মৌলিক রচনায় নিবেদিত প্রত্যেক লেখকেরই একটা স্বপ্ন থাকে যে, তিনি নিজেই হয়ে উঠবেন অন্যের জন্য অনুকরণীয়, সবার মাঝেও তার লেখার থাকবে ভিন্ন একটা ‘সিগনেচার মার্ক’। তিনি বাঁচবেন তার নিজের ছায়ার সাথেই।
সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে পথ চলা সমকালীন একজন লেখক ‘স্মৃতি ভদ্র’। তার এই পথ চলাতে আনন্দসাঁকো হয়ে জাগৃতির সাথে যোগসূত্র করে দিলো পেন্সিল।
ফেসবুক সাহিত্যভিত্তিক গ্রুপ পেন্সিল ও জাগৃতি প্রকাশনী প্রতিভা অন্বেষণের মাধ্যমে যোগ্যতম মেধা হিসেবে খুঁজে নিয়েছে-গল্পকার স্মৃতি ভদ্রকে। অসংখ্য পাণ্ডুলিপির মধ্যে যাচাই-ছাইয়ের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের অমর একুশে বইমেলাতে প্রকাশিত হয়েছে স্মৃতি ভদ্রের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অলোকপুরীর ডাক।’
গ্রন্থটিতে মোট ১০ টি গল্প সংকলিত হয়েছে। ‘জল জ্যোৎস্না’ এই গ্রন্থের প্রথম গল্প।এই গল্পটি বলার ঢং একটু আলাদা। জ্যোৎস্নার নিজের ভাষার মাটিমাখা গন্ধে রচিত হয়েছে এই গল্পের ছোট ছোট বাক্যগুলো। গল্পে জ্যোৎস্না যখন ডিঙ্গিনৌকা বেয়ে বিলের পানি কেটে এগোয় তখন বুকের ভেতর বৃষ্টিভেজা গন্ধের আকুলতা শুরু হয়।
অটিজম নিয়ে লেখা ‘জলরং ছবি’ গল্পটি পড়তে পড়তে পাঠকের মন আবেগে আপ্লুত হবে শাঁওলি আর বুবুনের জন্য। তবে একজন অটিস্টিক শিশুকে নিয়ে তার মায়ের যুদ্ধজয়ের ইঙ্গিত গল্পকার দিলেও আবেগই এই গল্পে মুখ্য হয়ে উঠেছে।
‘মাটির মায়া’ গল্পটি পাঠকের হৃদয়ে নিশ্চিতভাবে দাগ কাটবে। বীরাঙ্গনা হাস্নাবানুর লাল-সবুজ পতাকা জয়ের গল্প এটি। গল্পের শেষ প্যারাটি পড়তে গিয়ে দৃশ্যটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে-এ দেশের বিদ্যাপীঠগুলোতে হাস্নাবানুর তৈরি শত শত লাল-সবুজ পতাকা উড়ছে।
‘অলোকপুরীর ডাক’ গল্পটিও দৈর্ঘ্যে ছোট। বইটির নামকরণ এই গল্পের নামে হওয়ায় ‘এই গল্পটিতে গল্পকারের যেন আরও কিছু বলার ছিল’, পাঠক হিশেবে আমার মনে এই আফসোসটা রয়ে গেছে। তবে দীর্ঘবছর প্রবাসে থেকে দেশেরটানে নবনী যখন কোচড়ভর্তি করে প্রাণপ্রাচুর্য নিয়ে স্বজনহীন বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ায় তখন পাঠক ভাবতে বাধ্য হয় ঘরে ফেরার তাড়া কতটা দুর্মর হতে পারে।
‘বেহাগ’ গল্পটি এই বইয়ের একটি দীর্ঘ গল্প এবং এই গল্পটি প্রকৃত অর্থেই এই বইয়ের অন্যতম একটি সেরা গল্প। সমকালীন সময়ের খুব চেনা একটি বিষয়কে নিয়ে রচিত হয়েছে এই গল্পটি। কোনো কোনো মানুষের স্বপ্ন আকাশছোঁয়া, আবার কখনো কখনো মানুষ তার স্বপ্নপূরণের বাসনায় ক্যারিয়ারকে এত বেশী আঁকড়ে ধরে যে, জীবনের আবেগ অনুভূতিগুলো খুব তুচ্ছ হয়ে যায়। ‘বেহাগ’ গল্পের নীলু তেমন উপলব্ধিতে তাড়িত হয় নিজের একাকী সময়ে।
‘সিঁদুরগোলা ভোরের আকাশটা যখন আয়েশি শেষপ্রস্থ ঘুমের হাতছানি দেয় ঠিক তখনি শাঁওলিকে প্রতিদিন উঠতে হয়’ এমনই এক বাক্যালংকারে ‘বদলে যাওয়া’ গল্পটির চমৎকার শুরু। শাঁওলি আর সাগ্নিকের দাম্পত্য জীবনের সুরের ছন্দপতন, সময়ের স্রোতে পছন্দ-অপছন্দের রদবদলের সাথে সাথে প্রিয় মানুষের বদলে যাবার হাহাকারের গল্প ‘বদলে যাওয়া।’
ভাষার অনন্য অলংকারে সজ্জিত ‘নিমফুল’ ও ‘শ্যাওলা জীবন’ গল্প দুটিও পাঠকের ভাল লাগবে। ভালোবাসার খেলা খেলতে গিয়ে শোভন যখন সাদাকালো চারকোণা ঘরগুলোতে রাজা, উজিরের দান দিতে শুরু করে তখন তার সঙ্গে সব দায় মিটিয়ে ফেলার সিদ্ধান্তে আশার পর রূপন্তির মুক্তির অনুভূতি পাঠককে ছুঁয়ে যাবে।
গল্পকার স্মৃতির লেখায় বর্ণমালার দায় শোধ করার বাসনা থেকে মুক্তিযুদ্ধ তার গল্পের বিষয় বস্তু হয়ে ওঠে বার বার। মুক্তিযুদ্ধ ও এই দেশের বীর সন্তানদের নিয়ে এই গ্রন্থে দুটো চমৎকার গল্প আছে ‘মুক্তির আলো’ ও ‘সূর্যসন্তান।’ ‘সূর্যসন্তান’ গল্পের এক বীরাঙ্গনা মায়ের সন্তান আরশি যেন সত্যিকার অর্থেই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হয়ে আছে।
স্মৃতি ভদ্রের ‘অলোকপুরীর ডাক’ গ্রন্থের প্রতিটা গল্পই তার বর্ণনাভঙ্গির দক্ষতার কারণে পাঠককে শেষ অবধি ধরে রাখে ।
রিভিউ লেখক: সাদিয়া সুলতানা
গল্পকার: স্মৃতি ভদ্র
প্রকাশনী: জাগৃতি প্রকাশনী
প্রচ্ছদ: ফারিয়া টিনা
মূল্য: ২০০ টাকা।
প্রকাশকাল: ২০১৮ বইমেলা