ঢাকা মহানগর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ২০২০ অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো। নির্বাচনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে আতিকুল ইসলাম আতিককে বেসরকারিভাবে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন বলছে, এ নির্বাচনে ৩০ শতাংশের নীচে ভোট পড়েছে।
এদিকে, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ এনে ঢাকায় সকাল সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে বিএনপি। সন্ধ্যায় নয়া পল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপি মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম এ হরতালের ঘোষণা দেন। সেপ্রেক্ষিতে হরতালে যান চলাচলের ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান রাঙ্গা। তিনি বিএনপির এ সিদ্ধান্তকে হঠকারি বলে মন্তব্য করেছেন। একইসাথে কোন রকমের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে এর দায় বিএনপির উপর বর্তাবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।
এতো গেলো রাজনৈতিক নির্বাচনী উপাখ্যান। এবার আসি মূল আলোচনায়। আমার ভোটার নাম্বার ছিলো ৩২৩, কেন্দ্র ছিলো স্কলার কিন্ডার গার্ডেন স্কুল, শেওড়াপাড়া, মিরপুর, ঢাকা। ইভিএমে দেয়া এটিই আমার প্রথম ভোটদান। ভোট দিতে গিয়ে দেখলাম, কেন্দ্রের মোড়েই স্লিপ দিচ্ছেন কর্মীরা। যদিও মোবাইলে এসএমএসের আগেই এটি সংগ্রহ করা সম্ভব।
কেন্দ্রে পৌঁছে দেখলাম বুড়ো আঙ্গলের ছাপ দেয়ার সাথে সাথেই মেশিনে ভোটার আইডি কার্ডে দেয়া ছবি ভেসে উঠলো। ভোটার নিশ্চিত হওয়ার পর পোলিং এজেন্টরা আঙ্গুলে কালি দিয়ে দিলেন। পরে পাঠিয়ে দিলেন পর্দা ঘেরা একটি রুমে যেখানে তিনটি মেশিন বসানো ছিলো। যার একটি মেয়র, একটি কাউন্সিলর এবং একটি সংরক্ষিত আসনের প্রার্থীদের মার্কা ও নাম দেয়া ছিলো। প্রত্যেকটি আলাদা করে পছন্দের মার্কায় ভোট দিয়ে, সবুজ বাতিতে চাপ দিয়ে ভোটদান শেষ করেছিলাম। সবশেষে তিনটি মেশিনেই আমার কাঙ্খিত মার্কা ভেসে উঠলে আমি কক্ষ থেকে বের হয়ে আসি। খুবই দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমার ভোটদান সম্পন্ন হওয়ায় একজন ভোটার হিসেবে আমি আনন্দিত।
আমার সামনেই আরেক ভোটারকে দেখলাম, ভোটার ক্রমিক নং না নিয়েই কেন্দ্রে প্রবেশ করতে। পোলিং এজেন্টরা সেই ভোটারের বুড়ো আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে ভোটার ক্রমিক নং বের করে দিলেন মুহুর্তেই।
মূলত আমরা এতোদিন যে পদ্ধতিতে ভোট দিয়ে আসছিলাম সেটা ছিলো অ্যানালগ পদ্ধতি। অর্থাৎ সিল মেরে ব্যালট পেপার বক্সে ফেলা, পরে সেটা গুনে গুনে বিজয়ী ঘোষণা করা। যদিও বাংলাদেশে ২০০৭ সালে সর্বপ্রথম ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের কার্যকরী সংসদ নির্বাচনে সনাতনী ধাঁচের পরিবর্তে ই-ভোটিং পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। এর আগেও আংশিক ও পরীক্ষামূলকভাবে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সিটি কর্পোরেশনের ১৪টি কেন্দ্রে ও সদ্য গঠিত নারায়ণগঞ্জের সিটি কর্পোরেশনের ৫৮টি কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের মাধ্যমে ভোট নেয়া হয়েছিলো।
এরই ধারাবাহিকতায় ৫ জানুয়ারি, ২০১২ সালে কুমিল্লার সিটি কর্পোরেশনের সবগুলো কেন্দ্রে প্রথমবারের মতো ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ছয়টি আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করা হয়।
আধুনিক বিশ্বে ভোটারদের মত প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হলো নির্বাচন। তাই নির্বাচন পদ্ধতিটি হলো গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি যুক্তরাজ্য, এস্তোনিয়া এবং সুইজারল্যান্ডে সরকারী নির্বাচনসহ রাজনৈতিক বিষয় সম্পর্কে জনমত গ্রহণের মাধ্যম গণভোটে ইভিএমের ব্যবহার হয়েছে। এছাড়াও, কানাডার পৌর নির্বাচন এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের দলীয়ভাবে প্রাথমিক নির্বাচনের জন্য ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভোট কেন্দ্র কিংবা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক ভোটিং প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয় অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জার্মানি, ভারত, আয়ারল্যান্ড, ইটালী, নরওয়ে, পেরু, রোমানিয়া, ভেনেজুয়েলা এবং ফিলিপাইনেও।
মূলত: ভোট প্রয়োগে মেশিন বা ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় বলেই পুরো প্রক্রিয়াটি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম নামে পরিচিত। এর অন্য নাম হলো ই-ভোটিং।
ইতিহাস বলছে, ১৯৬০-এর দশকে প্রথমবারের মতো ইলেকট্রনিক ভোটিং পদ্ধতি প্রয়োগ করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৬৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৭টি অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনে এই পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
বিশ্বব্যাপী নিয়ম হলো ভোট কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের প্রয়োগ হবে। সরকারী অথবা স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের প্রতিনিধিরা সরাসরি তত্ত্বাবধান করবেন এবং সরকারী অথবা স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের প্রতিনিধিরা সরাসরি তত্ত্বাবধান ছাড়াই ভোটাররা তাদের ভোট প্রয়োগ করতে পারবেন। ভোট প্রয়োগের ক্ষেত্রে উন্নত এবং উচ্চতর প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে অতিদ্রুত ব্যালট পেপার গণনা করা সম্ভব। একই সাথে অক্ষম ভোটারগণও তাদের ভোট সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারেন।
ইভিএমের আরো ব্যপ্তি আছে। ঠিকমতো ব্যবহার করতে জানলে স্ব-স্ব মোবাইল ফোন ব্যবহার করেও ঘরে বসেই ভোট দেয়া সম্ভব। কারণ আমরা তো এখন ঘরে বসেই নিজেদের ভোটার আইডি সংশোধন করতে পারছি। যেহেতু আমি আমার ভোটার আইডি ব্যবহার করবো সেহেতু আমার ভোট আর অন্য কারো পক্ষে দেয়া সম্ভব হবে না। এই পদ্ধতি কার্যকর হলে আগামীতে ভোট কারচুপির অভিযোগ, ভোট গণনায় বিলম্ব, ভোট পরিচালনা ব্যয় এবং ভোগান্তি সবই কমবে বলে আমার ধারণা।
এখন ভোট কেন্দ্রে ভোটার আসার সংখ্যা নেহাতই কম ছিলো। এর বহু কারণ রয়েছে বলে আমি মনে করি। সংঘর্ষের আশঙ্কাকেই সবচেয়ে বড় করে ভেবেছেন ভোটাররা। সেই সাথে ছিলো প্রযুক্তির সাথে নিজেকে মানিয়ে না নেয়া।
এই দুটোই বাঙ্গালীর স্বভাবজাত। নতুন কোন কিছুকেই বাঙ্গালি সহজে মেনে নেয় নি, নেয় না। পুরোনোকে আকড়ে ধরেই থাকে বেশিরভাগ মানুষ। সুতরাং অনেকের কাছে স্বয়ং ভোটিং পদ্ধতিটিই আতঙ্কের বিষয় ছিলো। আমি নিশ্চিত, পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে এই ইভিএম পদ্ধতির ব্যবহার আরো জনপ্রিয় হবে।
আমাদের মানসিকতা পরিবর্তনের বিকল্প নেই। হাতের মুঠোর বিশ্ব এখন। এই পদ্ধতি আরো ফলপ্রসুভাবে ব্যবহারকে উতসাহিত করা এখন সময়ের দাবি। কিন্তু অনেকটা আবেগে, কিছুটা সন্দেহে আর বেশিরভাগটাই অজ্ঞতার কারণে বিশ্বে জনপ্রিয় এ ভোটিং পদ্ধতিটি যেনো কোনভাবেই থমকে না যায় সে চেষ্টা অব্যাহত রাখা জরুরী।
ভোটারদের কাছে ই ভোটিংকে আরো জনপ্রিয় করে তুলতে সরকার সকল গণমাধ্যমের সহযোগিতা নিতে পারেন। কারণ ই-ভোটিং এর ব্যবহার এবং উপকারিতা সম্পর্কে ভোটারদের সচেতন করার বিকল্প নেই।
ডিজিটাল বাংলাদেশে এখনও জনপ্রিয় অ্যানালগ ভোটদান। ঘুমিয়ে থাকা বাঙালিকে জাগিয়ে তুলতে সচেতনতা বাড়ানোই অন্যতম কাজ। সেই সাথে যাতে ভোটিং পদ্ধতিকে আরো সহজ করা যায় তাহলে ভোট নিয়ে অদূর ভবিষ্যতে আর কোন প্রশ্ন তৈরি হবে বলে আমার মনে হয় না।
আশাবাদী মন শুধুই স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখে অবাধ, সুষ্টু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের। বিপুল উতসাহ উদ্দীপণার মধ্য দিয়ে ভোটাররা স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ করছেন, কোথাও কোন বিশৃংখলা নেই, দাঙ্গা নেই, দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করছেন না ভোটাররা-এমন স্বপ্নে বিভোর দু’নয়ন। স্বপ্ন হোক সত্যি। অ্যানালগ নয় ডিজিটাল বাংলাদেশই হোক সত্যি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)