আর ক’দিন পরেই দুর্গাপূজা। বাঙালি হিন্দু তথা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান একটি ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। আর তাই, ঐতিহ্য পরম্পরায় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এই উৎসবকে ঘিরে আনন্দে মেতে ওঠে প্রতি বছর। আভিধানিক অর্থে; উৎসব মানে উদযাপন বা আনন্দ অনুষ্ঠানের উদযাপন। উৎসবের রয়েছে রকমভেদ। মূলত আমাদের দেশে ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে ঈদ, পূজা, বড়দিন ইত্যাদি যার ভিত্তি হলো ধর্মাচার বা ধর্ম। আর পহেলা বৈশাখ উদযাপনকে বলা যেতে পারে ধর্মবিশ্বাস নির্বিশেষে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সামাজিক উৎসব। আভিধানিকভাবে ভিন্নতা থাকলেও শত শত বছরের মিথস্ক্রিয়ার ফলে ঈদ, পূজা, বড়দিনের মতো উৎসবগুলো সম্প্রদায়গত সীমানার গণ্ডি ছাড়িয়ে সার্বজনীন আনন্দ উৎসবে পরিণত হয়েছে অনেক আগেই। এ কারণেই ধর্ম যার যার হলেও উৎসবগুলো হয়ে উঠেছে জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালিরই মিলনমেলা।
উৎসব মানুষে মানুষে নৈকট্য বাড়ায়, মানুষের হৃদয়ে মনুষ্যত্বের শুভবোধের উন্মেষ ঘটায় আর সম্প্রীতিবোধকে করে তোলে সুদৃঢ়। বোধ করি, তাই আমাদের দেশে প্রচলিত একটি কথা আছে- ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।’ বহুকাল ধরে লালিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কারণে বাংলাদেশের মত একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজার ব্যাপ্তি সকল সম্প্রদায়ের মানুষের মাঝে তৈরী করে সার্বজনীন মিলনমেলা। দূর্গাপূজাকে তাই আখ্যা দেয়া হয় ‘সার্বজনীন শারদীয় দূর্গোৎসব’ হিসেবেই।
আর সার্বজনীন বলেই দুর্গাপূজো হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি ধর্মীয় উৎসব হলেও সকল ধর্মের লোকরাই এই আনন্দ আয়োজনে সামিল হন। আর সংখ্যালঘুদের এই উৎসবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায়ের পূর্ণ সহযোগিতা আর অংশগ্রহণ বারবার বার্তা দেয় অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি চেতনার। যে চেতনার উপরে ভিত্তি করেই একটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একাত্তরে জন্ম হয়েছিলো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।
এই সংক্রান্ত একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছি। আমার মামা বাড়ি ঝালকাঠি জেলায়। আমি খুব ছোটবেলা থেকে দেখেছি, ভিতর বাড়ির দুর্গাপূজার আয়োজনে মামারা থাকলেও বাইরে লোকদের আপ্যায়ন, বাজার করা বা অনান্য অনেক কাজ, সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের হওয়ার পরেও, হাতে হাত লাগিয়ে খলিল মামা, কাঞ্চন মামা বা মামাদের বন্ধুরা করত বা মামাদের সাহায্য করত। আর মহাঅষ্টমীতে তো বাবুর্চি দিয়ে রান্না করিয়ে সকলকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানোর প্রচলনও দেখেছি। ধর্ম, গোত্র নির্বিশেষে সকলেই আসতেন সেই নিমন্ত্রণে। কখনও শুনিনি আমার মামাদের ‘ভাইডি’ ছাড়া অন্য কোন নামে সম্মোধন করেছেন উনারা।
