উপমহাদেশের কিংবদন্তি বাউল শিল্পী, সুরকার, গীতিকার শাহ আব্দুল করিমের নবম মৃত্যুবাষির্কী পালিত হলো আজ। ভাটি অঞ্চলের গানকে গ্রাম থেকে শহরে, দেশ থেকে দেশান্তরে তুমুল জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন তিনি। তার গান গেয়ে অনেক তরুণ শিল্পী জনপ্রিয়তার শীর্ষে চলে আসেন। বলতে গেলে মরমী এই শিল্পীর বেশির ভাগ গানই রচিত হয়েছে মানুষকে নিয়ে। ধর্ম-বর্ণ, জাত-পাতের ঊর্ধ্বে উঠে মানব আত্মার মুক্তি আর মানবপ্রেমই ছিল তার গানের লক্ষ্য।
সুনামগঞ্জের কালনী নদীর তীরে বেড়ে উঠা শাহ আব্দুল করিমের জন্ম ১৯১৬ সালে, দিরাই থানার ধলআশ্রম গ্রামে। তার মতো সীমাহীন দারিদ্র্য ও কষ্টের মধ্যে থেকে সঙ্গীত সাধনার এমন ইতিহাস খুব কম শিল্পীরই আছে। তবে নিজে এত দুঃখ-কষ্টের মধ্যে থেকেও মানুষের জন্য দেড় সহস্রাধিক গান রচনা করে গেছেন।
‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’, ‘সখী কুঞ্জ সাজাও গো’, ‘গাড়ি চলে না’, ‘আমি কূলহারা কলঙ্কিনী’, ‘কেমনে ভুলিবো আমি বাঁচি না তারে ছাড়া’, ‘কোন মেস্তরি নাও বানাইছে’, ‘কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু’,
অথবা ‘বসন্ত বাতাসে সইগো’ এমন সব অাকাশচুম্বি জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা শাহ আব্দুল করিম।
মূলত তার গানে ভাটির মানুষের দুঃখ-কষ্ট, সুখ-আনন্দ, প্রেম-ভালোবাসা যেমন উঠে এসেছে; তেমনি আছে তাদের প্রতি অন্যায়, অবিচারের কথা। আরো আছে ধর্মীয় কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িকতার বিরূদ্ধে মানবতার জয়গান। দেহতত্ত্ব, শরিয়তী, মারফতি এবং গণসংগীতেও তার গান মানুষকে অনুপ্রেরণা দেয়, বিমোহিত করে।
তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে তিনি তার গান দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। তাই তো শাহ আব্দুল করিম রচনা করেন ‘‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম। আমরা আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম। গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান, মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম’’ এমন শাশ্বত-সুন্দর অার কালজয়ী মানবপ্রেমের গান।
আমরা লক্ষ্য করছি, সারা পৃথিবীতেই ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা আর সাম্প্রদায়িকতা বেড়েই চলছে। বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে এটা দিন দিন তীব্র থেকে তীব্র আকার নিচ্ছে। অথচ দীর্ঘ বছর আগেই শাহ আব্দুল করিম এটা উপলদ্ধি করেই, এমন গান লিখেছিলেন।
তার এই মানবপ্রেম বা মানুষের প্রতি মানুষের অমলিন ভালোবাসা থেকে অস্থির এই সময়ে আমরা কতটুকু শিক্ষা নিচ্ছি? মানুষ হয়ে মানুষের প্রতি ঘৃণার যে সংস্কৃতি বেড়েই চলছে; তার বিরুদ্ধে আমাদেরকে কতটা ঐক্যবদ্ধ করেছে তার গান? নতুন প্রজন্ম কতটা জানছে তার সম্পর্কে? কিংবা তার সম্পর্কে জানানোর কোনো উদ্যোগ কি আমাদের আছে?
সম্ভবত না; তার মৃত্যুর নয় বছর পরও তেমন কিছু আমাদের চোখে পড়েনি। আমরা মনে করি, তার সম্পর্কে নতুন প্রজন্ম জানাতে এবং তার গানের মর্মবাণী ছড়িয়ে দিতে উদ্যোগ নেওয়ার সময় এসেছে। এই অস্থির সময়ে শাহ অাব্দুল করিমের মতো মানুষের আজ বড় প্রয়োজন।