বিশ্বজুড়ে হামলা চালানোসহ নানা কর্মকাণ্ডের জন্য আলোচিত জঙ্গি গোষ্ঠী আল-কায়েদার জঙ্গি জগতে ছিল একক আধিপত্য। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরবিচ্ছিন্ন ড্রোন হামলায় পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতা নিহত ও নৃসংশ আরেক জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের আর্বিভাবের পর অনেকটাই ঢাকা পড়েছে আল-কায়েদার নাম। সেই ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে সিরিয়ায় আইএসকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মহাপরিকল্পনা করছে আল-কায়েদা।
আমেরিকা ও ইউরোপের সিনিয়র গোয়েন্দাদের বরাত দিয়ে আল-কায়েদার নতুন এই পরিকল্পনার খবর দিয়েছে মার্কিন দৈনিক ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’।
পশ্চিমা কর্মকর্তারা বলছেন, আল-কায়েদার শীর্ষ নেতাদের কাছে সিরিয়ার গুরুত্ব এভাবে প্রতিফলিত হওয়া সম্ভবত ইসলামিক স্টেট সঙ্গে আল-কায়েদার রক্তাক্ত দ্বন্দ্বে তীব্রতা বৃদ্ধির পূর্বাভাস।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, আল-কায়েদা এরই মধ্যে সিরিয়ায় একটি বিকল্প সদরদফতর প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেছে এবং সেখানে গ্রাউন্ডে কাজ করবে আল-কায়েদার সিরিয়ান সহযোগীরা। আর এই কাজটি সম্ভবত করবে আল-নূসরা ফ্রন্ট; ২০১৩ সালে ঝড়ের মতো যাদের আর্বিভাব।
আল-কায়েদার এই পরিকল্পনা যদি সত্যি হয়, তাহলে একটি স্বাধীন সার্বভৗম ইসলামিক খেলাফত নির্মাণের আল-কায়েদার যে স্বপ্ন সেটা পূরণের গুরুত্বপূর্ণ উপায় অবলম্বন এটি।
পশ্চিমা গোয়েন্দারা বলছেন, এই ধরনের একটি পরিকল্পনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের জন্য সন্ত্রাসবাদী চরম হুমকি হতে পারে।
আমেরিকান গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, আল-কায়েদার সক্রিয় সদস্যদের বছর কয়েক আগে থেকেই সিরিয়ার সরানোর কাজ শুরু হয়েছে। সংগঠনের প্রধান আইমান আল-জাওয়াহিরি এই কাজে নূসরা ফ্রন্টের সদস্যদের কাছে ২০১৩ সালেই পাঠানোর কথা বলেন। এর এক বছর পর পশ্চিমা বিভিন্ন স্বার্থে আঘাত করতে পাকিস্তান থেকে ‘খোরাসান’ নামে একটি সেল সিরিয়ায় পাঠান জাওয়াহিরি।
কিন্তু সিরিয়ায় একটি স্থায়ী উপস্থিতি প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেদের অমূল্য গ্রুপ হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে। পশ্চিমা গবেষকরা বলছেন, সিরিয়া ভিত্তিক কায়েদা শুধুমাত্র ইউরোপের কাছাকাছি রাষ্ট্রের আকর্ষণীয় দূরত্বের মধ্যে হবে না বরং তারা ইরাক, তুরস্ক, জর্ডান ও লেবানন থেকে যোদ্ধাদের রিক্রুটিং ও লজিস্টিক সমর্থন থেকে উপকৃত হতে পারে।
কয়েক মাস আগেই এক অডিও বার্তায় আল-কায়েদা নেতাদের নূসরা সদস্যদের সাথে কাজ করা আহ্বান জানান জাওয়াহিরি। তবে সেমসয় নূসরার কয়েকজন নেতা এই ধরনের পদক্ষেপের বিরোধীতা করেন। সে কারণে আল-কায়েদা তাদের কাজটা পুরোপুরি শুরু করেনি। তবে এ নিয়ে কাজ চলছে বলে বেশ কয়েক নূসরা নেতা ইউরোপ ও আমেরিকান গোয়েন্দার কাছে সাক্ষাৎকারে বলেছেন।
মিডেলইস্ট ইন্সটিটিউটের সিনিয়র ফেলো চার্লিস লিস্টার ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে বলেছেন, আল-কায়েদা এমিরেটস ও নবগঠিত আল-কায়েদা সেন্ট্রাল লিডারশিপের এই সংযোগ এবং সিরিয়ায় তাদের উপস্থিতি জিহাদীদের বৈশ্বিক ব্র্যান্ডিংয়ে আরো আত্মবিশ্বাস বাড়াবে।
তিনি আরো বলেন, আল-কায়েদার স্মার্ট, সুশৃঙ্খল এবং ক্রমাগত জিহাদি আন্দোলনের বিপরীতে আইএসকে আরো কৌশলী দৈনন্দিন সুন্নি মুসলমানদের সাথে প্রান্তিককৃত গ্রহণ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