প্রকৃতপক্ষে, ভাইয়ের মতনই মামাদের সাথে থাকতে দেখেছি সবসময়। আমার বা আমার কাজিনদের কোনদিন মনেই হয়নি উনারা অন্য সম্প্রদায়ের বলে আমাদের দূরের কেউ বরং বিভিন্ন প্রয়োজনে আমরা ভাইবোনরা এই মামাদের কাছেই বেশি আবদার করি যখনই বেড়াতে যাই মামাবাড়িতে। কিন্তু, এমনটা ভাববার কোনও কারণ নেই যে উনারা নিজেদের ধর্মীয় আচার বা প্রথা পালন করেন না। উনারা নিজেদের ধর্মীয় আচার এবং প্রথা সবই সুষ্ঠুভাবে পালন করেন। আমার কাছে এই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশটা ভীষণ আপন, ভীষণ কাছের। খলিল মামা, নাসির মামা, রফিক মামা বা কাঞ্চন মামা আর নিজের মামাদের মধ্যে পার্থক্য করতে শিখিনি কারণ ঈদের সময় প্রথম উপহারগুলো আমাদের বাড়িতেই আসত। আজও মনে পড়ে; ঈদ আসলেই স্কুলের প্রিয় বান্ধবীদের নিয়ে সারা শহর ঘুরে বেড়ানো, খাওয়া, আড্ডা। ঈদ মানেই অনাবিল আনন্দ। ঈদ আর পূজোর সার্বজনীন রূপটা হচ্ছে আনন্দ। আমার কাছে এই আমার বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ, আমাদের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ।
কিন্তু যখন দেখি এই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে কিছু লোক সাম্প্রদায়িক কলুষতার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে, তখন কুণ্ঠিত হই, কষ্ট হয়। প্রায় প্রতি বছরই শরৎকালে দেশের কোনো না কোনো জায়গায় নির্মাণাধীন দুর্গা প্রতিমা ভেঙে ফেলা যেন এক নিতান্তই স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। কাজগুলো করা হয় রাতের অন্ধকারে। কারণ যারা ভাঙে, তারাও জানে যে এটি একটি বেআইনি কাজ। দিনের বেলা প্রকাশ্যে ভাঙতে এলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ মানুষই আগে ছুটে আসবেন প্রতিরোধ করতে।
আমার মনে প্রশ্ন জাগে তাদের জন্য যারা রাতের আঁধারে মূর্তি ভাঙেন, অন্যের ধর্মকে নিয়ে কুৎসা করেন। আপনার কাছে যা মৃন্ময়ী বা মূর্তি আমার কাছে তা চিন্ময়ী। আপনার কাছে যা নিছকই মাটির দলা, তা তো আমার ভগবান। আপনার কাছে যা নিছকই বিধর্ম তাই হয়ত আমার আচার-আচরণ। অন্যের ধর্মকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে মূর্তি ভেঙে নিজে বড় হওয়া যায় কি? এভাবে মূর্তি ভাঙার উৎসব করে মাটির প্রতিমাকে ভাঙতে পারলেও মনের প্রতিমাকে ভাঙতে পারছেন কি? আপনার কাছে যা মূর্তি, আমার কাছে সে তো দশভুজা, অসুর বিনাশীনী। এ আমার বিশ্বাস, আমার ধর্ম, আমার জীবন পথে চলার দর্শন। তাই ধর্ম যার যার হলেও আর উৎসব সবার হয়েও ওঠে না; নিতান্তই অল্পকিছু লোকের এহেন নোংরা আচরনের কারণে। অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যে অর্থে সদ্ভাব, প্রণয় বা আনন্দকে বোঝায় তার অনেকটাই ম্লান হয়ে যায়। সম্প্রীতি সকলকে নিয়েই বিনির্মাণ হয় ভেদাভেদে নয়। মানুষে মানুষে সংযোগ ছাড়া সম্প্রীতি গড়ে ওঠে না। আর তা কেবলই সম্ভব ভালবাসায়, ঘৃণায় নয়।
পরিশেষে, শিশিরের স্নিগ্ধতা আর শারদ আকাশের নির্মল রংয়ের ছোঁয়ায় সকল কলুষতার অবসান হোক! কাশফুলের শ্বেত শুভ্রতা ছুঁয়ে যাক আমাদের মনের কোণের সকল আঁধারকে। জগতের প্রতিটি প্রাণীর মঙ্গল হোক! ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকলকে শারদীয় শুভেচ্ছা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)