঠিক-ঠাক মতো চাইবেন, আশা করবেন দেশে সব কিছু ভালো মতো চলুক, আবার একই সঙ্গে- ‘আই হেট পলিটিক্স’ বলবেন সেটা তো হয় না।
তো রাজনীতিবিদরা ছাড়া অন্য আর কারও পক্ষে কি এই সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব?
অতি অবশ্যই আমাদের রাজনীতির একটা বিশাল অংশই অপরাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
কিন্তু সেই অবস্থার তো পরিবর্তন করতে হবে।
আকাশ থেকে কোন এলিয়েন নেমে এসে তো আমাদের সমস্যার সমাধান করে দিবে না। বিদেশ থেকে কোন সাদা চামড়ার মানুষ গিয়েও আমাদের সমৃদ্ধ করবে না।
আমাদেরকেই আমাদের কাজটা করতে হবে।
আর আমাদের রাজনীতির বর্তমান যেই চিত্র; সেখানে দুই বড় দলের মাঝেই সব কিছু ঘুরপাক খায়।
আপনি এর মাঝে বিপ্লব করে ফেলতে চাইলেই তো আর সেটা পারবেন না।
বরং বর্তমান সিস্টেমের মাঝে থেকে’ই নিজেদের সমস্যার সমাধান করতে হবে।
আপনি আপনার এলাকায় খেলার মাঠ চাইবেন, পার্ক চাইবেন, ভেজাল মুক্ত খাবার চাইবেন, ঘুষ-দুর্নীতি মুক্ত সমাজ চাইবেন; আবার রাজনীতি ঘৃণা করবেন!
এটা যে এক ধরনের হিপক্রেসি সেটা কি বুঝতে পারেন?
মাশরাফী এবং সাকিব তাদের এই এতটুকু জীবনে প্রায় সব কিছুই পেয়ে গিয়েছেন।
দেশ-বিদেশের মানুষজন তাদের চেনে-জানে। মানুষ তাদের ভালোবাসে। এই দুই জনের কারোই টাকা-পয়সার অভাব নেই। বিশেষ করে সাকিব তো বাংলাদেশে সবচাইতে ধনী মানুষদের কাতারেই পড়ে।
স্ট্যাটাস, পাওয়ার কিংবা অর্থ উপার্জনের জন্য ওদের রাজনীতিতে আসার আলাদা করে মোটেই দরকার নেই।
এরা দুইজনেই তাদের খেলোয়াড়ি জীবনের প্রায় শেষ দিকে। সাকিব হয়ত আরও তিন-চার বছর খেলতে পারবে। মাশরাফী হয়ত এই বিশ্বকাপের পরেই অবসর নিবে।
সুতরাং, তারা হয়ত এখন তাদের দেশ কিংবা সমাজকে কিছু দিতে চাইছে অথবা নিজ এলাকাকে আরও সমৃদ্ধ করতে চাইছে।
রাজনীতি না করেও হয়ত নিজ সমাজের জন্য কিছু করা সম্ভব। কিন্তু সেটার পরিধি বেশ কম। এছাড়া আমাদের রাজনীতির চরিত্রটাও তো বদল করতে হবে।
অন্য কেউ এসে তো সেটা করে দিবে না। আমাদেরকেই সেটা করতে হবে।
খুব ধীরে হলেও আস্তে আস্তে সেটা শুরু হচ্ছে। আমাদের তো উচিত এই দুইজনকে বরং স্বাগত জানানো।
আর যারা- ‘আই হেট পলিটিক্স’ বলে ফ্যাশন দেখায়; এরা নিজেরাও জানে না- তারা কতোটা হিপক্রেট!