আল-কায়েদা এবং আইএসের উদ্দেশ্য একই; ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু তাদের কৌশল ভিন্ন। এক্ষেত্রে আইএস নৃশংস কর্মকাণ্ডের মধ্যদিয়ে এটি করতে চায়। যেমনটা ইরাক ও সিরিয়ায় করেছে।
আমেরিকান কর্মকর্তারা বলছেন, আইএস মূলত তার ভয়াবহতা এবং মিডিয়া-কাণ্ডজ্ঞানে প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে বিশ্বব্যাপী জিহাদি শ্রেণীবিন্যাসে আল কায়েদাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পানি। তবে ২০১৪ সালে ড্রোন হামলায় মুহসিন আল-ফাদলিসহ খোরাসন সেলে অনেক সদস্য নিহত হয়েছে।
আমেরিকান গোয়েন্দাদের হিসাব মতে, আইএসের যোদ্ধা সংখ্যা ১৯ হাজার থেকে ২৫ হাজার। যারা ইরাক ও সিরিয়া ভাগ হয়ে কাজ করছে। আর নূসরা ফ্রন্টের যোদ্ধা সংখ্যা ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার হবে এবং তারা সবাই সিরিয়ায় যুদ্ধ করছে। নূসরা আমিরশাহী সমস্ত বিশ্বের মুসলমানদের জন্য একটি সরকার বলে দাবি করে না।
তবে আমেরিকা ও ইউরোপে গোয়েন্দারা বলছেন, নূসরা ফ্রন্টের যোদ্ধা সংখ্যা কম হলেও তারা খুবই প্রতিজ্ঞাবন্ধ এবং তাদের এটাই কাজে লাগাতে চায় আল-কায়েদা।
এই ধরনের একটি পরিকল্পনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের জন্য সন্ত্রাসবাদী চরম হুমকি হতে পারে। সিআইএর ডিরেক্টর জন ও ব্রেসনান বলেন, আল-কায়েদাকে এখনো নির্মূল করা যায়নি। তাই এর উপর আমাদের নজর রাখতে হবে।
২০১১ সালে পাকিস্তান অভিযানে আল-কায়েদার শীর্ষ নেতা ওসামা বিন লাদেন নিহত হলেও আরেক নেতা সাইফ আল-আদল কোথায় আছেন সেটা এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি মার্কিন কিংবা ইউরোপের গোয়েন্দারা।
তবে সাম্পতি খবর বের হয়, কয়েকজন ইরানি কূটনীতিকের মুক্তির বদলায় আদলসহ আরো আল-কায়েদার ইয়েমেন শাখার চার শীর্ষ নেতাকে মুক্তি দিয়েছে ইরান। এই আদল মিশরীয় সেনাবাহিনীর কর্নেল ছিলেন। মার্কিনদের ওয়ান্টেট তালিকায়ও তার নাম রয়েছে। তার মাথার জন্য ৫ মিলিয়ন ডলার ঘোষণা করা হয়।
সন্ত্রাসবাদ গবেষক মাইকেল এস স্মিথ বলেন, আদল সিরিয়ার কাছাকাছি কোথাও রয়েছেন। সিরিয়ায় কৌশলগত প্রশিক্ষণ নিতে তাকে কাজে লাগাতে পারে আল-কায়েদা। এমনটি হলে সংগঠনের আত্মবিশ্বাস আরো বেড়ে যাবে।
গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, মুক্তি পাওয়া অন্যদের মধ্যে আবদুল খায়ের আল-মিসরি- আল-কায়েদার বৈদেশিক সম্পর্ক কাউন্সিলের সদস্য, জর্ডানের নাগরিক আবুল কাসেম, আবু মুসাব জাওয়াহিরি, সারি সিহাব, আবু মোহাম্মদ আল-মিসরি এদের সবাইকে সিরিয়ায় শিফট করার পরিকল্পনা করছে আল-কায়েদা। আর তাতে এদের সবারই সায় রয়েছে।
তবে গোয়েন্দারা এটাও বলছেন, কবে এবং কখন সিরিয়ায় আল-কায়েদা খেলাফত প্রতিষ্ঠিত করতে যাচ্ছে সেটা এখনো পরিস্কার নয়। তাদের ধারণা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে এক করতে অতি গোপনীয়ভাবে কাজ সারছে সংগঠনটি।
গোয়েন্দারা এটাও বলছেন যে, নূসরা ফ্রন্টের কিছু নেতা আল-কায়েদার পক্ষে সায় দিলেও তাদের অনেকেই বাসার সরকারকে উৎখাত করতে আইএস প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদীর পক্ষে যুদ্ধ করেছেন এবং করছে। এই দুই গ্রুপের যোগসাজশে আরো বেশি রক্তপাত হয়েছে সিরিয়ায়।
তবে আল-কায়েদার পাকিস্তানের ঘাটি কিছুটা নড়বড়ে হওয়ায় সিরিয়ায় চোখ দিয়েছে। তারা যদি নূসরা ফ্রন্টকে আয়ত্বে আনতে পারে এবং সেখানে যুদ্ধরত আরো অনেক সংগঠন রয়েছে তাদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে তাহলে শক্ত অবস্থানে চলে যাবে।
সিরিয়ায় নূসরা ফ্রন্ট ছাড়াও অনেক ছোট ছোট দল আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। আল-কায়েদা প্রবেশ করলে সেখানে আরো প্রতিদ্বন্দ্বি বাড়বে আসাদের। তবে সংগঠনের শক্তি প্রদর্শনের কারণে আইএসের সঙ্গে আল-কায়েদার সংঘাতে রক্তারক্তির পরিমাণ আরো বাড়বে।