বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার তথা মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে সমন্বিত উদ্যোগের আওতায় একটি গাইডলাইন বা নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
একই সাথে এই কার্যক্রম তদারকির জন্য ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় সংস্থা হিসেবে কার্যরত এই সংস্থা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়।
এতে বলা হয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বিএফআইইউ, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত ফোকাস গ্রুপ গাইডলাইন্স এর খসড়া প্রণয়ন করে। এরপর বিএফআইইউ গাইডলাইন্স জারির আগে সবার মতামতের জন্য গাইডলাইন্স ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারের সাথে আলোচনা এবং প্রাপ্ত মতামত ও সুপারিশ পর্যালোচনা করে মঙ্গলবার চূড়ান্ত গাইডলাইন্স সম্বলিত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, বিএফআইইউ এর গাইডলাইন্সের আলোকে প্রতিটি ব্যাংক বাণিজ্যভিত্তিক মানিলন্ডারিং ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে নিজস্ব গাইডলাইন্স বা ম্যানুয়েল প্রস্তুত করে আগামী বছরের ১০ মার্চের মধ্যে বিএফআইইউএ দাখিল করবে। ১ জুনের মধ্যে এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে।
কেন এই গাইডলাইন্স জারি করা হলো তার ব্যাখ্যা দিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, পাচারকৃত অর্থের বেশিরভাগ অর্থাৎ ৮০ শতাংশেরও বেশি বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে পাচার হয়। বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হচ্ছে এ ধরনের প্রতিবেদন বাংলাদেশের বিভিন্ন গবেষণায় ও সংবাদ মাধ্যমেও উঠে এসেছে।
এছাড়াও বিএফআইইউ, দুদক ও সিআইডি’র যৌথ উদ্যোগে প্রণীত ‘বাংলাদেশের মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন ঝুঁকি নিরুপণ প্রতিবেদনে’ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে মানিলন্ডারিং ও বিদেশে অর্থ পাচারকে ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) থেকে অর্থ পাচার বিষয়ক চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারিতে প্রকাশিত ‘ইলিসিট ফাইন্যান্সিয়াল ফ্লোজ টু অ্যান্ড ফ্রম ১৪৮ ডেভেলপিং কান্ট্রিজ: ২০০৬-২০১৫’ প্রতিবেদন অনুযায়ী ট্রেড মিসইনভয়েসিং (ব্যবসায় আমদানি-রপ্তানি মূল্য বেশি বা কম দেখানো) এর মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ বাইরে চলে গেছে এমন প্রথম ২০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৮তম। একইভাবে ওই প্রতিবেদনে ট্রেড মিসইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ দেশে প্রবেশ করেছে এমন প্রথম ৫০টি দেশের তালিকায়ও বাংলাদেশের নাম রয়েছে।
মানিলন্ডারিং কিংবা পাচার সংক্রান্ত বিষয়ে আইন অনুযায়ী, ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিবেদন প্রদানকারী সংস্থা হতে পাঠানো সন্দেহজনক লেনদেন পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ শেষে নির্ধারিত তদন্ত সংস্থায় পাঠিয়ে থাকে। প্রতি অর্থবছরে প্রকাশিত এবং ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিএফআইইউর বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায়ও দেখা যায়, ইউনিট থেকে তদন্ত সংস্থায় যতগুলো কেস বা সন্দেহজনক লেনদেন পাঠানো হয় তার বেশিরভাগই বাণিজ্য ভিত্তিক মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং (পণ্যের দাম বেশি দেখানো) ও আন্ডার ইনভয়েসিং (পণ্যের দাম কম দেখানো) এর মাধ্যমে অর্থ পাচারের হার সবেচেয়ে বেশি। আমদানিযোগ্য পণ্য বা সেবার মূল্য বাড়িয়ে বিশেষতঃ যে সব পণ্যের উপর আমদানি শুল্ক কম (যেমন-মুলধনী যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, কম্পিউটার সামগ্রী ইত্যাদি) বা যেসব পণ্য বা সেবার দাম নির্ধারণ কঠিন সেসব পণ্য বা সেবা আমদানির মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়ে থাকে। বিপরীতভাবে রপ্তানি করা পণ্যের মূল্য কম দেখিয়ে অবশিষ্ট অর্থ বিদেশে রেখেও অর্থ পাচার ঘটে থাকে। পাশাপাশি আমদানি করা পণ্যের বিবরণ পরিবর্তন করে বা কোনো পণ্য আমদানি না করে শুধু ডকুমেন্টের বিপরীতে মূল্য পরিশোধ করেও অর্থ পাচার হয়ে থাকে। তা ছাড়া একই পণ্য বা সেবার একাধিক চালান ইস্যুকরণ, ঘোষণার তুলনায় পণ্য বা সেবা বেশি বা কম জাহাজীকরণের মাধ্যমেও অর্থ পাচার হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অধিকাংশই ব্যাংকের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। বিভিন্ন সংবাদ পত্রে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হওয়ার প্রেক্ষিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে বিএফআইইউকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করা হয়। এছাড়া মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত ওয়ার্কিং কমিটির সভার সভাপতি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব অর্থ পাচারের আগেই তা চিহ্নিতকরণ এবং পাচার রোধে সম্ভাব্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে বিএফআইইউকে নির্দেশনা দিয়েছেন।
সার্বিক প্রেক্ষাপটে বাণিজ্যভিত্তিক মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে অন্যান্য উদ্যোগের পাশাপাশি বিএফআইইউ এই গাইডলাইন্স জারি করেছে।
চীন কিংবা ভারতের মতো দেশগুলো থেকে অর্থপাচার বেশি হলেও দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশই বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের জন্য বাণিজ্যভিত্তিক মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে এই গাইডলাইন্স জারি করলো।
তাছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংকমূহ আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য বা প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ অপারেশন ডিপার্টমেন্টে রিপোর্ট করে বিধায় তথ্য বিশ্লেষণে কোনোরূপ অনিয়ম বা অপরাধ নজরে আসলে উক্ত বিভাগ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। সেই বিবেচনায় বিএফআইইউ থেকে শীর্ষ আমদানিকারক, আমদানি পণ্য, আমদানিকারকের ব্যাংক শাখা, গ্রাহক ওয়ারী আমদানি প্রবৃদ্ধি, অস্বাভাবিক কম অথবা অতিরিক্ত মূল্যে আমদানির সাথে সংশ্লিষ্ট এ ধরনের সন্দেহজনক গ্রাহক, বিল অব এন্ট্রি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে এমন গ্রাহক, রপ্তানি আয় দীর্ঘদিন যাবৎ অপ্রত্যাবাসিত রয়েছে এমন গ্রাহক এবং আন্তর্জাতিক গ্রাহকের তালিকা ও অভিযোগের বিস্তারিত বিবরণ বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ অপারেশন ডিপার্টমেন্ট হতে সংগ্রহ করা হয়েছে।
এ ইউনিট হতে আমদানি তথ্য পর্যালোচনা করে অস্বাভাবিক আমদানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে এমন কতিপয় ব্যাংক চিহ্নিত করা হয়েছে। বাণিজ্যভিত্তিক মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে ব্যাংকসমূহের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইতোমধ্যে বিএফআইইউ ব্যাপক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে।
এতে আরো বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে মানিলন্ডারিং ও বিদেশে অর্থ পাচার একটি গুরুতর ও জটিল বিষয়। এর মাধ্যমে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে এ ইউনিট নেয়া পদক্ষেপ ছাড়াও এ বিষয়ে কৌশলগত বিশ্লেষণ, বাণিজ্যভিত্তিক মানিলন্ডারিং এর ক্ষেত্র ও পদ্ধতি চিহ্নিতকরণ, এর মাধ্যমে সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদন বৃদ্ধির প্রক্রিয়া যাচাই, ব্যাংকসমূহের আমদানি-রপ্তানি তথ্য পর্যালোচনা এবং সে প্রেক্ষিতে চিহ্নিত ব্যাংকসমূহে পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের লক্ষ্যে একজন উপ-মহাব্যবস্থাপকের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে।